ঢাকা ,
বার : মঙ্গলবার
তারিখ : ২৮ অক্টোবর ২০২৫
বাংলা : ১২ কার্তিক ১৪৩২
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় আমার বিদ্যালয়, আমার  বাতিঘর: শিক্ষকরা তার অসীম সুন্দরের কারিগর

আমার বিদ্যালয়, আমার  বাতিঘর: শিক্ষকরা তার অসীম সুন্দরের কারিগর

0
803

আমার সন্তান যেই বিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণ করে আমি সেই গৃহকে দেবালয় মনে করি। উপাসনা গৃহের মতো‌ই এখানে সকলে জ্ঞানের অন্বেষণ করেন, জ্ঞানের পূজা করে পাণ্ডিত্য ও সন্তুষ্টি লাভ করেন।

যারা সেবাদান করেন তারা শিক্ষা ও নৈতিকতার আদর্শ বিলিয়ে দিয়ে কেবল জীবিকাই নির্বাহ করেন না, তারা পরম ব্রতে ব্রতী হয়ে সব শিশুকে মানবিক শিক্ষা ও আচরণ গঠনের সহায়তা করেন।

সেই সেবার মূল্য আমার সন্তানের জীবনতুল্য, কারন এই শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়েই তারা শিক্ষায়-দীক্ষায় সত্যিকারের মানুষ পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে। সকলেই জ্ঞান ধারণ করেন কিন্তু সেই জ্ঞান বিতরণের ক্ষমতা সকলের থাকে না, কিন্তু একজন শিক্ষক কেবল সেই জ্ঞান বিতরণের ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখেন যা তার সৃজনশীলতা দিয়ে প্রকাশ করেন।

আমি যত বড় বিদ্বান হই না কেন, আমার সন্তানকে পাঠ্যপুস্তকের সম্পূর্ণ জ্ঞান ও চারিত্রিক গুণাবলী শিক্ষা দেওয়া আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়; কিন্তু শিক্ষকের কথা ও কলমের এক আঁচরেই সন্তানের নরম মস্তিষ্কে চেতনা জাগ্রত হয়, অ-আ, ক-খ অঙ্কিত হয়।

পূজা ও প্রণাম দক্ষিণা পায় বলেই সূর্য আলো দেয়, অথচ কিছুমাত্র অর্থের বিনিময়ে মানুষকে শক্তিশালী ও আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায় শিক্ষক তার মাথায় তুলে নেন। তারা মানুষের চেয়েও বড় মানুষ, তাদের সম্মান কেবল মুখের কথায় নয় বরং আমাদের সর্বোচ্চ সমীচীন আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করলেও কম করা হবে। কখনো কখনো শিক্ষকরা শত লাঞ্ছনায়, অবহেলায় ও অভাবে জীবন যাপন করেন, তবুও একটি শিশুর জীবনে আলো দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। তাদের জীবনে জ্ঞানের ভাণ্ডার অর্থের চেয়েও বেশি মূল্যবানের ও সমাদরের। একজন শিক্ষক তার সংসারের কাজে অবহেলা ও ক্লান্তি বোধ করলেও বিদ্যালয়ের সকল কাজকে পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করেন এবং তা সম্পন্ন করার জন্য একনিষ্ঠ থাকেন। তিনি আপন দক্ষতায় যেই মানুষকে মানুষ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন সেই মানুষটি আমি-আপনি এবং আমার-আপনার সন্তান। আমরা আত্মজ্ঞান ও শিক্ষার জন্য গর্ববোধ করি, তার পিছনে যাদের অবদন তাদের কথা ভুলে যাই।

অথচ তারাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে মানব সন্তানকে পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান, ন্যায় আচরণ, চিন্তার সৃজনশীলতা সর্বোপরি মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে উন্নত চরিত্রে ও বৈশিষ্ট্যে উন্নত করেন। আমাদের জীবনের সফলতার পিছনে যাদের অগাধ প্রচেষ্টা, শ্রম ও আন্তরিকতা নিহিত রয়েছে তারাই হলেন বিভিন্ন বিদ্যাপিঠের সুনিপুন কারিগর, গোটা মানবজাতির শিক্ষক।

শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীর হাতে যেই প্রদীপটি জ্বালিয়ে দেন তা আমার সন্তান বিদ্যালয় থেকে ঘর পর্যন্ত যেতে যেতে নিজের পথ সুগম করে এবং পথের আঁধার দূর করে। পথিমধ্যে প্রদীপটি যেনো নিভে না যায় তার জন্য একটি শক্ত বাতিদানি হাতে ধরিয়ে তার যত্ন নেয়ার ভার আমার। যাকে আমি সম্মান করবো, আমার সন্তানও তাকে সম্মান করতে শিখবে। আমি যাকে অবহেলা, অবজ্ঞা করবো আমার সন্তানও তার প্রতি বিমুখ হবে, তার ভিতরে অন্যদের প্রতিও এই মনোবৃত্তি তৈরি হবে। শিক্ষকরা মানব জীবনকে শিক্ষায়-দীক্ষায় আলোকিত করেন, তারা অবশ্যই সকলের উর্ধ্বে, অধিক সম্মান পাবার যোগ্যতা রাখেন। অথচ সেই আলোর দিশারী ও পথপদর্শক ব্যক্তিকে আমরা দুর্বল ভেবে পদে পদে আঘাত করি, আমাদের শিক্ষার অমর্যাদা করি আর আমাদের এই হীনপ্রবৃত্তির প্রকাশ ধীরে ধীরে প্রবাহিত হতে থাকে আমাদের সন্তানদের চরিত্রেও। বড় দুঃখ, লজ্জা ও হতাশার বিষয় এই যে, প্রায়শই অভিভাবক ও শিক্ষার্থী দ্বারা শিক্ষকরা লাঞ্ছিত, আহত ও খুন হন। আমার সন্তান যখন সেই আলোর প্রহরীকে প্রহার করে, প্রহসন করে তখন নীতি, নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটে, মৃত্যু ঘটে আমার মাতৃত্ব ও পিতৃত্বেরও। যেই দেশে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে সম্মান করতে জানে না সেই দেশ একটি অভিশপ্ত দেশ; এদের উদ্ধত আচরণ দমন না করলে পুরো দেশ একদিন অমার্জিত সন্তানে ভরে উঠবে।

ভাবতেই গা শিউরে ওঠে যে ঐ সন্তানের জন্ম আমরাই দিয়ে থাকি। বিবেকের এই দৈন্যতা ও কলুষতা আমাদের তখনই ঘুচবে যখন আমরা শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান দেখাবো, তাদের অকৃত্রিম দানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো এবং আমাদের সন্তানদেরও তা শেখাবো। আমরা অনেকেই কেবল শিক্ষকদেরই নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও অমর্যাদা করি! সংসারের সকল চাহিদা পূরণ করার মধ্যে কার্পণ্য না করলেও শিক্ষকের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে হাত সরে আসে, শিক্ষকের প্রাপ্য পারিশ্রমিক মুঠোয় লুকিয়ে রাখি। আমরা একবারও ভেবে দেখিনা যে ভালো খাবার আর ভালো পোশাকে মানুষকে কেবল মানুষ ভাবা যায়; কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষা তাকে প্রাণী জগতের অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা- বৈশিষ্ট্য ও অনন্য চরিত্রের অধিকারী করে তোলে, বোধ ও সৃজনশক্তি জাগ্রত করে। স্বীকার করি বা না করি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই এই জাগরণের মূল চালিকাশক্তি, তাদের প্রতি আমাদের আজন্ম ঋণ!

মনে পড়ে, স্কুল জীবনে আমরা আমাদের স্যার ও দিদিমনিদের শাসনকে ভয় পেতাম আবার তাদের আদর-ভালোবাসায় মজেও যেতাম। তাদের মুখের কথা ও শাসন দৈব্যবাণীর মতো অন্তরে গেঁথে যেতো। শুধু পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষাই নয়, দৈনন্দিক জীবনের ছোট ছোট কাজগুলো, যেমন-রুম ঝাড়ু দেওয়া, চেয়ার টেবিল-বেঞ্চ পরিস্কার করা, মাঠের পাতা পরিস্কার ও ঝাড়ু দেওয়া ইত্যাদি ছোট ছোট কাজ করার অভ্যাস বিদ্যালয় থেকেই আমরা শিখেছি। এই কাজগুলোতে ছিলো প্রচুর আনন্দ! পরিবারে সবার সাথে মাঠে ঘাটে ও মায়ের সাথে সংসারের কাজ হাসিমুখে করতে পেরেছি। ক্লাসে যারা দুষ্ট প্রকৃতির ছিলো, যারা ক্লাসে অনিয়মিত ছিলো তাদের প্রতিও শিক্ষককে কঠোর হতে দেখেছি। এই কঠোরতা বাবা-মায়েরা সন্তানের মঙ্গল ও আশির্বাদ ভেবে খুশি হয়েছেন। এই সকল নৈতিক শিক্ষার ফলে আমরা শিক্ষক-আত্মিয়স্বজন-পাড়া প্রতিবেশী সকলের সাথে সদ্ব্যবহার করতে শিখেছি। তারাই আমাদের সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক কাজের জন্য হাত ধরে টেনে সামনে এনেছেন, দাঁড় করিয়েছেন সকলের সামনে । নিয়মের মধ্যে জীবনযাপনের অভ্যাস তো আমাদের সেই পথপ্রদর্শক শিক্ষকদের কাছ থেকেই শেখা। দিনের পুরোটা সময় আমাদের নিয়ম ও শৃঙ্খলার মধ্যে বাঁধা ছিলো, পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারের কাজ, খেলাধূলা ও বিনোদন করার সুযোগেরও কোনো অভাব ছিলো না। এখনকার সময় বদলেছে; অনেক সময় শিক্ষকের শাসন, পড়াশুনা আদায়ের কৌশল ও কর্মমূখি শিক্ষাকে অন্যায় ভেবে অনেক অভিভাবকগণই তেড়ে আসেন। শিক্ষার্থীর অন্যায় কাজকে দমন করার উদ্যোগ কখনো কখনো শিক্ষকের জন্য হুমকি স্বরূপ হয়ে ওঠে। যেই শিক্ষক হাতে কলমে ও মুখের কথায় সন্তানের আচরণ বদলে দেবার চেষ্টা করেন সেই শিক্ষকের জীবনকে পঙ্গু করে দেবার চেষ্টা করে এই দেশের কিছু কিছু অসভ্য মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ। অথচ একটা সময় ছিলো বাবা-মায়েরা সন্তানকে শিক্ষকের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে সকল প্রকার শাসনকে আর্শিবাদ ভেবে স্বস্তি পেতেন। একমাত্র বিদ্যালয়ই সন্তানের উন্নতির সুপান, আর তার কর্মীরা অসীম সুন্দরের কারিগর। আমার সন্তান তখনই তৃষ্ণায় একগ্লাস জল আমাকে এগিয়ে দিতে শিখবে যদি সে তা স্কুল থেকে শিখে আসে, আমার সন্তানই তখনই মানবিক আচরণ করবে যখন সে তার স্কুলের সকল কাজকে সম্মানের সাথে পালন করবে, আমার সন্তান তখনই আমায় সম্মান দিয়ে কথা বলবে যখন সে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সকল প্রকার শিক্ষাকে সম্মানের সাথে শিখবে এবং তা পালন করবে।

বেগম রোকেয়ার “স্ত্রী জাতির অবনতি” প্রবন্ধ থেকে নিম্নের উল্লেখিত এই কথাগুলো আমাদের চিন্তা শক্তিকে আরও বাড়িয়ে দেয়:-

“শিক্ষা”র অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষ “অন্ধ-অনুকরণ” নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা (faculty) দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি (develop) করাই শিক্ষা। ঐগুণের সদ্ব্যবহার করা কর্ত্তব্য এবং অপব্যবহার করা দোষ। ঈশ্বর আমাদিগকে হস্ত পদ, কর্ণ, মনঃ এবং চিন্তাশক্তি দিয়াছেন। যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করি, হস্ত, দ্বারা সৎকার্য্য করি, চক্ষুদ্বারা মনোযোগ সহকারে দর্শন (বা observe) করি, কর্ণ দ্বারা মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ করি, এবং চিন্তাশক্তি দ্বারা আরও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করিতে শিখি-তাহাই প্রকৃত শিক্ষা।