ঢাকা ,
বার : শনিবার
তারিখ : ০৪ মে ২০২৪
বাংলা : ২১ বৈশাখ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা দেশ নিধন ডি’ রোজারিওর ৩৬তম প্রয়াণ দিবস আজ

নিধন ডি’ রোজারিওর ৩৬তম প্রয়াণ দিবস আজ

0
1276

শিবা মেরী ডি’ রোজারিও ॥ ঢাকা

স্বগীর্য় নিধন ডি’ রোজারিও বাংলাদেশের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মধ্যে একজন জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কবি, গীতিকার, কলাম লেখক এবং বেতার-কথিকা রচয়িতা।

তিনি ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলাধীন শুলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রেণু ডি’ রোজারিও ও তেরেজা ডি’ রোজারিও- দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে বড়ো। তিনি শুলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে হাঁসাড়া কালী কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ভর্তি হন রাজানগর উচ্চ বিদ্যালয়ে। আর এ বিদ্যালয় থেকেই ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এরপর ঢাকাস্থ কায়েদ-ই-আজম কলেজে ভর্তি হন। পরিবারের বড়ো সন্তান হওয়ায় অল্প বয়সেই সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় বলে দুই বছর কলেজে পড়ার পরও শেষ পর্যন্ত পড়ালেখা সমাপ্ত করতে পারেননি।

১৯৫৬ থেকে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আমৃত্য তিনি তৎকালীন গ্ল্যাক্সো নামক সুপরিচিত বিদেশী ঔষধ কোম্পানীতে কর্মরত ছিলেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী না থাকলেও তিনি নিজে প্রচুর পড়াশুনা করতেন। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীনই তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রধান লেখকদের জনপ্রিয় বইগুলো পড়ে শেষ করেন।

কবিতার মাধ্যমে তার লেখালেখি শুরু হয়। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে মাসিক প্রতিবেশীতে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮  খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার মাসিক দিলরুবা পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ’আত্মহত্যা’ প্রকাশিত হয়। এরপর একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস ‘কালের ছোবল’ দিলরুবাতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়। অন্যান্য যেসব গল্প প্রকাশিত হয় সেগুলো হল টেকনাফ, জৈবিক ও মাটির দেয়াল (দিলরুবা), পান্ডুলিপি (সওগাত), একটি বর্ণাঢ্য আত্মা (জোনাকী), বাঁশীর সুর (প্রতিবেশী)।

তিনি কয়েকটি নাটক রচনা করেছেন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তার লেখা ‘আর্শিবাদ’ নাটকটি শুলপুর ও অন্যান্য স্থানে মঞ্চস্থ হয়। পরের বছর মঞ্চস্থ হয় ‘খেলাঘর’ নাটকটি। ’শেষ প্রান্তর’ নাটকটি বাংলাদেশর বিভিন্ন ধর্মপল্লীতে ব্যাপকভাবে মঞ্চস্থ হয়। এছাড়াও তিনি ‘একুশের আত্মারা কাঁেদ’, ‘সূর্য শপথ’, ‘ওরা কারা?’, ‘সাম্প্রতিকের মহড়া’ এবং ‘মৃত্যুঞ্জয়ী যীশু’ নাটকগুলো লিখেছেন।

১৯৭৫-১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি প্রতিবেশী সম্পাদকীয় মণ্ডলীর একজন সদস্য ছিলেন। প্রতিবেশীতে স্বনামে ও ছদ্মনামে তিনি অনেক ফিচার কলাম লিখেছেন। তন্মধ্যে ‘গাঁজার কল্কে’ প্রতিবেশীর পাঠকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ছদ্মনামে লেখা তাঁর প্রথম কবিতা ‘পথের সাথী’ ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিবেশীতে প্রকাশিত হয়। একসময় তিনি প্রতিবেশীতে বড়দিন সংখ্যায় দীনবন্ধু কর্মকার নামে ‘বড়দিন একটি যাতনা’ নামক একটি কবিতাও লিখেছিলেন। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লিখেন বাইবেলভিত্তিক উপন্যাস ‘অদম্য-আদিম’। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে লিখেন রহস্যোপন্যাস ‘কামিনী-কাঞ্চন’। এরপর প্রতিবেশীতে তার আরেকটি উপন্যাস ‘ইছামতির জোয়ার-ভাটা’ প্রকাশিত হয় যা সেসময় খ্রিষ্টাব্দে সমাজে বেশ সাড়া ফেলে। প্রতিবেশীতে তাঁর ‘রং বদলায়’ ও ‘অসমাপ্ত’ গল্প দুটিও প্রকাশিত হয়েছে।

পুস্তকাকারে প্রকাশিত তার বইগুলো হচ্ছে ‘শেষ প্রান্তর’ (নাটক), ‘সাম্প্রতিকের মহড়া’ (নাটক) এবং অদম্য-আদিম – ১ম খণ্ড (উপন্যাস)।

তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা লিখেছেন। এসব পত্রিকার মধ্যে আছে – মাসিক সওগাত, দিলরুবা, মেঘনা, মৃদঙ্গ, চলন্তিকা, রঙ্গম, জোনাকী, আবাহন, সাপ্তাহিক পাকিস্তানি খবর, সাপ্তাহিক জনতা, দৈনিক জেহাদ, দৈনিক ইত্তেহাদ, দৈনিক আজাদ, ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি ঢাকার প্রতিবেশী, পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরস্থ মিলনবীথি ছাড়াও বিভিন্ন যুব সংগঠনের মুখপত্র স্বজন, অনল, সুহৃদকন্ঠ, পদক্ষেপ, প্রতিধ্বনি, নিরমা, ইত্যাদিতে লিখে গেছেন। 

তাঁর রচিত অসংখ্য গানের মধ্যে ৩০টিরও বেশি গান গীতাবলীতে সন্নিবেশিত হয়েছে। তন্মধ্যে এবার ‘আমায় নাওগো প্রভু আপন করে নাও’; ‘ক্রুশ বয়ে ত্রাণপতি যায় গিরিপথে, বসে একাকী বিজন বনে কাঁদে প্রেমময় জীবন-স্বামী’, দয়া কর দীন বন্ধু; ইত্যাদি গানগুলো এখনো খ্রিষ্টীয় উপাসনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ম্যানিলা ভিত্তিক রেডিও ভেরিতাস-এর বাংলা প্রোগ্রামে তাঁর  বেশ কয়েকটি কথিকা প্রচারিত হয়েছিল।

সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে পুরানো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারস্থ সুহৃদ সংঘ থেকে ‘সুহৃদ পদক’ লাভ করেন। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে খ্রীষ্টান ছাত্র কল্যাণ সংঘ তাকে গুণী সংবর্ধনা প্রদান করেন। তাঁর সৃষ্টিশীল লেখার জন্য তিনি সাপ্তাহিক প্রতিবেশী প্রবর্তিত ‘গাঙ্গুলী সাহিত্য পুরস্কার’ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।

তিনি অর্থ, প্রতিপত্তি বা সুনামের জন্য লিখেননি বা লেখালেখি করে তাঁর কোন আর্থিক সংস্থানও হয়নি। দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ, মানুষের কল্যাণ কামনায়, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি অব্যহতভাবে লিখে গেছেন। সমাজের কু-প্রথা, কুসংস্কার, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি সদা সোচ্চার ছিলেন এবং তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন এর আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছিলেন।

ব্যক্তিজীবনে নিধন ডি’ রোজারিও ছিলেন সহজ-সরল, বিনয়ী ও স্বল্পভাষী স্বভাবের। লেখালেখি ছাড়াও তাঁর শখ ছিল কন্ট্রাক্ট ব্রীজ খেলা। এছাড়াও তিনি অন্যান্য খেলাধুলা বিশেষ করে ফুটবল অনুরাগী ছিলেন। যুবক বয়সে তিনি দারুণ বাঁশী বাজাতে পারতেন। তাঁর স্ত্রী প্রয়াত আগ্নেস ডি’ রোজারিও সর্বদা স্বামীর পাশে থেকে তাঁকে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের সংসারে তিন ছেলে (একজন প্রয়াত) ও চার মেয়ে।

নিধন ডি’ রোজারিও দূরারোগ্য ক্যান্সার ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৫ সালে ১০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। পুরানো ঢাকার ওয়ারী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

লেখক: নিধন ডি’ রোজারিও তনয়া

(লেখাটি বাংলাদেশ খ্রিস্টান লেখক ফোরামের পেজ থেকে নেওয়া হয়েছে)