শিরোনাম :
ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট বাবু মার্কুজ গমেজের সাক্ষাৎকার
কালের পথ ধরে ঢাকা ক্রেডিট উপনীত হয়েছে ৬৪ বছরে। ৬৫ বছরের পথে হাঁটছে বাংলাদেশে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। মানুষের শত আশা–আকাঙ্খার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। মানুষের স্বপ্ন পুঁজি করে, একটার পর একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সমবায়ের রোল মডেল হিসেবে ঢাকা ক্রেডিট। ২০১৪–২০১৯ সাল ঢাকা ক্রেডিটের একটি সোনালী অধ্যায়। সমিতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয় এবং মেগা প্রকল্পগুলো এই সময়েই আলোর মুখ দেখেছে। এই স্বর্ণালী সময়ের বাহক হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন বাবু মার্কুজ গমেজ। সমবায়ের ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ অনেক আগে থেকেই। তবে ২০০৮–২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্রেডিটে সেক্রেটারি ও ২০১৪–২০১৭ এবং ২০১৭–২০১৯ সাল পর্যন্ত (দুই মেয়াদে) প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। অভিজ্ঞতায় বলীয়ান প্রেসিডেন্ট বাবু মার্কুজ গমেজ বাংলাদেশের সমবায়ের ইতিহাসে সর্ব প্রথম ৩০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এর সঙ্গে মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ ও নার্সিং হোম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর তিনি শ্রেষ্ঠ সমবায়ী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ইতিমধ্যে যে প্রকল্পগুলো আরম্ভ করা হয়েছে তার মধ্যে আন্তর্জাতিকমানের চাইল্ড কেয়ার এন্ড এডুকেশন সেন্টার, রিসোর্ট এন্ড ট্রেনিং সেন্টার, সমবায় বাজার, সিকিউরিটি সার্ভিস প্রকল্প, গার্লস হোস্টেল, বান্দুরা বহুমুখী প্রকল্প ইত্যাদি। সমবায় আন্দোলনে এসব প্রকল্প সূচনা করে এক নতুন মাত্রা। সমবার্তার সাথে সরাসরি কথা বলেছেন তিনি। তিনি সহভাগিতা করেছেন সমবায়ের চ্যালেঞ্জ, করণীয় ও দিয়েছেন নানা দিকনির্দেশনা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমবার্তার নির্বাহী সম্পাদক রাফায়েল পালমা।
সমবার্তা: পঞ্চাশ জন সদস্য ও ২৫ টাকা মূলধন নিয়ে যে সমিতি ৬৪ বছর আগে শুরু হয়েছিল, আজ সেই প্রতিষ্ঠানের সদস্যসংখ্যা হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার এবং সম্পদ-পরিসম্পদের পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ওপরে। এই ইতিবাচক পরিবর্তনের কারণ কী?
প্রেসিডেন্ট: প্রথমত, ১৯৫৫ সালে ঢাকা ক্রেডিট যখন শুরু হয়েছিল, তখন খ্রিষ্টানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বেশি ভাল ছিল না। বিশেষ করে পুঁজির অভাব ছিল তাদের। সেই পুঁজির অভাব মেটানোর জন্য এবং অর্থনৈতিকভাবে স্ববলম্বী হত্তয়ার জন্য ঢাকা ক্রেডিটের যাত্রা শুরু। তখন ক্রেডিট ইউনিয়নের আন্দোলনের মাধ্যামে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিক্তিতে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিল এবং এই ঐতিহ্য ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। ফলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। যতটুকু মনে পড়ে ১৯৮৬ সালে (যখন স্বর্গীয় জন পি কস্তা ম্যাজোর ছিলেন) শেয়ার এবং ঋণদাণের পাশাপাশি সঞ্চয়ী প্রডাক্ট শুরু হয়। বিশেষ করে সঞ্চয়ী হিসাব খোলা বাধ্যতামূলক করা হয়। এতে সদস্যদের মধ্যে সঞ্চয়ী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। তাতে মূলধন সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই সঞ্চয়ী মনোভাব কার্যকর ভূমিকা রাখে। ২০০৫ সালে সমিতি ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করে। আমরা দেখতে পাই যে, ৫০ বছরে সমিতির সম্পদ-পরিসম্পদ হয়েছিল ৪৯ কোটি টাকা। পরবর্তী ছয় বছরে সম্পদ-পরিসম্পদের পরিমান দাঁড়ায় ১৮১ কোটি টাকায়। এটা সম্ভব হয়েছে মূলত বিভিন্ন সঞ্চয়ী ও ঋণ প্রডাক্ট সংযোজনের জন্য। তার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে সমিতির সদস্যদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত আর্থ-সামাজিক চাহিদাগুলোকে চিহ্নিত করে। বর্তমানে একজন সদস্যকে আর্থিক প্রয়োজন ও চাহিদা মেটানোর জন্য ঢাকা ক্রেডিটের মধ্যেই সম্ভব হচ্ছে। তাই আমি মনে করি, ঢাকা ক্রেডিটের এত বড় সাফল্য এবং এই ৬৪ বছরে অনবরত এর প্রবৃদ্ধি ঘটছে। দীর্ঘ এই সময়কালে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, যাঁরা নির্বাচিত ও কর্মী হিসাবে অবদান রেখেছেন, তাদের নিরলস প্রচেষ্টা ও সততার কারণে প্রতিষ্ঠান এই মহীরুহ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
সমবার্তা: ১৯৫৫ সালে যখন সমিতির যাত্রা শুরু হয়, সেই প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবস্থাপনা পরিষদের যে দর্শন ছিল, তা বর্তমানে কতটুকু অক্ষুন্ন আছে বলে আপনি মনে করেন? নাকি সমিতি সেই দর্শন থেকে দূরে চলে এসেছে?
প্রেসিডেন্ট: ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সমিতির যে দর্শন বা উদ্দেশ্য ছিল তা থেকে সমিতি কোনোভাবেই দূরে সরে যায়নি; বরং সেটাকে ধারণ করে আজকের বাস্তবতায় যে আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো আছে, সেগুলো মোকাবিলার জন্য ঢাকা ক্রেডিট কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, ১৯৫৫ সালে আমাদের সমাজে যে আর্থিক দৈন্যতা বা অস্বচ্ছলতা ছিল, এখনও তা আছে, তবে স্কেল ভিন্ন, প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সেই দর্শন থেকে আমরা মোটেও বিচ্ছিন্ন হইনি বা দূরে সরে যাইনি।
সমবার্তা: নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সমিতির পলিসি তৈরি ও পলিসির বাস্তবায়ন কীভাবে দেখেন?
প্রেসিডেন্ট: ঢাকা ক্রেডিট বা যেকোনো সমিতিতে যারা কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসেন, তাঁদের কাজ হলো পলিসি বা কর্মকৌশল নির্ধারন করা। সমিতি কীভাবে পরিচালিত হবে তার ভিত্তিতে ভিশন, মিশন ও কৌশলগত পরিকল্পনাগুলো তৈরি করে দেওয়া। সেখানে ঢাকা ক্রেডিটের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে পেশাদায়িত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য সমিতির কর্মকর্তাদের ডে-টু-ডে কাজে সম্পৃক্ত হওয়াটা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত মনে করি না। কারণ, ঢাকা ক্রেডিটের ব্যাপ্তি যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যে বিরাট সংখ্যক সদস্যকে সেবা দিচ্ছে, সেখানে দায়িত্বশীল-গুণগত পেশাদারিত্ব ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং, এখানে পলিসি তৈরি ও বাস্তবায়নের মধ্যে সহাবস্থান এবং কার কী দায়িত্ব তা বোঝা দুপক্ষের (কর্মকর্তা ও কর্মীর) জন্যই জরুরি। এটা অনেক ক্ষেত্রেই অভারলেপিং হয় এবং অনেক সময় আমরা সুশাসন দেখতে পাই না। কারণ, যারা পলিসি তৈরি করবেন, তারা যদি পলিসি বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত থাকেন, সেখানে একটি conflict of interest থেকেই যায় যা সুশাসনের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
সমবার্তা: গত এক দশকে সমিতি বড় বড় প্রকল্প নিয়ে মহাকর্মযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থানে এসে চ্যালেঞ্জগুলো কী? কীভাবে মোকবিলা করছেন?
প্রেসিডেন্ট: মূলত আমার সেক্রেটারি হিসেবে এক মেয়াদে ও পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই মেয়াদে সমিতিকে সেবা দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। যে বিষয়টি আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে, আমাদের ক্রেডিট ইউনিয়নে যে সকল কর্মী আছেন, তাদের একটি মাইন্ডসেট আছে। তা হলো- ঢাকা ক্রেডিট ঋণ দিবে ও ঋণের কিস্তি ফেরত নিবে। এর মধ্যেই সমবায়ের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকবে। লিডারদের মধ্যেও এমন মনোভাব আছে। কিন্তুু বর্তমান বাস্তবতায় আমরা সদস্যদের সুবিধার কথা চিন্তা করেই নানা সামাজিক প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগের পদক্ষেপ নিয়েছি।
যেহেতু আমাদের সব অর্থ ঋণে বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না, তাই ব্যবস্থাপনা কমিটির সমন্বিত আলোচনা ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গচ্ছিত অলস অর্থ বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করি। সেখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, এই ক্ষেত্রে যেসব পেশাদারী ও দক্ষকর্মী দরকার, তার বড়ই অভাব। পাশাপাশি সমবায়ের কর্মকর্তারা প্রতি তিন বছর পর সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসেন, এই ক্ষেত্রে অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী সমিতিতে আসতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হন। প্রতি তিন বছর পর পর র্বোড পরিবর্তন হওয়াতে পেশাদার কর্মীদের অনেকেই কমফোর্টেবল ফিল করেন না।
যদিও বিগত সময়ে আমরা চেষ্টা করেছি, আমাদের কর্মীদেরকে continuously দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির করতে। এখনও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এসব প্রকল্প কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য যে দক্ষতা বা পেশাদারিত্ব দরকার, সেগুলো নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আগামী দিনে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়ন আমাদের করতে হবে। কারণ, গতানুগতিক ক্রেডিট ইউনিয়নের ধারা অর্থাৎ শুধুমাত্র শেয়ার ক্রয় করে এবং ঋণ দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে সমিতিকে বেশিদিন sustain করা যাবে না।
প্রতিষ্ঠানের আকার বড় হচ্ছে এবং সে আকারে সদস্যদের স্বার্থরক্ষা না হওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং ইতিমধ্যে সদস্যদের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে সকল প্রকল্প আরম্ভ হয়েছে যেমন- আমাদের ছাত্রী হোস্টেল, জিম, স্কুল, রিসোর্ট-ট্রেনিং সেন্টার, সমবায় বাজার, সিকিউরিটি সার্ভিস ইত্যাদি।
বর্তমানে আমাদের ৩০০ শষ্যার হাসপাতাল হতে যাচেছ। সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি প্রকল্পের মাধ্যমেই আমাদের সদস্যরা উপকারভোগী হচ্ছেন। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। আপনারা জানেন আমাদের দেশে গতানুগতিক পড়াশোনার পর বেকারত্বের পরিমান উচ্চহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে ঢাকা ক্রেডিট, আমি মনে করি, এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বেকারত্ব ঘুচানোর ক্ষেত্রে একটি বড় অবদান রাখছে। আমাদের শ্লোগানের মধ্যেও আছে: ‘কর্মসংস্থান আমাদের লক্ষ্য; আত্মনির্ভরশীল সমাজ আমাদের স্বপ্ন’। বিষয়টিকে সামনে রেখে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যারা ভবিষ্যতে সমিতির দায়িত্ব নিবেন, এসবের মাধ্যমে তাদের জন্য আরো বেশি অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হবে।
যখন এসব প্রকল্প শুরু করেছিলাম, তখন বিভিন্ন মহল থেকে অনেক বাধা-সমালোচনা এসেছে। বর্তমানে ধীরে ধীরে প্রত্যকটি প্রকল্পের যৌক্তিতা প্রমান হচ্ছে। প্রত্যেক প্রকল্পই ধীরে ধীরে লাভজনক প্রকল্পে পরিণত হচ্ছে। সুতরাং, আগামীতে যারা সমিতির সেবা দিতে দায়িত্বে আসবেন, তারা কাজ করার একটি সুন্দর অনুকূল পরিবেশ পাবেন। ফলে তাঁরাও আরো বড় বড় প্রকল্প হাতে নিতে পারবেন। আমি সেই বিশ্বাসই করি।
সমবার্তা: প্রতিষ্ঠানের আকার বড় হলে ব্যক্তি-সদস্যের স্বার্থ কি ক্ষুন্ন হচ্ছে? কীভাবে?
প্রেসিডেন্ট: আমি মনে করি না প্রতিষ্ঠানের বড় হওয়ার সাথে ব্যক্তি-স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছে। বরং মনে করি প্রতিষ্ঠান যত বড় হচ্ছে, ব্যক্তি-সদস্যের স্বার্থ তত বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের স্বার্থ বেশি বেশি রক্ষা হচ্ছে। তারা অনেক diverse সেবা পাচ্ছে। আজ থেকে বিশ বছর আগে আমাদের মাত্র একটি অফিস ছিল। বর্তমানে আমাদের ঢাকা শহরে ৯টি বহুতল ভবন অফিস, ১১টি সেবাকেন্দ্র ও ১৯টি কালেকশন বুথ হয়েছে। তার মানে আমাদের সদস্যদের সেবা তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
কালীগঞ্জের একজন সদস্যকে এসে ঢাকার হেড অফিসে ঋণের আবেদনপত্র জমা দিতে হয় না, কালীগঞ্জেই সেবাসেন্টারে জমা দিয়ে ঋণ পেতে পারেন। টাকা উত্তোলনের জন্যও তাকে এখানে আসতে হয় না। আঠারোগ্রাম ও শুলপুর থেকে কোনো সদস্যকে এখানে আসতে হয় না। সেখানকার সেবাকেন্দ্রগুলোতেই তাদের প্রয়োজন মিটে যাচ্ছে। নারায়নগঞ্জ থেকেও আসতে হয় না, তাদের স্থানীয় জায়গায় বসেই হেড অফিসের সেবা পাচ্ছেন। বর্তমানে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও গাজীপুর জেলায় আমাদের কার্যক্রম কার্যকরভাবে চলছে। দেশের নানা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসব জেলায় আগত ও চাকরিরত খ্রিষ্টান জনগণ আমাদের সমিতির সদস্য হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে এবং উন্নয়নসেবা পাচ্ছে।
সমবার্তা: সমিতির অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ডিভইন মার্সি জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন? এই প্রকল্পের যুক্তিযুক্ততা কী? দুই শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে, সদস্যরা কীভাবে এই প্রকল্প থেকে লাভবান হবেন?
প্রেসিডেন্ট: ডিভাইন মার্সি জেনারেল হাসপাতাল শুধু ঢাকা ক্রেডিটের নয়, বাংলাদেশে সমবায় ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ইতিমধ্যেই এর কাজ শুরু করেছি। আমরা প্রথমে ঢাকা শহরে ছোট আকারে শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঢাকার স্থানটি মাত্র ১০ কাঠা হওয়ায় ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন না পাওয়ায়, পরে মঠবাড়ীতে ২৫ বিঘা জমি ক্রয় করে ৩০০ শয্যার এই হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছি। পরবর্তীতে মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ ও নার্সিং হোমের প্রজিশন রেখে হাসপাতালের কাজ শুরু করেছি।
আপনারা যদি দেখেন বাংলাদেশের বায়ুদূষণ, খাদ্যদূষণে শীর্ষে আছে। যার কারণে অধিকাংশ মানুষ ৫০ বছরের পরেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যেহেতু সবার স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা নেই বা সবাই সেই সুযোগ নিতে পারে না, তাই অধিকাংশ মানুষকে তার সারা জীবনের সঞ্চয় চিকিৎসা খাতে ব্যয় করতে হয়। ঢাকা ক্রেডিটের ৪০ হাজার সদস্য। তারা সবাই সমিতির স্বাস্থ্যবীমার আওতায় রয়েছে। একজন সদস্যকে স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ টাকা দিয়ে থাকি। এই বিষয়টাকে মাথায় রেখে আমরা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ধারণা শুরু করেছি যাতে আমাদের সদস্যরা যখনই অসুস্থ হয়, তখন তারা অর্থের জন্য আত্মীয়স্বজনদের কাছে বা অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে হাত পাততে না হয়। সে যেন সম্মানের সাথে তার চিকিৎসা সেবা, যেটা তার মৌলিক অধিকার সমাজের কাছে বা রাষ্ট্রের কাছে পাওয়ার, সেটা সুনিশ্চিত করার জন্য আমরা এই প্রকল্পটি নিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশে যতগুলো সমবায় সমিতি আছে, আগামী দিনে এই ডিভাইন মার্সি জেনারেল হাসপাতালের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে এবং তাদের সদস্যদের যাতে নির্ভাবনায় এখানে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা নিতে পারে তার জন্য ঢাকা ক্রেডিটের সাথে যুক্ত হবে। যেহেতু আমাদের অনেকেই মেডিকেল পেশায় আছে, বিশেষ করে নার্স, ডাক্তার, তাদের অনেকেই সময় ও মেধা দিয়ে হাসপাতালটি নির্মাণের ক্ষেত্রে নানাভাবে সহায়তা করছেন।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু সাধারণ মানুষ ও সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাই নয়, পাশাপাশি এর মাধ্যমে যে আয় করতে পারবো তা দিয়ে আমাদের সমিতির সদস্যদের সন্তানেরা যেন ডাক্তারী পেশায় সম্পৃক্ত হতে পারে তারও একটি সুন্দর সুযোগ হচ্ছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। কম খরচে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এই প্রকল্প একটি শক্তিশালী সমাজ বিনির্মাণে কাজ করবে।
সমবার্তা: সরকার আরোপিত সমবায়ের ওপর শতকরা ১৫ ভাগ আয়করের বিষয়ে মন্তব্য কী? এই ব্যাপারে সমবায় অধিদপ্তর থেকে সদস্যদের স্বার্থরক্ষার জন্য কতটুকু সহায়তা পচ্ছেন?
প্রেসিডেন্ট: ২০১৪ সালের অর্থবছরে সমবায় সমিতির আয়ের ওপর ফ্ল্যাটভাবে আয়কর নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সমবায়ের ওপর এই আয়কর ধার্য মরার ওপর খাড়ার ঘা। সমিতির নীট লাভের কমপক্ষে ২৮% বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্ন ফান্ডে স্থানান্তরের পর যদি ১৫% আয়কর দিতে হয়ে, তা সমিতির উন্নতি ও প্রসারকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করে। আমি বলবো এটা সমবায়ী নেতৃবৃন্দেরই ব্যর্থতা। কারণ, আমরা ঢাকা ক্রেডিট, কেন্দ্রীয় সমিতি কাল্বসহ জাতীয় যে সমবায় প্রতিষ্ঠান আছে তাদের সম্পৃক্ত করে আন্দোলন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে, সে সময় এর বাস্তবতা ও পরবর্তী পরিনাম বুঝতে না পারায় সেই আন্দোলন শক্তিশালী করা যায়নি, যার ফলে এখন প্রত্যেক সমবায় সমিতি আয়করের জালে আটকা পড়ে তাদের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, এই সমবায় সমিতি থেকে সরকারেরও যে খুব বেশি রাজস্ব আয় হচ্ছে, তাও না। সরকারের কাছে বিষয়টাকে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে সমবায়ী নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা রয়েছে। আমাদেরকে এটা অগ্রাধিকার ভিত্তিকে বিবেচনা করতে হবে। কারণ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সমবায়কে মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং এটা সবসময় আয়করমুক্ত ছিল। বিশেষ করে ডেসটেনি, ইউনিপে-টু, যুবক- এ ধরনের মাল্টিলেভেল প্রতিষ্ঠান সমবায়ের লাইসেন্স নিয়ে যে প্রতারণা করেছে, এ থেকে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, সমবায়ের অনেক টাকা আয় হয় বা আয়কর আরোপ করার মতো আয় এখানে (সমবায়ে) আছে। এটি একটি ভুল ধারণা। কারণ, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সমবায়ের সনদ বা অনুমতি নিয়ে কাজ করেছে কিন্তু তারা প্রকৃতপক্ষে সমবায় প্রতিষ্ঠান নয়।
সুতরাং এই বিষয়গুলো তুলে ধরে আমাদের যুক্তি প্রদর্শন করতে হবে। আমাদের সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সমবায় অধিদপ্তর কাজ করছে। কিন্তু এই সেক্টরে কর্মীর সংখ্যা একেবারেই কম। ব্যাংকে একজন কর্মী নিয়োগ দিতে গেলে কর্মী পাবেন, কিন্তু ক্রেডিট ইউনিয়নের কর্মী সেভাবে পাওয়া যায় না। কর্মী গঠনের জন্য তেমন কোনো প্রশিক্ষণের সেন্টার বা প্রশিক্ষণ-ব্যবস্থা নেই। এই জায়গাটিকে মনে হয় সমবায় অধিদপ্তর কাজ করতে পারে। আরেকটি বিষয়, সমবায়ে যখন আইন ও বিধি করা হয়েছে, তখন এটা ধরেই নেওয়া হয়েছে ৪০-১০০ জন সদস্যের একটি সমিতি হবে সমবায় এবং তা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতেই চলবে। সমিতি যে এত বড় হতে পারে, সেটা যে ৭ শ বা ১ হাজার কোটি টাকার প্রতিষ্ঠান হতে পারে, ১ হাজার কর্মীর প্রতিষ্ঠান হতে পারে, তা সেখানে বিবেচনা করা হয়নি। এই বিষয়গুলোর ওপর আমি মনে করি জোর দেওয়া উচিত।
সমবার্তা: এত বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরবর্তীতে যারা নেতৃত্বে আসবেন, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
প্রেসিডেন্ট: ঢাকা ক্রেডিট একটি বড় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এটাকে পরিচালনা দেওয়ার জন্য যোগ্য নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিতে গেলে তার ফাইন্যান্স ও একাউন্টস সমন্ধে যথেষ্ঠ অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন।
আমরা অনেকেই মনে করি, আমরা সংগঠন-ক্লাব করি এবং ক্রেডিট ইউনিয়নও তেমনি একটি সংগঠন বা ক্লাবের মতো প্রতিষ্ঠান। সমবায় সমিতি মূলত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তাই নেতৃত্বদানকারীদের ফাইন্যান্স ও একাউন্টস পলিসি তৈরির দক্ষতা থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁদের পড়াশোনা করে জেনে এই প্রতিষ্ঠানে ভাল নেতৃত্ব দিতে পারবেন। এতে তাঁরা বুঝতে পারবেন তাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো কী!
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্বাচন আসলে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগ্রহীরা প্রার্থী নিয়ে হাজির হন। তারা তাদের সমর্থকদের নিয়ে বিভিন্ন প্যানেলে যোগ দেন। এখানে আসলে কার কয়জন ভোটার আছে, সেটাই তাদের যোগ্যতা। মূলত তাদের ব্যক্তিগত ও সমবায়ভিত্তিক দক্ষতার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়। যার ফলে অনেক জায়গায় সুশাসনের অভাব দেখতে পাই। আমার একটি অনুরোধ থাকবে, যারাই সমবায়ে নেতৃত্ব দিতে চান, তারা সমবায়ের ওপর একটু পড়াশোনা করে সমবায়কে ভালমতো দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য যোগ্য হয়েই আসা উচিত।
সমবার্তা: মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য সমবার্তার পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রেসিডেন্ট: সমবার্তাকেও ধন্যবাদ।