ঢাকা ,
বার : রবিবার
তারিখ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৮ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

মন ঘুড়ি

0
667

সিনথীয়া ম্যাগডেলিন ক্রুশ

মন ভালো নেই, মনে অসুখ করেছে। মন ঘুড়িটার একটা কাঠি যে ভেঙে গেছে। শীতটা এখনো বিদায় নেয়নি অথচ খুব বৃষ্টি দেখতে ইচ্ছে করছে।

কলেজের মাঠটার সবুজ ঘাসে খালি পায়ে হেটে এসে গাছের তলাতে হেলান দিয়ে বসে দূরে তাকাতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম, সেদিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে, আমি মোহনা, তবে আমার ভালবাসার মানুষটি আমাকে মীরা নামে ডাকতো। তার নাকি মীরা নামটা অদ্ভুত লাগে। আমার এক ক্লাসমেটের কাছে শুনেছি মীরা নামের মেয়েদের নাকি কপাল মন্দ হয়, শুনে সে সময় খুব হেসেছিলাম। পলাশের সাথে আমার বন্ধুত্বটা কবে যে প্রেমে বদল হয়ে গিয়েছিলো তা টের পাইনি, তবে যখন টের পেলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভীষণভাবে ভালবাসতাম ওকে। প্রথম যেদিন পলাশ আমার হাতটি ধরে টেনে কাছে নিয়ে আস্তে করে বলেছিল ‘ভালবাসি’ সেদিন থেকেই আমার ভেতরের নারীটা পূর্ণরূপ পেয়েছিল, ভালবাসার অনুভূতিতে বিভোর হয়ে উঠেছিলাম। মনে হয়েছিল ওকে ছাড়া আমি একমুহূর্তও নিঃশ্বাস নিতে পারব না। ও যেটা বলতো অন্ধের মতো মেনে নিতাম।

একদিন হঠাৎ করে পলাশ কোথায় যেন হারিয়ে গেলো, সাথে নিয়ে গেলো আমার বিশ্বাস, আসা, স্বপ্ন। বিশ্বাসটা সেদিনই ভাঙলো যেদিন শুনলাম পলাশ আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নীলা পালিয়ে বিয়ে করে দেশের বাইরে চলে গিয়েছে। পলাশ চলে যাবার এক সপ্তাহ পর নীলাও চলে গেল আর এ সব আমার চোখের সামনেই হয়েছে অথচ আমার অন্ধ ভালবাসা সেটা দেখতে পায়নি।

চারিদিকে খুঁজতে লাগলাম ওকে। তাকিয়ে দেখি ও আমার মাথার কাছে বসে আছে, মাথার চুলগুলো উসকোখুসকো, চোখ দুটি লাল হয়ে আছে, হাতে বান্ডেজ। এই অবস্থায় ওকে দেখে খুব মায়া হচ্ছে।

প্রথম কয়েক মাস এক মায়াজালে ডুবেছিলাম, মনে হচ্ছিল বোধহয় মরেই যাব, জীবনটাকে ভীষণ ছন্নছাড়া মনে হচ্ছিল। যেদিকে তাকাচ্ছিলাম সে দিকটাই স্বার্থপর মনে হচ্ছিল। জীবন থেকে একটা বছর নষ্ট হলো আরকি তবে পুনরায় স্বপ্নবুনার ইচ্ছেটা মরে গিয়েছে কিন্তু নিজেকে সামলে নেওয়ার একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হলো। যাই হোক জীবন তো আর থেমে থাকে না, চলছেই।

কলেজ থেকে ফেরার পথে হঠাৎ মা ফোন করে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসতে বলল, বাড়িতে নাকি মেহমান আসবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কে? কিছু না বলে ফোনটা রেখে দিল। বাড়ি ফিরে দেখি আমি মনে মনে যা সন্দেহ করেছি তাই, ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছে। এ নিয়ে গতকয়েক দিনের মধ্যে ডজন খানেক হল। মনে মনে রাগে গজ গজ করছি কিন্তু সবার সামনে মাকে কিছু বলতেও পারছিনা। আমার ব্যপারটা মা জানে তারপরও…..।

অবশেষে পাত্রপক্ষ এলো আর আমি ফিটফাট হয়ে দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে গেলাম সামনে। সামনে তাকিয়ে অবাক চোখে দেখলাম অপুকে, আর বুঝতেও পারলাম অপুই পাত্র। পলাশের কাজিন অপু, আমি বেশ কয়েকবার ওকে পলাশের সাথে দেখেছি পলাশ তো বলেছিল অপু দেশের বাইরে চলে গিয়েছে কিন্তু….. কি করবো বুঝে ওঠতে পারছি না। ছেলে দেখতে খারাপ না, আসলে আমি কখনোও ওকে ভালো করে অবজার্ভ করিনি। এমনিতেই ছেলেটা কম কথা বলতো, আমাকে দেখলেই অন্যদিকে চলে যেতো, আর সে কিনা আমাকে বিয়ে করতে চায়, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি অপুর সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছি, কি করব বুঝতে পারছি না, তখন হঠাৎ করে অপুর মা অনুরোধ করল ছেলে-মেয়েকে একটু আলাদা কথাবার্তা বলতে দেয়ার জন্য, ব্যস আরকি পেয়ে গেলাম সুযোগ। আমাদের বারান্দার সোফায় দুজনকে বসিয়ে দিয়ে মা চলে গেল, যেই একা পেলাম অপুকে অমনি সাপের মতো ফস করে বললাম এই তুমি এখানে কি করছ, তোমার সাহস তো কম না, তোমার ভাই…. অমনি অপু আমার সামনে হাত জোড় করে মাথা নিচু করে বলল ‘সরি’। যেই ও আমার চোখের দিকে তাকালো দেখি ওর চোখ জোড়া ছলছল করছে পানিতে। আমি পাথর হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম, মুখদিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। আমাকে চুপ করিয়ে দিয়ে সে বলতে আরম্ভ করল,

– সরি, তোমাকে ভালবাসি বলে, সরি, ভালবাসি এই কথাটি তোমার সামনে কখনও বলা হয়নি বলে। আমি তোমাকে ভালবাসি পলাশ তোমাকে প্রপোজ করার বছরখানি আগে থেকে। তোমার বাসার পাশের ওই বাসায় আমি থাকতাম, এই বেলকুনিতেই আমি তোমাকে প্রথম দেখেছি, তোমরা এখানে আসার তিনমাস পর আমার বাবার সরকারি চাকরির জন্য আমরা বাসাটা বদল করি। কিন্তু তোমাকে ভুলতে পারিনি। অনেক কষ্ট করে তোমার কলেজ খুজে বের করেছিলাম। আমি চাকরি করতাম, তোমাকে দেখার জন্য সপ্তাহে একবেলা হাফ ছুটি নিয়ে এসে তোমার কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম, ভাগ্য ভাল থাকলে কখনও কখনও একঝলক দেখতাম আর না থাকলে মনে কষ্ট নিয়ে চলে যেতাম।

-আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে অপুর কথা শুনে, মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে আমরা দুজন ছাড়া এপৃথিবীতে আর কেউ নেই। ও বলতে থাকলো

-তোমাকে আমি প্রপোজ করব এর আগেই পলাশ তোমাকে প্রপোজ করে, যদিও ও জানতো ব্যাপরটা।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, পলাশ আমাকে একবারও ওর কথা বলেনি কেন?

-আসলে আমি পলাশকে তোমাকে দেখিয়ে বলেছিলাম যে, আমি মোহনাকে পছন্দ করি কিন্তু ও এমনটা করবে আমি ভাবতেও পারিনি। আমি তোমাকে সবকিছু বলে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু যখন শুনলাম তুমি ওকে ভালবাস তখন আমিই সরে গিয়েছি। আমার অফিস থেকে লন্ডন যাওয়ার অফার আসলো আর আমি হ্যাঁ বলে দিলাম কারণ আমার আর এখানে থাকতে মন চাইছিল না। বার বার পলাশের সাথে তোমাকে দেখা আমার কাছে খুবই কষ্টকর ছিল। গত সপ্তাহে পলাশ আমেরিকা থেকে আমার লন্ডনের বাসায় এসেছিল ওর ওয়াইফকে নিয়ে, বিশ্বাস কর আমি জানতাম না ও তোমার সাথে এমন করেছে। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও, তুমি এত কষ্টে ছিলে আমি তা এতদিন জানতে পারিনি। আজ দুবছর পরে তোমাকে এই অবস্থায় দেখব কখনো মনের অজান্তেও ভাবিনি। ব্যাপারটা জেনে আমি আর বসে থাকতে পারিনি। তোমার কাছে ছুটে এলাম। আমি জানি না এগুলো জানার পর তুমি আমার ব্যাপারে কী ভাববে। তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম আবার খুঁজে পেয়েছি, এর থেকে বড় আর কি আছে আমার কাছে। জানি না আমার কী হবে, তবে তুমি ছাড়া জীবনটার কোন একটা ভাগ অপূর্ণই থেকে যাবে সব সময়।

এই যুগে একটা মানুষের একতরফা ভালবাসা এমনও হয়? ছেলেটা পাগল নাকি? ছেলেটার কথা শুনে আমার গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। হঠাৎ যেন কানের কাছ দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল, আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলাম। ইতিমধ্যে মা এসে আমাদের নিয়ে গেল, চায়ের পর্ব শেষ করে অপুওরা চলে গেল। রাতে ঘুমাতে এসে বার বার অপুর ছলছল করা চোখ দুটি চোখের সামনে ভেসে আসছিল, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে, জানি না কেন। সারারাত ঘুমাতে পারিনি।

এর দুদিন পর মা আমাকে ডেকে বলল, প্রেম করেছিস, কিছু বলিনি, যা হয়েছে তার কথা আর তুলতে চাই না, এবার আমাদের কথাও একটু ভাব। আমি আর তোর বাবা চাই আমাদের পছন্দের ছেলের সাথে তোর বিয়ে দিতে। অপু ছেলেটাকে আমাদের পছন্দ, এমনিতে অনেক সময় দিয়েছি এবার আর দেরি করতে চাই না। আজ সকালে ওরা ফোন করে জানতে চেয়েছে আমাদের সিদ্ধান্ত, তোর বাবা “হ্যাঁ” বলে দিয়েছে। আমি অবাক চোখে মার দিকে তাকিয়ে রইলাম আর মা বকবক করতে করতে চলে গেল। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

আজ পহেলা ফাল্গুন, সকাল সকাল মা তার সুন্দর হলুদ শাড়িটা আমাকে দিয়ে বলল, শাড়িটা পড়েনে, অপু আসছে, তোকে বাইরে নিয়ে যাবে। আমি না শোনার ভান করে কাথামুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলাম। মাও নাছোড়বান্দা ঘরে এসে একটানে কাঁথাটা নিয়ে চলে গেল। এত রাগ হচ্ছিল….

রেডি হলাম, অপু এসে আধঘন্টা যাবত অপেক্ষা করছে, আমি ইচ্ছে করে দেরিটা করলাম। শেষে মার পিড়াপিড়িতে বের হলাম। অপু বাইরে এসেই হাত বাড়িয়ে একগুচ্ছো গাঁদা ফুল আমার সামনে ধরে বলল, তোমার জন্য। আমি ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফুলগুলো নিলাম। ও বলল, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে হলুদ শাড়িতে তবে যেদিন তুমি নীল শাড়ি পড়ে কলেজে গিয়েছিলে সেদিন আমি মুগ্ধ চোখে বার বার তাকাচ্ছিলাম, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না, ওইদিন থেকে আমি তোমার নাম রেখেছি মোহিনী। অপুর কথা শুনে এই মুহূর্তে আমার বুকের ভেতর দিয়ে একটা বিদ্যুৎ চমকে গেল।

আজ দুজনে ঘুরলাম কিছক্ষণ, অপুর সরল চেহারার হাসি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। পিছনের কোন কথা আর বলতে ইচ্ছে হলো না। ছেলেটা খারাপ না, কিন্তু বিয়ে নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে। ওকে কি হ্যাঁ বলব নাকি না বলে দিব? ও আমাকে বলেছে আমার যে সিদ্ধান্তই হোক না কেন ও মেনে নিবে। না, ছেলেটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে!

আমরা রিক্সাতে ফিরছি আচমকা একটা বাইক এসে আমাদের রিক্সাটাকে ধাক্কা দেয়। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম এরপর আর কিছু মনে নেই। চোখ খুলে দেখি আমি হাসপাতালে, ভীষণ ব্যাথা পেয়েছি। আর অপু! চারিদিকে খুঁজতে লাগলাম ওকে। তাকিয়ে দেখি ও আমার মাথার কাছে বসে আছে, মাথার চুলগুলো উসকোখুসকো, চোখ দুটি লাল হয়ে আছে, হাতে বান্ডেজ। এই অবস্থায় ওকে দেখে খুব মায়া হচ্ছে। এর মধ্যে সবাই চলে এসেছে। দুদিন হাসপাতালে থাকার পর বাড়ি এলাম।

কিছুদিন পর অপু আমাকে ফোন করে আমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইল।

আমি অনেক ভাবলাম, ভালবেসেতো শুধু ধোকাই খেলাম। এবার না হয় অপুর ভালবাসাতেই ভরসা করি। আমার মন ঘুড়িটার ভাঙা কাঠি ফেলে দিয়ে নতুন কাঠি জুড়ে আরেকবার আকাশে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। ক্ষতি কী তাতে….