ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ফিচার চাকরিজীবী থেকে ব্যবসায়ী

চাকরিজীবী থেকে ব্যবসায়ী

0
1006

হিমেল রোজারিও || ঢাকা
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে আর্থিক কারণে কলেজে প্রবেশ করতে পারেননি রিগেন। পারিবারে অস্বচ্ছলতার কারণে তিনি এসএসসি পাস করার পরেই চাকরির খোঁজে ঢাকায় আসেন। প্রথমে চাকরি করেন রেস্টুরেন্টে, পরে ঢাকার বিভিন্ন বারে (পানশালায়)। এভাবে চাকরি করে দশ বছর অতিবাহিত করেন। এর পর বিভিন্ন মানুষের অনুপ্রেরণা এবং সাহায্য-সহযোগিতায় চাকরি থাকা অবস্থায়ই শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। বলা যায়, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেব অনেকটাই সার্থক তিনি।
রিগেনের জন্ম নাটোর জেলার বড়াইগ্রামের ভবানীপুর গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন গ্রামের সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার প্রাথামিক বিদ্যালয়ে। আশেপাশে কোনো ভালো স্কুল না থাকায় প্রায় চার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতেন স্কুলে। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তিনি এসএসসি পাস করেন। অভাবের সংসারে চার ভাই ও এক বোন থাকার কারণে পড়াশোনায় কোনো ভাই-বোনই পড়াশোনায় বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি।
রিগেনের কাছে চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, চাকরির মূল বেতনের পাশাপাশি অনেক সময় দেখা গেছে কাস্টমারদের ভালো সার্ভিস দেওয়ার কারণে প্রায় প্রতিদিনই ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা টিপস পেতেন। মাস শেষে দেখা গেছে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বেতন হয়ে যেতো।
অন্যের অধীনে চাকরি করলে নিজের স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকে না। বেতন যত বেশিই হোক না কেন! অনেক সময় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারতেন না। শরীর খারাপ থাকলেও অনেক সময় ছুটি পাওয়া যায় না। অনেক কষ্ট করে কাজ করতে হতো।
রিগেন জানালেন, যে টেবিলে তিনি পরিবেশন করতেন, সেই টেবিলে কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রায়ই বসতেন। একসঙ্গে তারা কাপড়ের ব্যবসা করেন। তাদের মধ্যে কেউ কাটিংয়ের, কেউ সেলাইয়ের, কেউ ধোলাই করার কাজ করেন। সেই ব্যবসায়ীদের সাথে ভালো সম্পর্কের কারণে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যার আপনারা তো ব্যবসা করেন। কীভাবে ব্যবসা করে? আমাকে ব্যবসা করা শেখাবেন?’
তখন তাদের মধ্যে কবির শিকদার নামে একজন একদিস তার অফিসে যেতে বললেন। ‘পরে ঠিকানা নিয়ে চলে যাই কবির ভাইয়ের অফিসে। কবির ভাই একটি দোকানের মালিকের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি সেই দোকানিকে বলেন, রিগেন আপনার কাছ থেকে যত পিছ কাপড় চায়, আপনি প্রদান করবেন। যদি টাকা প্রদান না করে সেই দায়িত্ব আমার।’
নিজের জীবন-সংগ্রামের বিষয়ে ৩৬ বছর বয়সী রিগেন বলেন, ‘এরপর থেকে আমি প্রথমে ছোট ছোট লটে কিছু প্যান্ট ক্রয় করি। বিভিন্ন প্যান্টের দোকানে গিয়ে প্যান্ট বিক্রয়ের চেষ্টা করি। ধীরে ধীরে আমার প্যান্ট বিক্রির পরিমাণ বাড়তে থাকে। রাতে চাকরি করি এবং দিনের বেলায় প্যান্ট বিক্রয় করার চেষ্টা করি।’

আরো পড়ুন: পাগাড়ের তরুণ উদ্যোক্তা জনির গল্প
রিগেন জানান, প্রথমে তিনি রেপিমেড প্যান্ট ক্রয় করতেন। পরে কবির ভাইয়ের পরামর্শে থান কাপড় ক্রয় করে এক ফ্যাক্টরিতে সেলাই করে, অন্য স্থানে আয়রণ করে বিক্রয় করা শুরু করলেন। এতে লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। কবির ভাইয়ের কথায় তা-ই করতে শুরু করলেন। রিগেন বললেন, ‘এতে মাসে আমি ৩ থেকে ৪ হাজার পিস প্যান্ট বিক্রি করতে পারি।’
রিগেনের ব্যবসায়ের আকার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। লাভের পরিমান বৃদ্ধির কারণে চাকরি ছেড়ে দেন।


বিভিন্ন উন্নয়মূলক কাজ করার জন্য চাকরিরত অবস্থায়ই রিগেন ঢাকা ক্রেডিট থেকে ঋণ নিয়ে বাড়িতে তার বাবা-মায়ের কাছে পাঠাতেন। অন্যদিকে ঢাকা ক্রেডিটের ঋণ তার ব্যবসা বৃদ্ধিতে অনেক বড় সহায়ক ছিল। তিনি বলেন, ‘চার বছর ধরে প্যান্ট ক্রয় করে বিক্রয় করেছি। যদি একটি নিজের ফ্যাক্টরি থাকে, তাহলে প্যান্ট তৈরিতে খরচ অনেক কম হবে এবং মুনাফা আরো বেশি হবে। তাই দুই বছর আগে ঢাকা ক্রেডিট থেকে সাত লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে নিজ উদ্যোগেই একটি ছোট পরিসরে প্যান্টের ফ্যাক্টরি তৈরি করি। এই ফ্যাক্টরি কুড়িল বিশ^রোডের জোয়ার সাহারা এলাকায়। বর্তমানে সেখানে ১২ জন কর্মী কাজ করছে।’ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম আরপি প্যান্ট হাউজ।
দুই বছর ধরে প্যান্ট তৈরি করার পরে নিজের বাসায় প্যাকিংয়ের কাজ করছেন রিগেন। চলিত বছরের ১ ডিসেম্বের হতে জোয়ার সাহারা এলাকার মেম্বার বাড়ি গেটে একটি অফিস ভাড়া নিয়েছেন তিনি। অফিসে গিয়ে দেখা যায় কয়েকজন কাস্টমার এসেছে প্যান্ট ক্রয় করার জন্য। রিগেন মূলত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে ছোট ছোট লটে প্যান্ট পাইকারি বিক্রয় করেন। তারা পেমেন্ট করেন নগদে। খুব বিশ্বস্ত এবং পুরোনো কাস্টমারদের কাছে মাঝে মধ্যে বাকিতে বিক্রয় করে থাকেন। এতে করে ঝুঁকির পরিমাণ কমে যায়।
প্যান্ট ব্যবসায়ে ঝুঁকির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে রিগেন বলেন, ‘ব্যবসায়ের শুরুতে আমাকে কয়েক লক্ষ টাকা লোকাসান গুণতে হয়েছে। কারণ, তখন প্যান্ট বা কাপড় ভালো মতো চিনতাম না। অভিজ্ঞতা কম ছিল। মূলত কাপড় ক্রয় করলে লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
‘এখন আমার ব্যবসায়ে লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। ভালোমানের কাপড় ক্রয় করতে পারলে লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। সেই সাথে ফ্যাক্টরির কর্মীদের সাথে ভালো ব্যবহারের কারণে অনেক সময় অসম্পূর্ণ কাজ সহজেই সম্পন্ন করানো যায়। কাজ এগিয়ে যায়।’
আরো পড়ুন: অনলাইনে কাজ শিখিয়ে ৩০০ জনের বেকারত্ব দূর করেছেন সুবীর নকরেক

বর্তমানে রিগেন ঢাকা শহরে প্যান্ট সাপ্লাইয়ের পাশাপাশি বগুড়া এবং ময়মনসিংহ শহরে প্যান্ট সাপ্লাই দিয়ে থ কেন। সেই সাথে ঢাকায় নিয়মিত ভালো কিছু কাস্টমার পেয়েছেন। নিজের ফ্যাক্টরিতে প্যান্ট সেলাইয়ের পাশাপাশি অন্য কোম্পানির প্যান্ট সেলাইয়ের অর্ডার নিয়ে কাজ করেন তিনি। এতে করে এখন আর তার লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা নাই। তিনি বলেন, ‘এই ব্যবসা করে চাকরির চেয়ে অনেক ভালো এবং শান্তিতে আছি।’
ঢাকা ক্রেডিটের ঋণের সুবিধার কথা বলতে গিয়ে রিগেন বলেন, ‘চাকরিরত অবস্থায় আমি ঢাকা ক্রেডিট থেকে ঋণ গ্রহণ করি। ঢাকা ক্রেডিটের ঋণ আমার ব্যবসায়ের দুর্দিনের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। লেনদেন নিয়মিত থাকার কারণে আমার ঋণ পেতে কখনোও কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। তেমনি যারা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতে আগ্রহী তারা ঢাকা ক্রেডিট হতে ঋণ গ্রহণ করেন এবং সময়মতো কিস্তি প্রদান করে উন্নয়নমূলক কাজ করে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারেন।’
রিগেন একসময় অন্যের অধীনে কাজ করতেন। আজ সেই রিগেন তার ফ্যাক্টরি বড় করার জন্য একটি ভবনে জায়গা ভাড়া নিয়েছেন। আগামী কয়েক মাসের মধ্য কাজ শুরু করবেন। সেখানে ফ্যাক্টরির আকার ও কর্মীসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। একই সাথে ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য ঢাকা ক্রেডিটের ঋণ সহয়তা কামানা করছেন রিগেন।
ব্যবসায়ের পাশাপশি শুরু করেছেন সংসার জীবন। বর্তমানে তিনি দুই ছেলে সন্তানের জনক। ছেলে দুটি ঢাকা ক্রেডিট ইউনিয়ল স্কুলে লেখাপড়া করছে। গ্রামে রয়েছে বৃদ্ধ বাবা-মা। বাবা-মায়ের ভরণপোষণের যাবতীয় খরচ প্রতি মাসে পাঠান রিগেন।

আরো পড়ুন: ঘরে বসে অনলাইনে আয় করছেন খ্রীষ্টিনা