ঢাকা ,
বার : মঙ্গলবার
তারিখ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা দেশ যে কারখানায় ৮ হাজার শ্রমিককে খাবার দেওয়া হয় বিনামূল্যে

যে কারখানায় ৮ হাজার শ্রমিককে খাবার দেওয়া হয় বিনামূল্যে

0
841

ঘড়ির কাঁটা বেলা ১২টায় পৌঁছানো মাত্রই সব ব্যস্ততা ছুটি নিলো কারখানার। শ্রমিকরা একে একে পৌঁছতে শুরু করলেন ডাইনিং-এ। সারিবদ্ধভাবে প্লেটে নিতে শুরু করলেন সবজি, মাংস। তারপর যে যেখানে জায়গা পাচ্ছেন, সেখানে বসেই খাচ্ছেন ও গল্প করছেন। এদৃশ্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই ধামরাইয়ে সারা’র মাদার ব্রাঞ্চ স্নোটেক্স আউটারওয়্যারে নিত্যদিনই দেখা যায়।
টিফিন বক্স ছাড়াই প্রতিদিন অফিসে আসেন অন্তত ৮ হাজার শ্রমিক। দুপুরে খাবার খান অফিসেই। সাড়ে ৮ হাজার কর্মীর মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থা করা হয় প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব অর্থায়নে। কর্মীদের খাবারের পেছনে ব্যয়কে কোম্পানির জন্য ইতিবাচক বলেই মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি। স্নোটেক্সের দায়িত্বশীলদের মতে, কর্মীরা ভালো খেতে পারলেই সুস্থ থাকবে।
ডাইনিংয়ে পরিবেশিত খাবার স্বাস্থ্যসম্মত। খাবার পরিবেশনের আগে নিরীক্ষা করা হয় নিজস্ব ল্যাবে। তারপর করা হয় বিতরণ। খাবারে পার্থক্য নেই কোনও পদ অনুযায়ী, একই খাবার থাকে সবার জন্য।
এত মানুষের বিনামূল্যে খাবার আয়োজনের চিন্তা কিভাবে এলো জানতে চাইলে স্নোটেক্সের এমডি এস.এ.খালেদ বলেন, ‘তারা সেই সকালে খাবার বাসা থেকে আনে, সে খাবারটা দুপুর পর্যন্ত রাখলে পুষ্টিমান ঠিক থাকে না। আবার বাসা থেকে খেয়ে আসাও কষ্টকর। আমরা যদি এখানে খাবারের ব্যবস্থা করি, ওরা ওদের ব্রেকের ১ ঘন্টার ১০-১৫ মিনিটে খেয়ে নিয়ে বাকি সময় বিশ্রাম করতে পারে। এই বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাবার স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। ওদের প্রতি এইটুকু দৃষ্টি দেওয়াকে আমরা নিজেদের দায়িত্ব মনে করি।’
প্রতিদিনই শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার জন্য রান্নার আয়োজন করা হয়। খাবারের তালিকায় ভাত, মাছ, শাক-সবজি, ডাল মুরগি ও ডিম থাকে। সপ্তাহে প্রতিদিন ভাত, ডাল ও সবজি, একদিন মাংস, একদিন ডিম ও একদিন স্পেশাল খিচুড়ি। বছরের প্রথম দিন কর্মীদের খাওয়ানো হয় বিরিয়ানি।
ডাইনিংয়ে খাবার খেতে আসা জিপিকিউসি আল মামুন বলেন, ‘আগে বাসায় গিয়ে খেয়ে আসতে কষ্ট হতো, ক্লান্তি আসতো। এখন খাবার খেয়ে বিশ্রাম করতে পারি। খাবারের মান-স্বাদ দুইটাই ভালো।’
ডি ফ্লোরে কাজ করেন সুমি। তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে কাজ করতাম খাবার পেতাম না। এখানে খাবার দেওয়া হয়। খাবারের মানও ভালো। গরম খাবার খাওয়ার পর কাজেও মন বসে।’
স্নোটেক্স আউটারওয়্যারের সাত তলায় ডাইনিং। ডাইনিংয়ে লম্বা বেসিনে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও হাত ধোয়ার পানির ব্যবস্থা। হুড়োহুড়ি ছাড়াই লাইনে দাঁড়িয়ে শ্রমিকরা নেন সবজি এবং ডিমের ঝোল বা মাংস। তরকারি নিয়ে যে যেখানে জায়গা পাচ্ছেন সেখানেই বসে যাচ্ছেন। প্রতিটা টেবিলেই আছে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত ও ডাল। যতখুশি নেওয়া যাবে ভাত ও ডাল। খাওয়া শেষে প্লেট ধোয়ার জন্যও আছে নির্দিষ্ট জনবল।
ডাইনিং এর দায়িত্বে থাকা সহকারী পরিচালক জয়নুল হোসেন বলেন, ‘মোট ৫ ব্যাচে আমরা খাওয়ানো সম্পূর্ণ করি, প্রতি ব্যাচে ১৪০০ জন একসাথে বসে। প্রতিটা ডেকের খাবার খাওয়ানোর আগে ল্যাবরটরিতে মাইক্রোবাইয়োলজিস্ট চেক করে নেন। এছাড়াও আমাদের কোয়ালিটি টিম খাবার ও কাঁচামালের মান যাচাই করে।’
স্নোটেক্সের আউটারওয়্যারে আছে সবজি ও ফুল বাগান, সবুজ মাঠ, খেলাধুলার জন্য প্লে-গ্রাউন্ড, বাঁধানো পুকুর। এছাড়াও কর্মচারীদের শিশুদের জন্য আছে ডে-কেয়ার।
এতবড় আয়োজন কীভাবে করেন জানতে চাইলে প্রধান বাবুর্চি আব্দুর সবুর একগাল হেসে বলেন, ‘আমার সাথে আরও ২৫ জন আছে। প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে কাজ শুরু করি। আগের দিনই সবজিগুলো প্রসেস করে রাখা হয়। ১১টা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে রান্না শেষ করে ডাইনিংয়ে আনি। এখানে ৫ বছর কাজ করছি, খুব ভালো লাগে স্নোটেক্স। এখানে একই খাবার ক্লিনার যেমন খান, এমডিও খান।’
মাইক্রোবাইয়োলজিস্ট রাকিবুর রহমান বলেন, ‘আমি ১ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। প্রত্যেক দিনই প্রতিটা কন্টেইনার থেকে স্যাম্পল এনে সার্ভের আগে টেস্ট করা হয়। মূলত প্রেস্টিসাইড ডিটেকশন কার্ড ও ইউএসএ থেকে আমরা একটা কিট আনি যা দিয়ে পয়জন আছে কিনা দেখা হয়।’
স্নোটেক্স আউটওয়্যারের প্রবেশ ফটকের ডান পাশে ডে কেয়ার। ডে কেয়ারে দেখা মিললো ৪ বছর বয়সী বায়েজিদ ব্যস্ত বল খেলতে। বায়েজিদের সাথে আরও আছে ৩ বছর বয়সী তামিম ও রাফিদ, ২ বছর বয়সী লামি। রাফিদ-লামিদের মা কারখানায় ব্যস্ত সময় পার করলেও ডে কেয়ারে ইলোয়ারা আপাদের সাথে আনন্দের সময় কাটছে তাদের। সকাল থেকে তাদের খাওয়া-গোসল সবই ডে কেয়ারে। কেয়ার গিভার ইলোয়ারা জামান বলেন, ‘ডে কেয়ারে আমরা দায়িত্বে আছি তিন জন। বাচ্চাদের খাওয়া-ঘুম সবকিছুই আমরা দেখি। ওদের দুধ-সুজি থেকে ওষুধ কোম্পানি থেকেই দেওয়া হয়।’
শ্রমিকদের পিছনে এত ব্যয় করেও লাভবান হচ্ছেন কী করে এমন প্রশ্নের জবাবে স্নোটেক্সের এমডি এস.এ খালেদ বলেন, ‘এখানে যারা কাজ করছে তাদের জন্য ভালো একটা কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের উদ্দেশ্য। লেবার ল অনুযায়ী সকল সুবিধা নিশ্চিত করার পরও আমরা ফ্রিল্যান্স দিই, প্রভিডেন্ট ফান্ড দিই। এ বছর পারফর্মেন্সের উপর ১৫% শেয়ার দেওয়া হবে লাভের। এতে আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ে, আমরা বায়ারকে একটু কমে দিতে পারি। মূলত, সবার ভালোবাসার পাশাপাশি শ্রমিকদের শ্রমেই আমরা এতদূর আসতে পেরেছি। সেটি ভুলে গেলে চলবে না।’

সৌজন্য: বাংলা ট্রিবিউন