ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৮ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ফিচার ঋণ খেলাপি রোধে সমবায় সমিতিগুলোর উদ্যোগসমূহ

ঋণ খেলাপি রোধে সমবায় সমিতিগুলোর উদ্যোগসমূহ

0
859

সুমন কোড়াইয়া ।। ডিসিনিউজ

সমবায় সমিতিগুলোতে ঋণ খেলাপি যেন মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে সমিতিগুলোর কর্মী ও ব্যবস্থাপনার সাথে যাঁরা জড়িত, তাঁরা চেষ্টা করছেন কীভাবে এই খেলাপি কমানো বা রোধ করা যায়।

বিভিন্ন সমিতি বিভিন্ন উদ্যোগ বা পদ্ধতি অবলম্বন করছে। চলুন দেখা যাক কয়েকটি সমবায় সমিতির ঋণ খেলপি রোধে কী কী উদ্যোগ নিচ্ছেন যা তাঁদের জন্য ফলপ্রসু।

মাঠ কর্মীর বাড়ি পরিদর্শন: ঢাকার মগবাজারস্থ দি মনিং স্টার কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি: এর শতকরা একভাগের কম সদস্য ঋণ খেলাপি। এর কারণ হিসেবে সমিতিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলফন্স পংকজ গমেজ জানান যে তাঁদের সমিতির প্রতি ৪০০ জনের জন্য একজন মাঠকর্মী আছেন। মাঠকর্মী প্রতিদিন অফিসে এসে যাঁরা ঋণ নিয়েছেন তাঁদের তালিকা নিয়ে ঋণ গ্রহণকারীদের বাসায় বাসায় গিয়ে বর্তমান মাসের ঋণের কিস্তি, সুদ, শেয়ার ও সঞ্চয়ের টাকা ফেরত/জমা দেয়ার জন্য তাগাদা দেন। এতে ঋণ গ্রহণকারীরা প্রতিমাসে ঋণ ফেরত দেন। এছাড়া তাঁদের রয়েছে শক্তিশালি মনিটরিং বিভাগ। সেখান থেকে সকল কাজ সঠিকভাবে মনিটরিং করা হয়। বিশেষভাবে যাঁরা ঋণ নিয়েছেন, তাঁরা তা সময় মতো দিচ্ছেন কিনা তা সফট্ওয়্যারে দেখা যায় এবং কর্মীদের সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়। মাঠকর্মীরা প্রতিদিন তালিকা অনুসারে সমিতির সদস্যদের সাথে দেখা করেন বা কথা বলেন। সদস্যদের নিকট থেকে টাকা কালেকশনও করেন।

বিশেষ বিবেচনা (কার্ড সিস্টেম): ঢাকা ক্রেডিটের এই পদ্ধতিটি বেশ ফলপ্রসু। দীর্ঘদিন ধরে সমিতির যেসব সদস্য ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না, ফলে বেড়ে যাচ্ছে সুদ ও জরিমানা, তাঁদের জন্য রয়েছে স্পেশাল কনসিডারেশন (কার্ড সিস্টেম)। ঢাকা ক্রেডিটের লোন ইনভেস্টিগেশন এন্ড রিকোভারি বিভাগের এ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার ইনচার্জ রিচার্ড রোজারিও সমবার্তাকে বলেন, কার্ড সিস্টেমের মাধ্যমে সমিতির ঋণ খেলাপি রোধ করা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না, তাঁরা বেশি এই সুবিধা নিচ্ছেন। যেমন ধরুন: রতন গমেজ (প্রকৃত নাম নয়) দীর্ঘ ছয় মাস বা এর চেয়ে বেশি সময় ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। তিনি যদি এখন ঋণের কিস্তি দিতে যান তাঁর এক সাথে ঋণ ফেরত, সুদ ও জরিমানাসহ বড়ো অংকের একটা টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি যদি কার্ড সিস্টেমের সুবিধা নেন তাহলে তাঁর জমা হওয়া সুদ ও জরিমানা ফ্রিজ করে রাখা হবে। তিনি আগে যেভাবে নিয়মিতভাবে কিস্তির টাকা ও সুদ দিতেন সেভাবে কিস্তি দিতে পারবেন। ফলে তাঁর জমে থাকা সুদ ও জরিমানা সমিতিতে বর্তমানে দিতে হবে না। তবে রতনকে বর্তমানে থাকা ঋণ পরিশোধ করে তারপর সুবিধা মতো কিস্তিতে ফ্রিজ থাকা সুদ ও জরিমানা পরিশোধ করতে হবে এবং সেই সময় তাঁর নিকট হতে কোনো সুদ নেওয়া হবে না। আরেকটি সুবিধা হলো: কার্ড সিস্টেমে ছয় মাস নিয়মিত জমা দিলে তাঁর জামিনদারগণ নিয়মিত হিসেবে গণ্য হবেন এবং চাইলে ঋণ নিতে পারবেন। আপনি বা আপনার আত্মীয়-স্বজন যদি হয়ে থাকেন ঢাকা ক্রেডিটের সদস্য এবং দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা ক্রেডিটের ঋণ খেলাপি, তাহলে আপনি বা আপনার আত্মীয়-স্বজন এই সুবিধা নিতে পারেন।

কর্মকর্তাদের ঋণ খেলাপিদের বাড়ি পরিদর্শন: নাটোরের বড়াইগ্রামের বনপাড়া খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি: এই উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। সমিতির চেয়ারম্যান সুব্রত গমেজ জানান, তাঁরা কর্মকর্তাগণ মাসের শুরুতে ও মাসের শেষে বিভিন্ন গ্রামে ঋণ খেলাপিদের বাড়ি পরিদর্শন করেন। তাঁদের সমস্যার কথা শুনেন, পরামর্শ ও উৎসাহিত করেন। এতে ভালো সাড়া পাচ্ছেন তারা। অনেক অনিয়মিত সদস্য নিয়মিত ঋণ ফেরত দিচ্ছেন। সদস্যগণ ঋণ পরিশোধের বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন। অনেকে ঋণের কিস্তিও তাঁদের নিকট দিয়ে দেন। এছাড়া এই সমিতির রয়েছে গ্রাম ভিত্তিক ঋণ আদায় কমিটির তালিকা। কমিটির সদস্যরাও বাড়ি পরিদর্শন করে ঋণ ফেরত দেওয়ার জন্য পরামর্শ ও উৎসাহ দেন।

খেলাপি সদস্যদের সাধ্য মতো কিস্তি ফেরত: করোনায় বিপর্যস্ত নি¤œ আয়ের মানুষ। বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতির সদস্যরাও তাঁর বাইরে নয়। এই সমিতি করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খেলাপি সদস্যরা যেন সাধ্য মতো ঋণ ফেরত দেন তার উদ্যোগ নিয়েছে। সমিতিটির কর্মী নিত্য অধিকারী সমবার্তাকে বলেন, ‘আমাদের অনেক সদস্য করোনায় অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকে গ্রামে চলে গেছেন। আমরা যেন বিতরণ হওয়া ঋণ ফেরত পাই তাই কর্মীদের বাড়িতে বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছি। তাঁদের অনুরোধ করছি তাঁরা যা পারেন সেটাই যেন আমাদের ফেরত দেন। এভাবে আস্তে আস্তে আমরা ঋণ ফেরত পাচ্ছি।’

‘ছবিসহ খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করলে তাঁরা সামাজিকভাবে সচেতন হন এবং এই ম্যাগাজিনগুলো প্রায় সব চার্চ, সমিতি, এনজিওগুলোতে পাঠাই যেন তারা দেখতে পারে কে কে খেলাপি আছে।’ এই পদ্ধতিতে প্রতি বছর অনেক খেলাপি সদস্যরা ঋণ নিয়মিত ফেরত দিচ্ছেন বলে তিনি জানান।

ঋণ খেলাপিদের ছবি প্রচার করা: এটি খুবই কার্যকরি পদ্ধতি বলে জানিয়েছেন মগবাজারস্থ ঢাকা বহুমুখি সমবায় সমিতির সভাপতি প্রদীপ সরকার। তিনি সমবার্তাকে বলেন, ‘আমাদের কর্মীরা খেলাপি সদস্যদের বাসায় বাসায় যায়। তাঁদেরকে পর পর তিনটি চিঠি প্রদান করে ঋণ পরিশোধ করার জন্য আহ্বান জানায়। তারপরও কেউ যদি ঋণ পরিশোধ না করে এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ যদি এক লক্ষ টাকার বেশি হয় তখন তাঁর ছবি, স্থায়ী এবং বর্তমান ঠিকানাসহ আমাদের সমিতির মুখপত্র সমবায় দর্পণে প্রকাশ করি।” এছাড়া তাঁরা সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচনের সময় খেলাপিদের ছবি দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে দেন। তিনি আরও বলেন, ‘ছবিসহ খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করলে তাঁরা সামাজিকভাবে সচেতন হন এবং এই ম্যাগাজিনগুলো প্রায় সব চার্চ, সমিতি, এনজিওগুলোতে পাঠাই যেন তারা দেখতে পারে কে কে খেলাপি আছে।’ এই পদ্ধতিতে প্রতি বছর অনেক খেলাপি সদস্যরা ঋণ নিয়মিত ফেরত দিচ্ছেন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘যখন জামিনদারগণ খেলাপি সদস্যের ছবি দেখেন, ছবি দেখে খেলাপি সদস্যকে ফোন দেন। খেলাপি সদস্য সামাজিকভাবে সচেতন হন এবং এভাবে ঋণ দেওয়া শুরু করেন।’ সমিতিটির খেলাপি সদস্যদের ছবি প্রকাশের এই শক্ত অবস্থান থাকার ফলে সহজেই খেলাপি ঋণ পরিশোধ করা যায় বলে তিনি জানান।

উপরের উদ্যোগ ছাড়াও সমিতিগুলো আরও অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করছে। সবচেয়ে বড় কথা একজন ঋণ খেলাপি সদস্য সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন। তাই ঋণ নেওয়ার আগে সদস্য ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করতে পারবেন কিনা সেটা যাচাই করে দেখা উচিত।

পরিশেষ বলা যায়, যেসব সমিতি ঋণ খেলাপি রোধে হিমসীম খাচ্ছে, আশা করি এই প্রবন্ধের মাধ্যমে তারাও নতুনভাবে খেলাপি রোধ করার নতুন নতুন পথ পাবেন॥