শিরোনাম :
রাঙ্গামটিতে জুম্ম পরিবারকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে এলাকবাসীর মানববন্ধন
রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের নামে শহরের হেচারি এলাকার ২৭ জুম্ম পরিবারকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন করেছে এলাকাবাসী।
১৩ ফেব্রুয়ারি, সকাল ১১:০০ থেকে রাঙ্গামাটি ডেপুটি কমিশনার কার্যালয়ের সামনে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের নামে রাঙ্গামাটি শহরের হেচারি এলাকার ২৭ জুম্ম পরিবারকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত অচিরেই বাতিলের দাবিতে হেচারী এলাকা ভূমি রক্ষা কমিটির উদ্যোগে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। হেচারী এলাকা ভূমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ভূবনেশ্বর চাকমার সভাপতিত্বে মানববন্ধন পরিচালনা করেন রাসেল চাকমা।
মানববন্ধনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সদস্য ও এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক বিজয় কেতন চাকমা বলেন, জুম্মরা বারে বারে উচ্ছেদ হচ্ছে। উন্নয়নের নামে, কখনো মেডিকেল কলেজ, কখনো প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নামে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে তথাকথিত উন্নয়নের নামে এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে অবহেলা, বঞ্চনা ও ভূমি থেকে উচ্ছেদ না করতে সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানান। তিনি আরো বলেন, জেলা প্রশাসক যদি জনগণের মনের কথা বুঝতে না পারেন তাহলে তিনি জনসেবক হতে পারেন না। তিনি পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া কথা উল্লেখ করে বলেন- এই চুক্তি এরশাদ সরকার, বিএনপি সরকার ও সর্বশেষ আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে সম্পাদিত হয়েছে। কাজেই জেলা প্রশাসককে পার্বত্য চুক্তি লংঘন করে ভূমি অধিগ্রহণ না করতে আহ্বান জানান।
সভার সভাপতি ভূবনেশ্বর চাকমা বলেন, “আমাদের সাথে কেন এরকম আচরণ করা হচ্ছে, আমরা কী এদেশের নাগরিক নয়?” তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, যে চুক্তি আপনারা স্বাক্ষর করেছেন, চুক্তির আলোকে যে আইন করা হয়েছে তা লঙ্ঘন করে ভূমি অধিগ্রহণ না করার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ করার অনুরোধ জানান।
রাঙ্গামাটি পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড কমিশনার রবি মোহন চাকমা বলেন, হ্যাচারী এলাকাবাসী প্রতিক্ষণে প্রতিমূহুর্তে উচ্ছেদ আতঙ্কবোধ করছে। মেডিকেল কলেজ স্থাপনের নামে যাতে কাউকে উচ্ছেদ করা না হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি তিনি অনুরোধ জানান এবং এ উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সদা সতর্ক থাকতে এলাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
দেব মোহন চাকমা বলেন, সরকার আমাদের মাথা গোজার ঠাঁইয়ের উপর নজর ফেলেছে। উন্নয়নের নামে আমাদেরকে নিজ ভিটা-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে চলেছে। উন্নয়নের নামে, মেডিকেল কলেজ, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নামে জুম্মদের একের পর এর উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বক্তব্য প্রদান করেন বাবু চাকমা, বিমল কান্তি দেওয়ান, জ্ঞানময় চাকমা।
হেচারী এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের নামে ২৭ জুম্ম পরিবারকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী, ভূমি মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী, পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, ২৯৯ পার্বত্য রাঙ্গাামটি আসনের সংসদ সদস্য, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি জেলার ডেপুটি কমিশনার, চাকমা সার্কেল চীফ ও রাঙ্গামাটি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট দরখাস্ত প্রদান করা হয়।
উক্ত দরখাস্তে বলা হয় যে, উক্ত হেচারি এলাকার তারা ২৭ পরিবার জুম্ম সকলেই ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে উদ্বাস্তুর শিকার। ঐ সময় উদ্বাস্তু হওয়ার পর তারা স্ব স্ব ভূমি ছেড়ে রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজিত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তারা আবার উক্ত জায়গা-জমি থেকে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হন। ফলে ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে তারা এই পরিবারসমূহ উক্ত হেচারি এলাকায় বসবাস শুরু করেন। ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির বন্দোবস্তী বন্ধ থাকায় তারা তাদের এই বসতভূমি রেকর্ডভুক্ত করতে পারেননি। তবে শুরু থেকেই তারা সংশ্লিষ্ট ১০২নং রাঙাপানি মৌজার হেডম্যান চাকমা সার্কেলের চীফ রাজা দেবাশীষ রায়ের অনুমতি নিয়েই এই জায়গায় বসবাস করছেন। সেই আলোকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনার আলোকে তারা অবশ্যই উক্ত জায়গা-জমির প্রকৃত ও বৈধ মালিক। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় যে, গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখ রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের নির্দেশে জেলা প্রশাসনের কানুনগোসহ একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী একদল সেনা ও পুলিশ সদস্যসহ হেচারি এলাকায় গিয়ে তাদের অজান্তে বিনা নোটিশে একতরফাভাবে তাদের উক্ত ২৭ পরিবারের জায়গা পরিমাপ করেন এবং রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্য উক্ত জায়গা অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়ে দেন। এমনকি অচিরেই এই ২৭ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হবে বলে জানিয়ে দেন।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থা, আইন, রীতি, প্রথা ও পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে পদদলিত করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূল চেতনাকে উপেক্ষা করে সরকারের পক্ষে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক কর্তৃক বন্দোবস্তী মামলা নং-০১(১৫)/২০১৬-১৭(১০২) মূলে উক্ত জায়গা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অনুকূলে বন্দোবস্তী প্রদানের প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। দরখাস্তে উল্লেখ করা হয় যে, উক্ত ২৭ জুম্ম পরিবারের প্রায় সকলেই অনেক কষ্টে, মজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের আর বসবাসের কোন বাস্তুভিটা নেই। বারবার উচ্ছেদ হওয়ার শিকার হয়ে তারা আজ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। চুক্তি ও আইন অনুযায়ী যেখানে তাদের মত অসহায় ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পরিবারসমূহকে পুনর্বাসন ও ভূমি বরাদ্দ দিয়ে ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার কথা সেখানে উল্টো তাদেরকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে, যা কোনভাবে মানবিক বলে বিবেচনা করা যায় না বলে উক্ত ২৭ পরিবার তাদের দরখাস্তে উল্লেখ করেন।
আরবি/ এসএন/ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭