শিরোনাম :
অসহায় শিশুদের আলো দিয়ে পথ দেখায় ওয়্যাইজম্যান ক্লাব ও সাভার ওয়াইএমসিএ
।। রাফায়েল পালমা।।
ধামরাই থানার শিয়ালকুল দক্ষিণপাড়া গ্রামের দিনমজুর মো. বিপ্লব শেখ টেলিফোন করাতে খুশি হলেন। পত্রিকায় তাদের ট্র্যাজেডির বিষয় ছাপা হবে জেনে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সাহায্য করলেন। বোঝা গেল তার মধ্যে লেখাপড়ার দ্যোতি আছে; আলাপচারিতার মধ্যে তার প্রতিফলন ঘটেছে।
পনের বছর বয়সে বিপ্লব শেখ বাবাকে হারান। লেখাপড়া বন্ধ হয় পঞ্চম শ্রেণি পড়ার পর। নানা জায়গায় নানা কায়িক শ্রম দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন তিনি। পরে বিয়ে করলেন শিল্পী বেগমকে, ২৬। সহধর্মিনী শিল্পী কাজ নিলেন পোশাকশ্রমিক হিসেবে, সাভারের রানা প্লাজায় একটি পোশাক কারখানায়। কাজ করতেন অপারেটর হিসেবে। দুজনের উপার্জনে সংসার ভালই চলছিল। ভালবাসার ফসল হিসেবে এই নবদম্পত্তি পেয়েছে এক মেয়ে সন্তান, নাম রাখলেন রাজিয়া সুলতানা, কেউ বলে সুলতানা রাজিয়া; সাহসী মেয়ে। কিন্তু তাদের জীবনের ছন্দপতন হয় বিবাহের কয়েক বছর পরেই।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে যায় রানা প্লাজার ট্র্যাজেডি। রানা প্লাজা নামক ইমারতের ধসে ১ হাজার ১২৯ জন মানুষের প্রাণ যায় জীবন্ত কবরে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন শত শত পোশাকশ্রমিক ও সাধারণ মানুষ। পোশাকশ্রমিকদের মধ্যে যারা নানাভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করলেন, তাদেরই একজন শিল্পী বেগম। সেই ইমারতেরই কোনো এক তলায় পোশাকশিল্পে অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন তিনি। এখন তিনি চলাফেরা করেন হুইলচেয়ারে। তবুও জীবন চলমান, যেমন চলমান এই দম্পত্তির ভবিষ্যৎ স্বপ্ন।
শিল্পী বেগম বাম পা হারালেন চির দিনের তরে। অনেক স্বামীর মতো শিল্পীকে ছেড়ে চলে যাননি বিপ্লব শেখ। ভালবাসা ও দু:খভরা হৃদয়ে স্বপ্ন আছে তাদের, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে আছে অনেক আশা। আর এই সংকটপূর্ণ অবস্থায় যারা তাদের স্বপ্ন দেখান, তারা হলেন ওয়াইজম্যান ক্লাবের সদস্য। তাঁরা সাভার, ঢাকা ও আশপাশের জেলার কিছু প্রগতিশীল খ্রিষ্টান যুবক। তাদের অনেকের ব্যবসা হয়তো পোশাকশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত। হয়তো পোশাকশিল্পই তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন এনেছে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে সহধর্মিনী (পোশাককর্মী) শিল্পী বেগম পঙ্গুত্ব বরণ করলেও তাদের স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসায় ফাটল ধরেনি মোটেও। মৌলিক মানবিক মূল্যবোধকে পুঁজি করে আজও তারা ভালবাসায় অটল, জীবন্ত। দিনমজুর হিসেবে কাজ করেও বাড়িতে এসে রান্নবান্নার ও অন্যান্য গৃহস্থালীর কাজগুলো সেড়ে নেন স্বামী বিপ্লব শেখ। ‘অন্তরের ভালবাসা সবই করতে শেখায়,’ বলেন তিনি।
আজ ২০১৮-এর ২৪ এপ্রিল। আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে, ২০১৩ সালের এই দিনে বিপ্লব শেখ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েিেছলেন রানা প্লাজায় ধ্বংস্তুপে চাপাপড়া তার সহধর্মিনী পোশাককর্মী শিল্পী বেগমকে। খেয়ে-না-খেয়ে স্ত্রীর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন মাসের পর মাস। রক্ষা করেছেন স্ত্রীকে, কিন্তু পঙ্গুত্ব নিয়ে।
ট্র্যাজেডির তিনদিন পর যখন তার সহধর্মিনীকে পাওয়া গেল, তখন তিনি কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে জ্ঞান হারান। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন বুঝতে পারলেন তিনি কোনো এক হাসপাতালের বিছানায়। সেটা ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ইমারতের ভীমের চাপায় তার বাম পা থেত্লে চুরমার হয়েছিল।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে স্থানান্তর করা হয়েছিল এপোলো হাসপাতালে। সেখানেই তার বাম পা হাটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়। এরপর বাকি সেবা নিতে হয়েছে সাভারের সিআরাপি থেকে। সেখানেই তাকে দেওয়া হয় হুইল চেয়ার। বর্তমানে হুইলচেয়ারের চারটি রাবারের চাকা তার চলার দায়িত্ব নিয়েছে।
রাজিয়া সুলতানাসহ আরো নয় জন শিশু ওয়াইজম্যান ক্লাবের মাসিক আর্থিক সহায়তা পেয়ে আসছে। ওই নয় জন হলো মেহেদী হাসান, সাব্বির হোসেন, রিমি সালমা আক্তার, বাদল হোসেন বেলাল, রনি হোসেন, রিয়া আক্তার, সুমাইয়া আক্তার, বৃষ্টি আক্তার ও মোহম্মদ তারেক। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সর্বোচ্চ নবম শ্রেণি পর্যন্ত উত্তীর্ন হয়েছে। অন্যরা নিচের বিভিন্ন শ্রেণিতে।
রাজিয়া সুলতানার মা শিল্পী বেগম বলেন: ‘আল্লাহ্ ছেলে-মেয়ে সবই দিয়েছে, কিন্তু ওদের কোদ্দুর পড়াতে পারব আমি জানি না। তবে আমাদের স্বপ্ন আছে; ওরা ভাল কিছু হইব। ছেলের বয়স মাত্র নয় মাস। নাম রাখছি তাওরাদ শেখ।’ পঞ্চম শ্রেণি পড়–য়া মেয়ে রাজিয়া বলে: ‘আমার প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলছে। ভাল হচ্ছে। বাংলা ও ইংরেজি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আগামিকাল বিজ্ঞান পরীক্ষা।’ জীবনের লক্ষ্য ও স্বপ্নের কথা জিজ্ঞেস করাতে রাজিয়া উত্তর দেয়: ‘আমি ডাক্তারি পড়তে চাই, ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই।’
রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির দিনটিতে ওয়াইজম্যান ক্লাবের একজন সদস্য সুকেন গমেজ সুদূর আমেরিকা থেকে ফেসবুকে লিখেছেন: ‘আজ ২৪ এপ্রিল। পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় ভয়াবহ দুর্ঘটনা রানা প¬াজা ধসের দিন। দিনটিকে স্মরণ করে রেডিও-টেলিভিশনে ও পত্রপত্রিকায় কথার ফুলঝুরি ফুটছে। কালই আবার নতুন কোনো ইস্যু নিয়ে হয়তো-বা মাতামাতি শুরু হবে। ভুলে যাবে রানা প¬াজা দুর্ঘটনায় স্বজনহারাদের, যারা জীবনের প্রতিটা দিনই তাদের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।
দুর্ঘটনার পর পরই, ৪ অক্টোবর ২০১৩ রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগস্ত ১০টি পরিবারের ১০ জন শিশুকে বেছে নিয়ে ১০ বছর যাবৎ শিক্ষাবৃত্তি প্রদান কর্মসূচি চালিয়ে যাবার প্রত্যয় নেয় ওয়্যাজম্যান ক্লাব অব ঢাকা সেন্টাল। এই কর্মসূচি সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব নিয়েছে সাভার ওয়াইএমসিএ।
ওয়াইজম্যান ক্লাব অব ঢাকা সেন্ট্রাল, বাংলাদেশ ওয়াইএমসিএ এবং সাভার ওয়াইএমসিএ-এর যৌথ উদ্যোগে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় শিকার অসহায় মানুষের শিশুদের জন্য স্থায়ী কিছু করার উদ্যোগ নেয়। তৎকালীন ওয়াইজম্যান ক্লাব অব ঢাকা সেন্ট্রাল-এর সভাপতি বাবু মার্কুজ গমেজের নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত হয় ফান্ড কালেকশন করে কমপক্ষে ১০ জন শিশুকে শিক্ষা সহয়তা দেওয়ার। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকিও তাঁর ব্যক্তিগত দান হিসেবে উল্লেখযোগ্য পরিমান অর্থ দান করেন।
স্থানীয় ক্লাব মেম্বার এবং ওয়্জাম্যান এশিয়া মেম্বারদের ব্যক্তিগত আর্থিক সহযোগিতায় একটি ফান্ড গঠন করা হয়, যা ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে বাংলাদেশের খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বৃহৎ সমবায় সমিতি ‘ঢাকা ক্রেডিট’-এ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সুদের টাকা উত্তোলন করে শিক্ষাবৃত্তি হিসেবে প্রতি শিশুকে মাসে ১ হাজার টাকা করে সহয়তা প্রদান করা হয়। কাজটি ভালো মতোই সম্পাদন করে যাচ্ছে সাভার ওয়াইএমসিএ (ইয়াং ম্যান খ্রিষ্টান এসোসিয়েশন)।
তাদের পড়াশোনার দেখভাল, রেজাল্টের খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। প্রতি তিন মাস বা ছয় মাস অন্তর শিশুদের ও তাদের অভিভাবকদের একত্রিত করে শিশুপ্রতি মাসে ১ হাজার টাকা হিসেবে প্রদান করা হয়। ঈদ উপলক্ষে বছরে দুবার ঈদের উপহার ও ঈদ উদযাপনের জন্য সকল ধরনের খাদ্যসামগ্রী প্রতি বছরই প্রদান করা হয়। ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই উপবৃত্তি সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে এই ক্লাব; চলবে ১০ বছর যাবৎ।
সাভার ওয়াইএমসিএর সেক্রেটারি রনেল কস্তা বলেন, ওই শিশুদের লেখাপড়া, বার্ষিক ঈদ উৎসবে নানাভাবে খোঁজ-খবর নেওয়ার কাজগুলো নিখুঁতভাবে করে আসছে সাভার ওয়াইএমসিএ। সাভার ওয়াইএমসিএ-এর সদস্য ও শুভাকাঙ্খীরা সবাই এসব শিশুদের জন্য দোয়া চাইলেন যেন তাদের জীবন সুন্দর হয়।
সাভার ওয়াইএমসিএ-এর প্রেসিডেন্ট তপন টমাস রোজারিও বলেন, যারা বিপদে সাহায্য পায়, তারা অন্যদেরও সাহায্য করতে পারে। এই শিশুদের অনেকেই হয়তো একদিন বড় হবে, পেশাগত কাজে যুক্ত হবে; এবং প্রকান্তরে তারাও হয়তো একদিন সমাজের মানবিক কাজে এগিয়ে আসবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণের উধের্ব গিয়ে সেবা করার নিদর্শন শিশুরা আমাদের কাছ থেকেই শিখতে পারছে।
রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির শিকার পঙ্গু শিল্পী বেগমের সন্তান রাজিয়ার লেখাপড়ার মাসিক খরচের দায়ভার বহন করছেন কিছু দানশীল মানুষ; সেচ্ছায়, সাথে আরো নয় জনের জন্যও আর্থিক সহায়তা দিয়ে শিক্ষার আলো পেতে সাহায্য করছেন- বিষয়টি কেমন মনে হয়, এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করায় হুইল চেয়ারে বসেই শিল্পী বেগম বললেন: ‘উনারা যা করছেন, তার তুলনা হয় না। শুধু ধন্যবাদ দিয়ে তাঁদের ছোট করা যায় না।’