ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৮ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

অবশিষ্ট একজন

0
767

সারারাত ভালো ঘুম হয়নি মানিকের। আজে-বাজে স্বপ্ন দেখে ঘুম নষ্ট হয়েছে। স্বপ্ন বলতে দুঃস্বপ্ন বলা যায়। স্বপ্ন হচ্ছে জীবনের প্রতিচ্ছায়া, সারাদিন মানুষ যা চিন্তা করে অবচেতন মনে রাতের বেলায় তাই মানুষ বেশিরভাগ সময় স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন হচ্ছে মানুষের চিন্তা চেতনার প্রতিবিম্ব। এলোমেলো চিন্তাগুলো নিয়েই বাথরুমে যায় মানিক। বাথরুমে আয়নার সামনে দাড়ায়। তার কপালে ভাজ, গালের চামড়ায় ভাজ পড়েছে। চোখের জ্যোতি কমে আসছে। নিজেরই মনে হচ্ছে, বয়স ক্রমেই বেড়ে চলছে। চল্লিশ বছরের জীবনে বার্ধক্য উকি মারছে।

চল্লিশের পরে মানুষের শরীরে নানারকম রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে, শরীরে অবসাদ চলে আসে। চল্লিশ মানে যৌবনের শেষ, বার্ধক্যের শুরু। চল্লিশ মানে জীবনের রঙিন ছবি থেকে সাদাকালো ছবিতে প্রবেশ করা। রঙিন জীবনে আস্তে আস্তে নেমে আসে ধুসরতা। মানিকের  গালে কাঁচা-পাকা দাড়ি। অনেকদিন হলো ভাল করে দাড়ি কামানো হয় না। মাথায় টাক পড়া শুরু করেছে অনেক আগেই, সাথে যোগ হয়েছে চুল পেঁেক সাদা হওয়ার পালা। মানুষের জীবনটা নদীর জোয়ার-ভাটার মতো বাড়ে-কমে, অর্ধেক জীবন নদীর জলের মতো বৃদ্ধি পায়, অর্ধেক জীবন হ্রাস পায়। জন্ম হয়, বৃদ্ধি হয়, আবার মৃত্যুও হয়। এই পৃথিবীকে মানুষের দেওয়ার অনেক কিছুই আছে, অথচ নেওয়ার কিছুই নাই। তবুও মানুষ খুবই অল্প সময় বাঁচে, অথচ একটি কচ্ছপ বাঁেচ হাজার বছর।

মানুষের জীবন বাতাসে ভেসে বেড়ায়। অক্সিজেন যদি বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান হয় তবে বাতাসের প্রতিটি কণা মানুষের জীবনের অংশ। নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে মানুষ বাতাস গ্রহণ করে এবং বেঁচে থাকে। মানুষের জীবন চক্রে প্রয়োজন খাদ্য, পানি, বাতাস, আলো, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং ভালবাসা। এই পৃথিবীতে কেউই অবাঞ্চিত নয়। প্রতিটি নবজাতক এই পৃথিবীতে আসে মুষ্ঠিবদ্ধ দুটি হাত নিয়ে, একহাতে তার অধিকার আর অন্য হাতে তার দায়িত্ব। প্রতিটি নবজাতক এই পৃথিবীর একটি নতুন সম্ভাবনা।

মানিক  তার নিজের ফ্ল্যাটে থাকে। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ফ্ল্যাটটি ক্রয় করেছে। ভাড়ার টাকায় ফ্ল্যাট প্রকল্প থেকে সে এই ফ্ল্যাটটি ক্রয় করেছে। মাসে মাসে কিস্তি পরিশোধ করে। তার ফ্ল্যাটের পাশেই পাবলিক পার্ক । এলাকার প্রায় সব বয়স্ক লোকেরা সকালে এখানে হাটাহাটি করে। প্রতিদিন সকালে মানিক সেই পার্কে  হাটতে যায়। প্রতিদিন পার্কে হাটা তার রুটিন মাফিক কাজ। বয়স বাড়ছে, শরীরের দিকে যতœ দেওয়া দরকার। হাটাহাটি শরীরের জন্য খুবই উপকারী, ডাইবেটিস রোগের বড় ঔষধ। নিয়মিত ব্যায়াম মানুষের জীবনের সুস্থতার জন্য খুবই দরকার।

মানিক আমার ছোট বেলার বন্ধু। সে একটি বিদেশী ঔষধ কোম্পানীতে কাজ করে। ঔষধ কোম্পানীর নাম জেট ফার্মেসী, জার্মানী কোম্পানী। মানিক সেই কোম্পানীর সিনিয়র অফিসার। মানিক আর আমি বাল্যবন্ধু। আমরা স্কুলে সায়েন্সে পড়েছি। মানিক ভার্সিটিতে ক্যামিস্টি নিয়ে পড়াশুনা করেছে, আর আমি কমার্স নিয়ে।  একসাথে মাঠে খেলা করেছি। আমি আর মানিক একই গ্রামের ছেলে। আমি পড়াশুনা করে ব্যবসা করছি। দেশের অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার জন্য আমার ব্যবসা তেমন জমে উঠেনি। আমি ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকি। কোন মতে টানাটানি করে সংসার চালাই। মানিকের ফ্ল্যাটের পাশের ফ্ল্যাটে আমি ভাড়া থাকি। আমার স্ত্রী সুমী একটি মিশনারী স্কুলে শিক্ষকতা করে। আমার দুই মেয়ে, একজন ক্লাস ফাইভে পড়ে আরেকজন ক্লাস এইটে। দৌঁড় খেলায় সবাই একসাথে দৌঁড় শুরু করে, কিন্তু দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অনেকে পিছনে পড়ে যায় আর অনেকে সামনে এগিয়ে যায়। আমি আর মানিক একসাথে দৌঁড় শুরু করেছিলাম বটে, মানিক আমাকে ছেড়ে অনেক এগিয়ে গেছে,  আর আমি দিনে দিনে পিছিয়ে পড়ছি। জীবন যুদ্ধে সে জয়ী, আর আমি পরাজিত।

পার্কে মানিকের সাথে আমার দেখা হলো। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে মানিককে জিজ্ঞাসা করলাম,

–              কেমন আছেন মানিক ভাই?

আমি এখন মানিককে মানিক ভাই বলে ডাকি। মানুষের বয়স বাড়লে তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়, এটাই কালচার।  মানিক হাঁসতে হাঁসতে বললো,

–              ভালো। ভাল। এসো, এই বেঞ্চে আমরা একটু বসি।

পার্কের বেঞ্চে প্রায়ই আমাদের লম্বা সময় গল্প হয়। গল্প হয় সংসারের খ্ুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। সংসার মানে অসার। সংসার মানে সং সাজা। বাজার করা, বিল দেওয়া, ঔষধ কেনা, ছেলের বিয়ে, মেয়ের বিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি।

একদিন আমি আর মানিক পার্কে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম। পার্কের এককোণে একটি ময়লার স্তুপ  জমা করা। দাড় কাক, কুকুর-বেড়াল সেখানে খাবার খায় আর মারামারি করে। এই পৃথিবীতে স্বজাতির প্রতি স্বজাতির বিদ্বেশ সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীতে মানুষ আজ ভুলে গেছে তারা মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দেশ, পাহাড়, আকাশ, সমুদ্র ইত্যাদি নিয়ে মানুষের যত রাজনীতি, যুদ্ধ, মারামারি, হানাহানি। মানুষের জীবনে আজ চরম অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা।

পার্কে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ময়লার স্তুপের কাছাকাছি চলে এলাম। আমরা মুখে রুমাল চেপে ধরলাম। প্রচন্ড দুর্গন্ধ। হঠাৎ একটি শিশুর কান্না আমাদের কানে ভেসে এলো। আমি আর মানিক লক্ষ্য করার চেষ্টা করলাম কোথা থেকে শব্দটি আসছে। আমরা আস্তে আস্তে সেই ময়লার স্তুপের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রায় আট-দশটি দাড় কাক একটি শিশু বাচ্চাকে  চারদিক থেকে ঘিরে আছে। একটি কাক শিশুটিকে  টানাটানি করছে। আমরা যতই কাছে আসতে থাকলাম কান্নার শব্দটি ততই জোরালো হতে থাকলো। আমরা নাকে রুমাল চেপে ময়লার স্তুপের কাছে গেলাম। মানিক আমাকে ছেড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দাড়কাকগুলো আমাদেরকে দেখে জোরে জোরে ডাকাডাকি শুরু করলো। একটি বাচ্চা সেখানে পড়ে আছে। দাড় কাকগুলো বাচ্চাটিকে খাওয়ার জন্য টানাটানি করছে। জীবন্ত বাচ্চাটির শরীর বেয়ে রক্ত বের হচ্ছে।  মানিক দৌঁড়ে ময়লার পাশে পড়ে থাকা বাচ্চাটিকে  কোলে তুলে নিল। মেয়ে বাচ্চা। বাচ্চাটি প্রচন্ড জোরে চিৎকার করছে। দাড় কাকগুলো বাচ্চাটির বাম পাশের গালের মাংস খেয়ে ফেলেছে। মানিক বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আমি আস্তে আস্তে মানিকের কাছে গেলাম।

মানিক আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

–              এই বাচ্চাটিকে কি বাঁচানো যাবে? চল, বাচ্চাটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।

–              বাচ্চাটির গালের মাংস কাকে খেয়ে ফেলেছে। বাচ্চাটি মৃতপ্রায়। ঝামেলার কি দরকার বল ভাই।

মানিক আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো। সে দৌঁড়ে পার্ক হতে বের হয়ে গেল। একটি সিএনজি ভাড়া করে শিশু হাসপাতালে গেল।

প্রায় একমাস মানিকের সাথে আমার কোন দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। আমি একা একা সকালে পার্কে হাটাহাটি করি। অফিসে যাই। আমি লজ্জায় মানিককে কোন ফোন করি না। কি জিজ্ঞাসা করবো তাও ভেবে পাই না।

ঈদের ছুটিতে মানিক একদিন আমাকে ফোন করলো, তার বাসায় যেতে আমাকে অনুরোধ করলো। একদিন সকালে আমি পার্কে হাটাহাটির পর মানিকের বাসায় গেলাম। মানিকের স্ত্রী চম্পা বৌদি দরজা খুলে দিল। মানিকের দুই সন্তান, এক ছেলে ক্লাস সেভেনে পড়ে আর এক মেয়ে ক্লাস টুতে পড়ে। আমি ড্রয়িং রুমে বসলাম। মানিক আমার জন্য এককাপ কফি নিয়ে এলো।

–              কেন ডেকেছো ভাই?

–              শ্যামল ভাই, আমি তো বাচ্চাটিকে বাচাঁতে পেরেছি। মানিক হেসে উত্তর দেয়।

–              বাচ্চাটি এখন কোথায়?

–              বাচ্চাটি আমার ঘরে। আমি বাচ্চাটি লালন-পালন করবো। আমার স্ত্রী চম্পা বাচ্চাটি পেয়ে খুব খুশি হয়েছে।

আমি তো অবাক। আমি তার বেড রুমে বাচ্চাটিকে দেখতে গেলাম। বাচ্চাটি মনের আনন্দে হাত-পা ছুড়ে খেলছে। তার গালে মাংস লাগানো হয়েছে, অর্থাৎ প্লাষ্টিক সার্জারি করা হয়েছে। কিন্তু চেহারাটা বিকট আকার ধারন করেছে। মুখটা কিছুটা বাম পাশে বেঁকে গেছে। কাকে খাওয়া জায়গাটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

আমি আস্তে আস্তে মানিকের বাসা থেকে বেড়িয়ে এলাম। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মানিক এটা কি ধরনের পাগলামি করছে। চম্পা বৌদিও তাকে কিছু বলছে না। নিরবে সবকিছু মেনে নিচ্ছে।

ব্যবসার কারণে আমি বাসা বদল করে অন্য পাড়ায় চলে এলাম। মানিক ভাইয়ের সাথে আমার আর দেখা হয় না। ফোনেও কথা হয় না। ঢাকা শহরে প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারও খোঁজ খবর রাখে না। ঢাকা শহরে সবাই ব্যাস্ত।

অনেক বছর পর মানিক তার ছেলের বিয়েতে আমাকে দাওয়াত করলো। ছেলে কানাডা থাকে। ভালো চাকুরী করে। দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য। বিয়ের পর বৌকে বিদেশে নিয়ে যাবে। আমরা স্বপরিবারে মানিকের ছেলের বিয়েতে গেলাম। জমকালো বিয়ের অনুষ্ঠান। সবাই আনন্দ-ফূর্তি করছে। মানিক আমাদেরকে স্বাগত জানালো।

অনুষ্ঠান শেষে মানিক আমার পাশে এসে বসলো। মানিকের সব চুল পেকে সাদা হয়ে গেছ্।ে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেছ্।ে আমি আর মানিক অনেক বিষয়ে কথা বলতে লাগলাম। হঠাৎ একটা যুবতী মেয়ে মানিকের দিকে এগিয়ে এলো। মানিক বললো,

–              এসো মা, আমার পাশে বসো। আমাকে দেখিয়ে বললো,

–              উনি হলে তোমার শ্যামল আঙ্কেল, আমার বাল্য বন্ধু।

মেয়েটি মানিকের হাতে কিছু ঔষধ দিয়ে বললো,

–              বাবা, ঔষধগুলো খাও।

মেয়েটির কথা অনুসারে মানিক ঔষধগুলো খেয়ে নিল। মেয়েটি মানিকের চোখ, জিহ্বা এবং হাতের পালস চেক করে নিল। মানিক আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

–              শ্যামল, ডাক্তার এখন আমার ঘরে। আমার মেয়ে এখন ডাক্তার। পিজি হাসপাতালে বসে।

মেয়েটি আমাকে সেলাম করে চলে গেল। মানিক আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

–              চিনতে পেরেছিস? সেই মেয়েটি যাকে আমরা পার্কে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। কাকে যার মুখের মাংস খেয়েছিল।

আমি তো অবাক। আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না। মানিক বললো,

–              আমি মেয়েটিকে মানুষ করেছি। ঢাকার সবচেয়ে বড় স্কুলে পড়িয়েছি। সে ঢাকা মেডিকেল হতে ডাক্তারি পাস করেছে। বিদেশে এক বছর পড়াশুনা করেছে। বিদেশে সে প্লাষ্টিক সার্জারি করেছে। এখন সে পিজি হাসপাতালে ডাক্তারি করে। আমার ছেলে কানাডা থাকে। মেয়ে বিয়ে হয়ে আমেরিকা চলে গেছে। আমি আর চম্পা এখন এই দেশে থাকি। মেয়েটা আমাদের খুব যতœ নেয়। আমার নিজের মেয়ের মতো আমি ওকে ভালবাসি। আমাদের পরিবারের এবং আত্মীয় স্বজনদেরকে এই মেয়ে বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। আমার পরিবারের সবার মন সে জয় করে নিয়েছে। আমাদের অসুখ নিয়ে এখন আর কোন চিন্তা করতে হয় না। কারন ডাক্তার এখন আমার ঘরে।

মানিক একটি ভিজিনিং কার্ড আমার হাতে দিল। আমি কার্ডটির দিকে তাকালাম, ডাক্তার রেশমী, পিজি হাসপাতাল।

আমি আস্তে আস্তে বিয়ে বাড়ি হতে বের হয়ে এলাম। বুঝতে পারছিলাম না, মানিক কি কোনো সাধারন মানুষ, নাকি কোন মহাপুরুষ। নাকি মানুষরূপী কোন দেবতা।

আমার চোখের সামনে সেই পার্কটির ছবি হঠাৎ ভেসে উঠলো। সেই পাবলিক পার্ক। সেই ময়লার স্তুপ। সেই র্শিশুর কান্না। সেই দাড় কাকের বিরক্তিকর ধারালো  কা-কা-কা-কা-কাকাকাকা শব্দ।

(বাস্তব ঘটনার অবলম্বনে)