ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা দেশ “আমরা যেমন এক, তারাও যেন তেমনি এক হয়”

“আমরা যেমন এক, তারাও যেন তেমনি এক হয়”

(যোহন ১৭:১১)

0
596

|| কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও সিএসসি ||

ভূমিকা : কৃতজ্ঞতা স্বীকার

“গ্লোবাল প্রেয়ার ফেলোশিপ” কর্তৃক, দ্বিতীয়বারের মতো অনলাইনে “গ্লোবাল প্রেয়ার ওয়ারিয়র কনফারেন্স” আয়োজনের জন্য আমি আমার নিজের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির সময়ে অনলাইনে এরূপ একটি প্রার্থনা আয়োজন যেমন যথোপযুক্ত, তেমনি “সামাজিক দূরত্ব”- থাকা সত্বেও, প্রার্থনার মাধ্যমে খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের মধ্যে মিলন (কমূনিয়ন) বা ঐক্য সৃষ্টির একটা মহতী প্রচেষ্টা। তাছাড়া “তারা যেন এক হয়” যিশুর এই প্রার্থনার সঙ্গে একটা সামঞ্জস্য রেখে, তাঁর নির্দেশের প্রতি শিষ্যদের আনুগত্যের একটা সুন্দর অভিপ্রকাশও এ আয়োজনের মাধ্যমে ঘটছে।

আরও একটি কৃতজ্ঞতার বন্ধন অনুভব ক’রে, আমি এই প্রার্থনায় মিলিত হচ্ছি: “গ্লোবাল প্রেয়ার ওয়ারিয়র কনফারেন্স”-এর প্রথম প্রার্থনা-অনুষ্ঠানে, আমি যখন অসুস্থ ছিলাম, তখন আপনারা অনেকে আমার জন্য পরম করুণাময় প্রভুর কাছে প্রার্থনা নিবেদন করেছিলেন। আজ আমি সবার প্রার্থনার ফলে, প্রভুর সুস্থতা লাভ করেছি। আপনাদের সাথে এই প্রার্থনা-অনুষ্ঠানে মিলিত হয়ে পরম প্রভুর প্রশংসা করি এবং আপনাদের নিকটও আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। প্রভুর প্রশংসা হোক! তাঁর নামের মহিমা হোক!

শাস্ত্রপাঠ: যোহন ১৭:৯-১১ (দ্র: যোহন ১৭:১-২৬)

বাণী প্রচারের শুরুতে আমরা প্রথমতঃ যিশুর নিজের প্রার্থনা যোহন লিখিত সুসমাচার থেকে শ্রবণ করি এবং তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রার্থনা করি।

“আমি তাদের জন্য প্রার্থনা করছি; জগতের জন্য প্রার্থনা করছি না, কিন্তু যাদের তুমি আমাকে দিয়েছ, তাদেরই জন্য প্রার্থনা করছি; কারণ তারা তোমারই। যা কিছু আমার তা সমস্তই তোমার; এবং যা তোমার তা আমার, এবং এই ভাবেই আমি তাদের অন্তরে গৌরবান্বিত। আমি এজগতে আর থাকছি না, তারা কিন্তু এজগতে থাকছে, আর আমি তোমার কাছে আসছি। পবিত্রতম পিতা, তোমার যে নাম তুমি আমাকে দিয়েছ, সেই নামে তাদের রক্ষা কর: আমরা যেমন এক, তারাও যেন তেমনি এক হয়।” (জুবিলী বাইবেল)

বাইবেল পাঠ অনুসারে, এই উপস্থাপনার মূল বিষয় হচ্ছে: “তার যেন এক হয়”। এই আলোচনায় “এক হওয়া”, “মিলন”, “ঐক্য”, “একাত্মতা” শব্দগুলো প্রায় সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

শাস্ত্রবাক্যের কয়েকটি শব্দের ব্যাখ্যা:

আজকের সুসমাচারের পাঠ থেকে কয়েকটি শব্দ উল্লেখ করে মৌলিক কতিপয় বিষয়ের কিছু ব্যাখ্যা তুলে ধরছি।

নাম: ইহুদীরা পরমেশ্বরকে সদাপ্রভু বা ইয়াওয়ে নামে ডাকতেন। “নাম” বললে ব্যক্তিকেই বুঝায়। ইয়াওয়ে, “তিনি, যিনি আছেন”, তিনিই নিজেকে প্রকাশ করেন নবসন্ধিকালে, মানবযিশুর মাধ্যমে, যিনি হলেন ইম্মানুয়েল, মানুষের মাঝে যিনি আছেন।

পিতা: যিশু ইয়াওয়েকে “পিতা” বলে ডাকেন। পিতার সঙ্গে পুত্র হিসেবে যিশু সত্তাগত ভাবে এক এবং সম্পর্কগতভাবেও তিনি এক। পিতা আছেন পুত্রের মধ্যে এবং পুত্র আছেন পিতার মধ্যে।

পবিত্র: পিতা ও পুত্রের মধ্যে “মিলন” বা “ঐক্যই” হল পবিত্রতা। পিতা ও পুত্র মিলে এক ও পবিত্র। এই পবিত্রতাই হচ্ছে খ্রিষ্টবিশ্বাসী, অর্থাৎ যারা খ্রিষ্টেতে অবগাহন পেয়ে ঈশ্বরের সন্তান হয়েছে. তাদের জীবনের লক্ষ্য। পিতার সঙ্গে ও পুত্রের সঙ্গে এক হওয়াই পবিত্রতা। যিশুর শিষ্যদের জীবনের মূল বিষয় হচ্ছে পিতা ও পুত্রের সঙ্গে এক হওয়া। আর এভাবেই পবিত্র হওয়া।

মহিমা: যিশু পিতার নামের মহিমা প্রকাশ করেন, একই ভাবে তাঁর শিষ্যরাও পিতা ও পুত্রের নাম ও তাঁদের মহিমা প্রকাশ করবে। পিতা ও পুত্রের সঙ্গে ‘এক হওয়াই’ জীবনের মহিমা।

যীশুর যাজকীয় প্রার্থনা: মহিমা প্রকাশের প্রার্থনা

যোহন লিখিত সুসমাচারে বলা হয়েছে যে, যিশু আমাদের জন্য তাঁর পিতার কাছে প্রার্থনা করেন। এই প্রার্থনা তাঁর যাজকীয় প্রার্থনা। এই প্রার্থনার চারটি প্রধান অংশ আছে:

(ক) যিশু নিজ জীবনের মহিমা প্রার্থনা করেন: পিতার সাথে পুত্র হিসেবে এক হয়ে থাকাটাই তাঁর মহিমা। “এক হওয়া”র উদ্দেশ্যে যিশু নিজের জীবনকে যজ্ঞ-বলি রূপে দান করেন; যিশু নিজেই যজ্ঞবেদী, যজ্ঞনৈবেদ্য ও যজ্ঞ-উৎসর্গকারী যাজক। আপন জীবনকে যজ্ঞদানের মধ্য দিয়ে যিশু পিতার মহিমা প্রকাশ করেছেন।

(খ) যাজকীয় প্রার্থনায় যিশু শিষ্যদের মহিমার জন্য প্রার্থনা করেন: যেমন যিশু বলেন: “তারা তোমারই” (৯), “আমরা যেমন এক তারা যেন এক হয়” (১১), “মন্দ আত্মা হতে তাদের রক্ষা কর” (১৫), “তাদের পবিত্রীকৃত কর” (২৩)।

(গ) যিশু সকল বিশ্বাসীদের মহিমা প্রার্থনা করেন: তারা যেন এক হয়; যেন জগৎ জানতে পারে যে, তুমি আমাকে প্রেরণ করেছ (২৩)।

(ঘ) যিশু প্রার্থনা করেন যেন, শিষ্যেরা তাঁর সাথে এক হয়ে থাকে ও তাঁর মহিমা দর্শন করে (২৪-২৬)। সবার সাথে এক হয়ে থাকা এবং সেই এক হওয়ার মহিমা দেখতে পারাই অনন্তকালীন সুখ।

সংক্ষিপ্ত অকারে বলা যায় যে, খ্রিষ্টীয় “মিলন” বা “এক হওয়া” হচ্ছে মূলতঃ ও প্রথমতঃ শিষ্যদের খ্রিষ্ট  কেন্দ্রিক জীবন। “এক হওয়া” হচ্ছে খ্রিষ্টীয় আধ্যাত্মিকতা, যাকে মিলনের আধ্যাত্মিকতা বলা চলে।

বর্তমান বিশ্বায়ন যুগে এক হওয়া বা মিলনএর লক্ষণ: (দ্র: “বিশপ থিয়োটনিয়াস গমেজ, সিএসসি, “তারা যেন এক হয়”, বক্তব্য, ২০১৫)

(১) এক হওয়ার জন্য বহির্মুখী যাত্রা: মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, ব্যবসা-বানিজ্যে, কৃষ্টি ও ধর্মে, সমাজ ও রাজনীতিতে; সর্বত্র বহির্মুখী আনাগোনা ও চলাচল।

(২) এক হওয়ার জন্য অন্তর্মুখী যাত্রা: জাগতিকের মধ্যে আত্মিক, বাহ্যিকতার মধ্যে অন্তরের দিকে যাত্রা; বৃহত্তর থেকে ক্ষুদ্রে যাত্রা, বাইরে থেকে ভেতরে যাত্রা, বিজ্ঞানে অনু-পরমানু আবিষ্কারের জন্য যাত্রা; এই ধারার মধ্যে ধর্মও কিন্তুু সবকিছুর হৃদয় বা অন্তর অনুসন্ধান করার কাজে রত থাকে।

(৩) এক হওয়ার জন্য আন্তঃসম্পর্কের দিকে যাত্রা: সংলাপ, একাত্মতা, সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ, পারস্পকিতার মনোভাব, ইত্যাদি।

(৪) এক হওয়ার জন্য তৃণমূলে যাত্রা:

ð গণতান্ত্রিক/গণমাত্রিক/গণমানুষের প্রতি মনোযোগ ও মন-মানসিকতার দিকে যাত্রা;

ð দরিদ্রদের দিকে যাত্রাঃ বিগত শতবর্ষে পাঁচটি ধাপে এই যাত্রাটি চলছে:

(ক) দরিদ্রদের আর্থিক উন্নয়ন, (খ) দরিদ্রদের মানবব্যক্তির উন্নয়ন (সমন্বিত), (গ) উন্নয়নের কর্তা দরিদ্ররা নিজে, (ঘ) দরিদ্রদের সাথে একাত্মতা, (ঙ) দরিদ্রদের জীবন গ্রহণ।

ð প্রকৃতি ও পরিবেশের দিকে যাত্রা: যান্ত্রিক প্রযুক্তি থেকে সৃষ্টিতে নিহিত সহজ-সরল প্রযুক্তির প্রতি মনোযোগ।

(৫) বিশ্বায়নের যুগে এক হওয়ার যাত্রায় দুটো নেতিবাচক অভিজ্ঞতা:

ð ব্যক্তির স্বকীয়তা লঙ্ঘন, ছোট বা ক্ষুদ্রের স্বকীয়তা ও মর্যাদা বিনষ্ট হচ্ছে (অমানবিকতা/ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকার)

ð সামাজিকতা লঙ্ঘন; এককভাবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা (পারস্পরিকতার অভাব)

(৬) এক হওয়ার যাত্রায় ধর্মের করণীয়:

উপরোক্ত “এক হওয়া” বা “মিলন”-এর যাত্রা ও ধারাসমূহে ধর্ম যদি বিরোধিতা করে তা হলে কঠিন আকার ধারণ করবে; অতীত মানব-ইতিহাস তার সাক্ষি (যুদ্ধ, সংঘাত, সহিংসতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গীবাদ, ইত্যাদি। আর অপরদিকে ধর্ম যদি এক হওয়ার ও মিলনের পক্ষে থাকে, উদ্বুদ্ধ করে ও প্রেরণা যোগায়, তাহলে ধর্ম গোটা মানবজাতিকে মিলন-সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা দান করতে পারে।

সুতারাং বর্তমান বিশ্বায়ন যুগে এক হওয়া বা মিলনের জন্য খ্রিষ্টমন্ডলীর যাত্রা হবে খ্রিস্টকেন্দ্রিক ও খ্রিষ্ট  নির্দেশিত যাত্রা: “তারা যেন এক হয়”। খ্রিষ্টমন্ডলীর ঐক্য প্রচেষ্টার জন্যও প্রথমতঃ তৃণমূল থেকে শুরু করতে হবে, যেখানে থাকবে: খ্রিষ্ট কেন্দ্রিক ব্যক্তি জীবন, পরিবারিক, সামাজিক, মাণ্ডলিক এবং আভ্যন্তরীণ জীবনসাধনা এবং খ্রিস্টীয় সাংগঠনিক অবকাঠামো ও বাণী প্রচার।

 খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের জন্য এক হওয়ার অর্থ কী

“তারা যেন এক হয়” যিশুর এই প্রার্থনা হচ্ছে খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের প্রধান মিশন। জগতের জন্য ঐশ-পরিকল্পনা ও ঐশ-অনুগ্রহের ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা খ্রিস্ট-নির্দেশিত মিলনের পথ ধরে চলছি, যেন একদিন যিশুর প্রার্থনা আমাদের মধ্যে সত্য হয়ে ওঠে। মণ্ডলী হচ্ছে কৈনোনিয়া/কমূনিয়ন অথবা মিলন-সমাজ। বাস্তবতায় মণ্ডলী তাঁর খ্রিষ্ট বিশ্বাস, সংস্কারীয় জীবন ও যাজকীয় সেবাকাজের বন্ধনে অবস্থান ক’রে পূর্ণ কৈনোনিয়া/কমূনিয়নের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে, যা হচ্ছে খ্রিষ্টীয় ঐক্য প্রচেষ্টার প্রধান লক্ষ্য।

খ্রিষ্ট  মণ্ডলী যে কৈনোনিয়া বা কমূনিয়ন তার গভীর ভিত্তিমূল হচ্ছে পবিত্র ত্রিত্ব: পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার মধ্যে ঐক্য বা মিলন। মানুষের ভুল-ভ্রান্তি ও দোষ-অপরাধের ফলে মণ্ডলীতে এসেছে বিচ্ছিন্নতা। তবে সব মণ্ডলী বা মাণ্ডলিক সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সত্যের সহভাগিতাও রয়েছে। খ্রিষ্ট যিশুর আত্মা সেই সত্যকে পরিত্রাণের সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

তথাপি খ্রিষ্টীয় ঐক্য বা মিলনের যে ধরনগুলো বর্তমানে আমাদের আছে তাতে কোন খ্রিষ্ট ভক্তই পূর্ণভাবে তৃপ্ত থাকতে পারে না। ঈশ্বরের অনুগ্রহ সকল মণ্ডলী ও মাণ্ডলিক সম্প্রদায়সমূহকে উদ্বুদ্ধ করছে যেন যে বিচ্ছিন্নতা আমরা অতীত থেকে লাভ করেছি তা যেন আমরা জয় করি এবং নতুন মিলন ও ঐক্য গড়ে তুলি। এই মিলন আসবে অনুতাপের মধ্য দিয়ে, অতীত ও বর্তমান অনৈক্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ক’রে এবং ঐশতাত্ত্বিক সংলাপ ও পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে।

বর্তমান মহামারি দুর্যোগকালে এক হওয়ার জন্য প্রার্থনা

যিশুর প্রার্থনা “তারা যেন এক হয়” এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে ইতিমধ্যে চলমান অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে বা ভবিষ্যতে অনেক সম্ভাব্য ক্ষেত্রও উম্মুক্ত আছে। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনার করার সুযোগ এখানে নেই। তবে বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আমাদের এই প্রার্থনা-অনুষ্ঠান যিশুর প্রার্থনারই প্রতিফলন। এই বিষয়ে কয়েকটি ধ্যান আপনাদের সাথে সহভাগিতা করছি।

বিগত আটমাস ধরে করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারি কালে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমরা যা উপলব্ধি করছি সেই বাস্তবতাকে একটি শব্ধ দিয়ে প্রকাশ করা যেতে পারে, আর তা হল: “মিলন” বা “কমূনিয়ন”, যার অর্থ হচ্ছে “এক হওয়া” বা যিশুর প্রার্থনায় যেমন আছে: “তারা যেন এক হয়”। বর্তমান বাস্তবতার মধ্যে মিলন বা এক হওযার ধারায় নেতিবাচক ও ইতিবাচক উভয় অভিজ্ঞতাই আমাদের আছে, অর্থাৎ একদিকে আছে মিলনের শুভ চিহ্ন বা নিদর্শন, আবার অন্যদিকে আছে মিলনের অভাব।

(ক) মিলন বা “এক হওয়ার” ত্রিমাত্রিক সমন্বিত ধারা:

মিলন অথবা এক হওয়ার মধ্যে আছে ত্রিমাত্রিক ধারা: (১) ঈশ্বরের সাথে এক হওয়া; (২) মানুষের সাথে এক হওয়া; (৩) প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে এক হওয়া। এই তিনটির মধ্যে নিহিত রয়েছে মিলন বা এক হওয়ার অন্য সকল দিক:

(১) ঈশ্বরের সাথে এক হওয়া : এর মধ্যে আছে মানুষের প্রতি ঈশ্বরের ভালবাসা উপলব্ধি এবং ঈশ্বরের প্রতি মানুষের ভালবাসা যা প্রকাশ পায়: ঐশবাণী, প্রার্থনা ও উপবাস; মিলন, একাত্মতা ও বিশ্বস্ততা; উপাসনা, কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা; দয়া, ক্ষমা ও সুস্থতা, আত্মিক মুক্তি ও পরিত্রাণ, ইত্যাদির মাধ্যমে।

(২) মানুষের সাথে এক হওয়া : মানুষের প্রতি, বিশেষভাবে দীনজনদের প্রতি, মানুষের একাত্মতা; এর ফলে আসে মানবিক সম্পর্ক, ন্যায্যতা ও ভ্রাতৃত্ব; মিলন, একাত্মতা ও শান্তি; ক্ষমা, দয়া ও সাহায্য-সহযোগিতা; মমতা, বিন্রতা ও সেবা, ইত্যাদি।

(৩) প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে এক হওয়াঃ জগৎ ও প্রকৃতির সাথে এক হতে হলে প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হবে যে, সবকিছু ঈশ্বরের সৃষ্টি, আর তিনি হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা। জগৎসৃষ্টি ও প্রকৃতিগত পরিবেশের সাথে একাত্মতা স্বীকার করার অর্থ হচ্ছেঃ মানুষ আমরা, প্রকৃত মালিক নই, বরং কর্মচারী। ঈশ্বরের বিশ্বস্ত কর্মচারী হয়ে সৃষ্টিকে ভালবাসা, তার যত্ন নেওয়া ও তার সুরক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব; সকল প্রকার অপব্যবহার, অপচয় ও দূষণ থেকে প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য, ইত্যাদি।

বর্তমান করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে, আজকের এই বৈশ্বিক প্রার্থনা-অনুষ্ঠানে আমাদের প্রার্থনা হচ্ছে: আমরা যেন পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার সঙ্গে এক হতে পারি; আমরা যেন সকল মানুষের সঙ্গে, বিশেষভাবে দীন ভাইবোনদের সঙ্গে এক হতে পারি; এবং সর্বসাধারণের বসতবাড়ি আমাদের এই ধরিত্রীর সকল সৃষ্টির সঙ্গে এক হতে পারি।

(খ) বর্তমান দুর্যোগে আমাদের জন্য যিশুর প্রার্থনা

বর্তমান বৈশ্বিক দুর্যোগকালে, বিভিন্ন মণ্ডলী থেকে এসে শুধু আমরাই একত্র হয়ে প্রার্থনা করছি তা নয়, বরং যিশু আমাদের সঙ্গে এক হয়ে আমাদের জন্য প্রার্থনা করছেন। এটা বড়ো আনন্দময় উপলব্ধি, এই আনন্দ সুসমাচারের আনন্দ। যিশুই আমাদেরকে এক করেন, তিনিই আবার আমাদের জন্য প্রার্থনা করছেন। প্রার্থনা করছেন যেন বর্তমানের বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতিতে, সব মানুষ, সমাজ ও জাতি একত্রিত হয়ে, মানুষের আর্তনাদ, চিৎকার ও আবেদন পিতার কাছে তুলে ধরে; এবং সম্মিলিত কণ্ঠে, সবাই এক হয়ে, মিলন ও এক হওয়ার জন্য প্রার্থনা করে। আমরা বারংবার শুনি আমাদের জন্য পিতার কাছে যিশুর আকুল প্রার্থনা: “তারা যেন এক হয়”।

(গ) করোনায় আক্রান্ত ও অসুস্থতদের সঙ্গে একাত্মতা।

যে-পৃথিবীতে আমরা বাস করছি সেই পৃথিবী নানাভাবে অসুস্থ। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ অসুস্থতায় ভুগছে। এই প্রথিবীর যত্ন নিতে, অসুস্থ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিতে মানুষ অক্ষম, অপারগ ও অসমর্থ। অথচ যুদ্ধ করতে, যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন করতে, সহিংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে মানুষ খুবই সম্পদশালী ও দক্ষ। প্রকৃতি ও পরিবেশ কতোভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, কতো মানুষ সংক্রামিত হচ্ছে ও কতো মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে প্রতিদিন। অসুস্থ পৃথিবী ও অসুস্থ মানুষের সঙ্গে এক হয়ে আমরা প্রার্থনা করছি। আমরা অসমর্থ, কিন্ত আমরা প্রার্থনা করছি যেন যিশু আমাদের জন্য পিতার কাছে তাঁর যাজকীয় প্রার্থনা উচ্চারণ করেন।

(ঘ) প্রত্যাশায় এক হওয়া:

সাম্প্রতিক করোনা-আক্রান্ত দুর্যোগকালে “এক হওয়া” বা “মিলন”-এর নিদর্শন ও তার অভাব যেমন লক্ষণীয়, ঠিক তেমনি আরেকটি নিদর্শনও সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়, আর তা হল “প্রত্যাশা”। দুর্যোগের এই কঠিন মুহূর্তে অনেক ভালোর সন্ধান মিলছে যা মানুষকে প্রত্যাশী ক’রে তুলছে। এখানে সকল ধর্ম, বিশেষভাবে খ্রিস্টধর্ম ইতিবাচক দিকগুলো সংগ্রহ করছে এবং ভবিষ্যতে “মিলনের” পথ চিহ্নিত করে মানুষকে আশান্বিত এবং উদ্বুদ্ধ করছে। অতএব খ্রিষ্ট বিশ্বাসী আমরা, সুসমাচারজনিত প্রত্যাশার পথ ধরে “এক হওয়ার” যাত্রায় ভবিষ্যতেও নিবিষ্ট থাকব।

সমাপন প্রার্থনা:

হে প্রভু যিশু, বর্তমান বিশ্বায়ন জগতে যখন দেখা যাচ্ছে মিলন ও এক হওয়ার একাধিক ধারা, ঠিক সেই মুহূর্তে তুমি তোমার বিশ্বাসী শিষ্যদের জন্য পিতার কাছে প্রার্থনা করে বলছ: “তারা যেন এক হয়”।

সুসমাচারে আজ তোমার প্রার্থনা ও বাণী আমরা শ্রবণ ও ধ্যান করেছি। বর্তমান কালে তুমি চাও যেন আমরা আমাদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে, এক হয়ে ও মিলনের পক্ষে কাজ করে, গোটা মানবজাতিকে মিলন-সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করি।

প্রভু যিশু, তোমাতে অবগাহিত হয়ে আমরা, বিভিন্ন মণ্ডলীর সবাই, তোমার পিতার সন্তান হয়েছি। অবগাহন বা দীক্ষাস্নান দ্বারা, আমাদের মধ্যে যে ঐক্য দিয়েছ তা যেন বিশ্বাসে, সম্পর্কে ও সেবাকাজে দৃশ্যমান করে তুলতে পারি এবং পূর্ণভাবে এক হওয়ার লক্ষ্যে পবিত্র আত্মার সহায়তায় পথ চলতে পারি।

প্রভু যিশু, বিন্রতার সাথে স্বীকার করি যে, আমাদের মধ্যে মিলন ও একতার অনেক ঘাটতি আছে। আমাদের মধ্যে থাকা বিচ্ছিন্নতার কারণ যদি আমরা হয়ে থাকি, তার জন্য অনুতপ্ত অন্তরে ক্ষমা চাই। ক্ষমা দিয়ে আমাদের পুনর্মিলিত কর। আমাদের নম্রতা দিয়ে তুমি অন্যের সঙ্গে আমাদের এক কর।

প্রার্থনা করি প্রভু : আমরা যেন তোমার সঙ্গে এবং তোমার পিতা ও আত্মার সঙ্গে এক হয়ে বাস করতে পারি; আমরা যেন সকল মানুষের সঙ্গে, বিশেষভাবে দীন ভাইবোনদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে জীবন যাপন করতে পারি; এবং সর্বসাধারণের বসতবাড়ি আমাদের এই প্রিয় ধরিত্রীর সকল সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা ও যত্ন দিয়ে সুরক্ষা করতে নিষ্ঠাবান হতে পারি।

বর্তমান মহামারিতে যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের সঙ্গে এক হয়ে, তাদের জন্য তোমার সুস্থতা কামনা করি। সকল বিচ্ছিন্নতা ও বিভিন্নতার মধ্যে তোমাকে ভিত্তি ও কেন্দ্র করে আমরা যেন এক হয়ে মিলনসমাজরূপ মণ্ডলী গড়ে তুলতে পারি। প্রার্থনায় যেন আমরা এক থাকতে পারি। তোমারই নামের গুণে এই প্রার্থনা করি। আমেন।

পরিসমাপ্তিতে আমি বলতে চাই যে: আমাদের প্রার্থনা হোক যিশুর প্রার্থনা; আমাদের প্রার্থনা হোক আগামী দিনের মিশন; আমাদের প্রার্থনা হোক “এক হওয়ার” প্রত্যাশা।

“প্রভু যিশু খ্রিস্টেও অনুগ্রহ, পিতা ঈশ্বরের প্রেম এবং পবিত্রতা একাত্মতা আপনাদের মধ্যে বিরাজ করুক।” আমেন ।

“গ্লোবাল প্রেয়ার ফেলোশিপ” কর্তৃক আয়োজিত “গ্লোবাল প্রেয়ার ওয়ারিয়র কনফারেন্স (২) জুম কনফারেন্সে উপস্থাপিত বক্তব্য “আমরা যেমন এক, তারাও যেন তেমনি এক হয়” (যোহন ১৭:১১), ১লা আগস্ট, ২০২০।

ad