শিরোনাম :
আর্চবিশপ মজেস কস্তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া খ্রিষ্টযাগের উপদেশ
|| কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসি ||
আমার দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য তা জানি না। তবে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ১১ই জুন প্রয়াত বিশপ যোয়াকিম রোজারিও, সিএসসি-এর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে এবং আজ ২০২০ খ্রিস্টাবে জুলাই ১৪ তারিখে, দুই যুগ পর, সদ্য-প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস মন্টু কস্তা, সিএসসি-এ অন্তেষ্ট্যিক্রিয়া- খ্রিষ্টযাগে আপনাদের সাথে একাত্ম হয়ে, আমাকে পৌরহিত্য করতে হচ্ছে এই খ্রিষ্টযাগে । আমাকে এই সুযোগদানের জন্য কৃতজ্ঞ। বিশপ যোয়াকিম ছিলেন আমার গুরুস্থানীয় ব্যক্তিত্ব আর আর্চবিশপ মজেস ছিলেন উচ্চ সেমিনারীতে এবং পবিত্র ক্রুশসংঘের গঠনগৃহে আমার ছাত্র, ও পরবর্তীতে আমার সহকর্মী, সহযোগী ও সহসাথী ভ্রাতা-বিশপ।
প্রায় সত্তর বছর আগে ঢাকা ধর্মপ্রদেশের তুমিলিয়া ধর্মপল্লীতে সুন্দর একটি কাথলিক পরিবারে তার জন্ম হয় ১৭ই নভেম্বর, ১৯৫০ সনে। পিতামাতা ও ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তিনি খ্রিস্টীয় গঠন লাভ করেন। পরিবারের সকলের প্রতি জানাই আমাদের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি বান্দুরার ক্ষুদ্র পুষ্প সেমিনারী এবং সেন্ট যোসেফ সেমিনারীতে ছিলেন। নটরডেম কলেজ থেকে বি.এ. পাস করার পর ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র ক্রুশ সংঘে প্রবেশ করেন।
আর্চবিশপ মজেস ৪৩ বছর পূর্বে পবিত্র ক্রুশসংঘে যোগদান করেন। ৩৯ বছর পূর্বে তিনি পুরোহিত হন। ধর্মপল্লীতে কয়েকবছর পালকীয় কাজ করার পর, আর্চবিশপ মজেস ৬ বছর পালকীয় ঐশতত্ত¡ ও আধ্যাত্মিকতা এবং মনোবিজ্ঞান ও পরামর্শদান বিদ্যায়, রোম থেকে দুটো লাইসেনসিয়েট বা এসটিএল ডিগ্রী লাভ করেন। দশ বছর ধরে উচ্চ সেমিনারীর অধ্যাপক, পরিচালক ও পবিত্র ক্রুশ সংঘের গঠনগৃহের পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এই ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি তার জ্ঞান, মেধা, দক্ষতা ও সাফল্য। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মণ্ডলীতে তিনি ছিলেন প্রথম, প্রধান এবং পারদর্শী একজন আধ্যাত্মিক বিশেষজ্ঞ। বহুবছর আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে ও আধ্যাত্মিক পরমর্শক গঠনে বাংলাদেশের ফাদার, ব্রাদার ও সিস্টারদের গঠন দান করেছেন।
বিগত একটি মাস ধরে আমার সৌভাগ্য হয়েছে করোনা ভাইরাসের মহামারির দুর্যোগে, আর্চবিশপ মজেসের সাথে অসুস্থতায় একাত্ম হয়ে, একই সময়ে, একই হাসপাতালে, একই রোগে আক্রান্ত হয়ে, বাংলাদেশ মণ্ডলী, এমনকি তারও বাইরের কতো মানুষের ভালবাসা, সমর্থন ও প্রার্থনার ফলশ্রুতিতে, এবং সর্বোপরী ঈশ্বরের দয়া, করুণা, ও নিরাময় লাভ করে আমরা উভয়েই সুস্থ হলাম। আমি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেলাম আর আর্চবিশপ মজেস হঠাৎ করে আরেকটি কঠিন রোগে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে একাধিকবার স্ট্রোক হয়, এবং শেষ পর্যান্ত গতকাল সকাল ৯:২০ মিনিটে স্কয়ার হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
চট্টগ্রাম ডাইয়োসিসের কর্তৃপক্ষ ও সেবাকারীদের সাথে এক হয়ে, স্কয়ার হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ও ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের সহযোগিতায়, অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে জীবিত অবস্থায় এ বাড়ীতে আর ফিরিয়ে আনা গেল না। গোটা মণ্ডলীর পুরোহিত, সন্ন্যাসব্রতী ও ভক্তজনগণ, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঈশ্বরের কাছ থেকে একটি অলৌকিক নিদর্শন প্রত্যাশা ক’রে অবিরত প্রার্থনা করছিলেন। কিন্তু একজনের কথা অনুসারে ঈশ্বর যেন আমাদের কানে ফিসফিস করে বলে দিলেন: “তোমার ইচ্ছা ও আমার ইচ্ছা এক নয়।”
বিশপ শরৎ এবং আমি অন্যান্য নার্সদের সাথে হাসপাতালে তার পাশে কিছু সময় প্রার্থনায় কাটানোর পর, আর্চবিশপ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, আর এখন তাঁর মৃতদেহটিকে ঘিরে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জ্ঞাপন করতে এসেছি। আমাদের জন্য তিনি যা ছিলেন, যা করে গেছেন, যা রেখে গেছেন, তা স্মরণ করে করে, পরমেশ্বরের প্রশংসা এবং আর্চবিশপের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এবং তাঁর জন্য অনন্ত শান্তি কামনা করতে আমরা সমবেত হয়েছি। প্রভু পরমেশ্বর, তোমার এই প্রিয় সেবককে তোমার আত্মিক নিরাময় ও চির-সান্নিধ্য দান করো।
মঙ্গলসমাচার পাঠে বর্ণিত যিশুর যাজকীয় প্রার্থনা নিজের করে নিয়ে, আমাদের প্রিয় যাজক, প্রবক্তা ও পালক, আর্চবিশপ মজেস পিতার কাছে প্রার্থনা করে বলছেন: “তুমি আমাকে যে-কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছিলে, আমি তা সম্পন্ন করেছি!” কি দায়িত্ব যিশু আর্চবিশপকে দিয়েছিলেন? কোন কোন দায়িত্ব তিনি সম্পন্ন করেছেন।
ধর্মপাল: বিগত ২৪ বছর ধরে, ১৯৯৬ থেকে আজ পর্যন্ত তিনি প্রথমে ১৫ বছর দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশে এবং বৃহত্তর চট্রগ্রাম ধর্মপ্রদেশে ৬ বছর তিনি ধর্মপাল ছিলেন। তার পরিচালনায় ও পরিশ্রমে চট্টগ্রামকে আর্চডায়োসিস হিসেবে নির্মাণে এক বিরাট ভ‚মিকা রেখে, বিগত আড়াই বছর ধরে চট্টগ্রাম মহাধর্মপ্রদেশের মহাধর্মপাল রূপে, নিরলসভাবে, দৃঢ়তার সাথে এবং কষ্টভোগী সেবক হিসেবে ধর্মপ্রদেশের সামগ্রিক ও সমন্বিত উন্নয়নে কাজ ও সেবা করে গেছেন। ধর্মপাল হিসেবে তিনি ছিলেন যাজক, মানুষকে পবিত্রীকরণের সেবা করেছেন; তিনি ছিলেন প্রবক্তা, ঈশ্বরের কথা মানুষের কাছে ব্যক্ত করেছেন নানা বিষয়ে শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে; তাঁর ছিল রাজকীয় দায়িত্ব, যার মধ্য দিয়ে তিনি প্রশাসন, পরিচালন ও সেবার কাজ করে গেছেন।
সিবিসিবি ও বাংলাদশে মণ্ডলী: বিগত ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত, আর্চবিশপ মজেস কস্তা, বাংলাদেশের কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই দায়িত্বের সুবাদে, তিনি সিবিসিবি-এর যুব কমিশনের প্রধান হয়ে তাদেরকে গঠন ও পরিচালনা দান করেছেন। বহু বছর সেমিনারী কমিশনের সভাপতি হয়ে কাজ করেছেন। উপাসনা কমিশনের সভাপতি হয়ে, উপাসনা-অনুষ্ঠানে এনেছেন নবায়ন ও নতুন প্রকাশনা। সিবিসিবি-এর সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে, সিবিসিবি-এর ১৪টা কমিশন ও সংগঠনের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেনদ; এবং প্রতিবছর বিশপদের সহ উক্ত কমিশন ও সংগঠনের কর্মকর্তা, সিবিসিবি সেক্রেটারিটের টিম কর্তৃক বার্ষিক সভা পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, প্রতিবেদন গ্রহণ, পরিচালনা ও বাস্তবায়নের কাজ খুব শান্তভাবে, সমঝোতার সাথে, প্রাবক্তিক ও আধ্যাত্মিক নির্দেশনা দান ক’রে, অনেক দক্ষতা নিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করে আসছেন। আজ গোটা বাংলাদেশ মণ্ডলী ও কাথলিক বিশপগণের পক্ষ থেকে আমি আর্চবিশপ মজেস কস্তাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই, তার অবদানের জন্য সাধুবাদ জানাই এবং প্রকাশ করি আমাদের মাঝে তার অনুপস্থিতির বেদনা ও শূণ্যতা এবং তাকে হারিয়ে মণ্ডলী কতো ক্ষতিগ্রস্থ।
দরিদ্রদের প্রতি তার ভালবাসা: প্রিয়জনেরা, প্রথম শাস্ত্রপাঠ অনুসারে, ইসাইয়া প্রবক্তার মতো আর্চবিশপ কতবার উচ্চারণ করছেন: “প্রভুর আত্মিক প্রেরণা আমার ওপর নিত্য অধিষ্ঠিত, কেন না তিনি আমাকে প্রেরণ করেছেন যত দীনজনের কাছে মঙ্গলবার্তা প্রচার করতে, ভগ্ন হৃদয় যারা, তাদের ক্ষতস্থান বেঁধে দিতে, বন্দীর কাছে মুক্তি আর কারারুদ্ধদের কাছে নিষ্কৃতির কথা ঘোষণা করতে।” তাঁর এই ভালবাসা তিনি প্রকাশ করেছেন যারা সমাজে ক্ষুদ্র, অবহেলিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত শ্রেনী ও জাতিগোষ্ঠির বেলায় পক্ষ নিয়ে এবং ব্যক্তিগতভাবে যাদের হৃদয় ছিল ভগ্ন, নানা ক্ষত ও সমস্যায় জর্জরিত তাদের সহযাত্রী হয়ে তাদের পরামর্শ দিয়ে।
মিশনারি ও বাণীপ্রচারক: ধর্মপাল হিসেবে তিনি সর্বদাই মিশনারি বিশপ ছিলেন এবং বাণী প্রচার কাজে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন, যেমন দিনাজপুরের ধর্মপাল থাকাকালীন সময়ে, তেমনি চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশে, বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জন্য। দিয়াঙে খ্রিষ্টানদের ৫০০ বছরের আগমন ঘটনার উৎসব করতে গিয়ে প্রত্যেক খ্রিষ্টভক্ত যে মিশনারি ও বাণীপ্রচারক তা তিনি সোচ্চার হয়ে সবার কাছে ব্যক্ত করেছেন। চট্টগ্রাম মহাধর্মপ্রদেশের ধর্মপালরূপে, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে এবং ২০২০ খ্রিস্টাব্দে দুটো পালকীয় পত্র প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন: “আমরা প্রেরণের ফসল, প্রেরণ আমাদের আহ্বান” এবং “খ্রিষ্টে আমার/আমাদের পরিচয়”। এই দুটো পালকীয় পত্রে আমরা লক্ষ্য করি তার মিশনারী মন। অতীতে মিশনারী কাজের সাক্ষ্য তিনি তুলে ধরেছেন, দীক্ষার বলে খ্রিষ্টের মতো মিশনারী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, এবং বাণী প্রচারের নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। গোটা চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশ তথা বাংলাদেশ মণ্ডলী, আর্চবিশপের এই অবদান কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতে পারে।
কষ্টভোগী সেবক ও অসুস্থদের সাথে একাত্মতা: ধর্মপালের গোটা জীবন ধরে, বিশেষভাবে বিগত কয়েকটি বছর আর্চবিশপ মজেসের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করেছি যে, তিনি একজন কষ্টভোগী সেবক। “প্রিয়জনেরা, এখন তোমাদের জন্যে আমি যে দুঃখকষ্ট ভোগ করছি, তাতে আমি কিন্তু আনন্দই পাচ্ছি। যে দুঃখক্লেশ ভোগ করতে খ্রিষ্টের এখনও বাকি আছে, আমি তো এই ভাবে আমার নিজের দেহে তা সাধ্যমতো পূরণ ক’রে দিচ্ছি তাঁরই দেহের জন্যে, অর্থাৎ মণ্ডলীর জন্যে।” (কলসীয় ১:২৪)। সাধু পলের এই কথাটি তাঁর পালকীয় সেবাকাজে যেমন সত্য হয়ে উঠেছে, তেমনি সত্য হয়েছে করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে অসুস্থতা ও মৃত্যু বরণ করে।
বর্তমান করোনা ভাইরাসের দুর্যোগকালীন সময়ে দেশ-বিদেশে কত অসুস্থ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এবং তাদের জন্য “পালক” হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে এই ধ্যানটি আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর্চবিশপ মজেসের সাথে অসুস্থতার সময় বিশেষভাবে একাত্মতা অনুভব করেছি। ঈশ্বরের করুণায় আমি সুস্থ হয়ে, প্রভুতে আনন্দ এবং তাঁর প্রশংসা করতে করতে বাড়ী ফিরে গেছি । আর আমার সহযাত্রী আর্চবিশপ মজেসকে ঈশ্বর নিয়ে গেলেন তাঁর নিজের বাড়ীতে। বর্তমান দুর্যোগে সকল অসুস্থদের সাথে একাত্ম হয়ে তাঁর এই মৃত্যু বাংলাদেশ মণ্ডলীর ইতিহাসে স্মরণীয়, এক মহান নিদর্শন ও উজ্জ্বল সাক্ষ্য হয়ে থাকবে। এ মুহূর্তেও আবার ঈশ্বরের কথা কানে ভেসে আসে: “তোমার চিন্তা আর আমার চিন্তা এক নয়।”
যিশুর সাথে এক হয়ে প্রয়াত আর্চবিশপের যাজকীয় প্রার্থনা কতোই না সত্য: “তুমি এখন তোমার পাশে সেই মহিমার আসন দিয়ে আমাকে মহিমান্বিত কর! ”
কাথিড্রাল গির্জা, চট্টগ্রাম, ১৪ জুলাই, ২০২০