শিরোনাম :
আর জ্বালবে না আলো: খুলনায় আলোঘর প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেল!
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সিকোর্স ক্যাথলিক ও কারিতাস ফ্রান্সের আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত কারিতাসের আলোঘর (লাইটহাউজ) প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক সমাপনী ঘোষনা করা হয়েছে।
গত বৃহষ্পতিবার কারিতাস খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ে খুলনা আলোঘর প্রকল্পের পক্ষ থেকে প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠানে এ ঘোষনা দেয় কতৃপক্ষ। তাই চুক্তি অনুযায়ী ৩১ মার্চের পর আর আলো জ¦লবে না আলোঘর বা লাইটহাউজ নামে পরিচিত এই শিশুশিক্ষা প্রকল্পে।
উক্ত সমাপনী অনুষ্ঠানে আলোঘর প্রকল্পের সাত বছরের সফলতা নিয়ে আলোচনা করা হয়। আলোঘর প্রকল্পের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক জেমস সুকুমার মন্ডল প্রজেক্টরের মাধ্যমে এ কার্যক্রম উপস্থাপন করেন। এসময় প্রকল্পের শিক্ষার্থীরা সহ বাক ও শ্রবন প্রতিবন্ধী শিশুরা নৃত্য পরিবেশন করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অথিতি ছিলেন খুলনা ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল বিশপ জেমস রমেন বৈরাগী, বিশেষ অতিথি (সুপারিনটেনডেন্ট পিটিআই খুলনা) স্বপন কুমার বিশ^াস, প্রোগ্রাম ম্যানেজার কারিতাস ঢাকা’র নোয়েল গোনছালবেছ, মোড়েলগঞ্জ নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম বাচ্চু। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কারিতার খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক দাউদ জীবন দাশ।
কারিতাস খুলনার একটি প্রতিবেদনে জানা যায় প্রকল্পটি ২৭ নভেম্বর ২০১১ খ্রিঃ থেকে শুরু হয়ে ৩১ মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত সাত বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিল। আলোঘর (লাইটহাউজ) প্রকল্পের আওতায় খুলনা জেলার ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলা। সাতক্ষীরা জেলার সদর, তালা, কলারোয়া, কালিগঞ্জ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা। বাগেরহাট জেলার মোংলা, রামপাল, শরনখোলা ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলা। চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলা ও মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর ও গাংনী উপজেলা সহ মোট ৫টি জেলার ১৮টি উপজেলার ৪৭টি ইউনিয়নের ৯৮টি গ্রামে মোট ৯৮টি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এ প্রকল্পের উপকারভোগীর সংখ্যা পরোক্ষভাবে ৭,৭৬৬ জন এবং নিয়মিত ও অনিয়মিত মোট ১৫০ জন কর্মী কাজ করছে। দাতা সংস্থার অনুদানে এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৭২ লক্ষ ২১ হাজার ২৬৭ টাকা।
প্রধান অতিথি বিশপ রমেন বলেন, “বর্তমান সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যপক ভ’মিকা রেখেছে তাই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হতাশ হবার প্রয়োজন নেই। দাতা সংস্থা তাদের অর্থায়ন সরকারি খাতে অব্যাহত রাখবে। আশা করি সরকার এধরনের আনেক প্রকল্প হতে নিয়ে তা ভালোভাবে পরিচালিত করবে। কারিতাস সরকার ও বঞ্চিত মানুষের প্রয়োজনে পাশে থেকে সহযোগীতা করবে আশা করি। ”
এদিকে সাত বছরে অনেক সফলতা আছে এই আলোঘরের। ২০১৭ সালে পিইসিই পরীক্ষায় পাশের হার ৯৭% এবং ১০০% উত্তীর্ন শিক্ষার্থী পাশর্^বতী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। সক্রিয় শিক্ষন শিখন পদ্ধতির মাধ্যমে আনন্দদায়ক শিখন পরিবেশ হওয়ায় অতি দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার অভ্যাস বৃদ্ধি পেয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে প্রতিবন্ধী শিশুদের পিতা-মাতা বিবিন্ন সামাজিক বিষয়ে সচেতন হয়েছে যেমন- শিশুশ্রম, বাল্য বিবাহ, শিশু অধিকার ও শিশু সুরক্ষা, দূর্যেগ ব্যপস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন, শিশুর যতœ, প্রতিবন্ধীতা, নিরাপদ পানীয় জল, স্বাস্থসম্মত পায়খানা ইত্যাদি। শিক্ষাকেন্দ্র স্থায়িত্বশীলতার জন্য ৯৮ টি শিক্ষাকেন্দ্রর মধ্যে ৪২টি শিক্ষাকেন্দ্রর ইএমসি ও স্থানীয় জনগনের সহায়তায শিক্ষাকেন্দ্রের নামে ব্যাংক হিসাব খুলেছে এবং তহবিল বৃদ্ধির চেষ্ঠা করেছে। আমাশুনি ও দঃ বড়দল শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি ২০১৬ খ্রি: ডিসেম্বরে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কমিটি ও কমিউনিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করার পর তাদের প্রচেষ্ঠায় ২০১৭ খ্রি: তা জাতীয়করণ করা হয়েছে।
মাড়েলগঞ্জ নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম বাচ্চু বলেন, “আমাদের থানায় কারিতাস যেখানে লাইটহাউজ করেছে সেখানে স্কুলে বসে সুন্দরবনের বাঘ হরিণ দেখা যায় যেখানে আবস্থিত শিশুদের লেখাপড়া করা ছিল একটা দুরহ কাজ।” তিনি আরও বলেন এখানে সল্প সম্মানীতে শিক্ষকরা যে পরিশ্রম দিয়েছে আমি নিজে দেখে এসেছি তা অনেক সরকারি স্কুলের শিক্ষরাও অনেক উচ্চ বেতনে ও সে কাজ বা পরিশ্রম করেনা।”
বর্তমান খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক দাউদ জীবন দাশ বলেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সিকোর্স ক্যাথলিক আর্থিক সহযোগিতায় সারা বাংলাদেশে সেভ দ্যা চিলড্রেন, ১৮টি এনজিওর সমন্নয়ে ঢাকা আহছানিয়া মিশন ও কারিতাস এ প্রকল্প পরিচালনায় বরাদ্দ পায়। শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে কারিতাস। তিনি আরও বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামে আমাদের এই শিশুকেন্দ্র শিক্ষা দিয়ে আসছে। কারিতাস স্বপ্ন দেখায় না স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়। ১৯৬৭ সালে শিক্ষা ও স্বাস্থ কার্যক্রম নিয়ে এদেশে সেবাকাজ শুরু করে। ৭১ পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর নতুন বাংলাদেশ বির্নিমানে কারিতাস তার ভ’মিকা পালন করেছে। সরকারের যে ভিশন তার সাথে তাল মিলিয়ে কারিতাস এগিয়ে চলেছে সহযোগী হয়ে।
কারিতাস প্রোগ্রাম ম্যানেজার নোয়েল গোনছালবেছ বলেন,“ প্রতিটি সৃষ্টিতে একটা সংগ্রাম থাকে তবে সফলতার পর অনন্দ পাওয়া যায়। লাইটহাউজ ঠিক তেমন, তবে সারাদেশের ১০০৫টি শিশুশিক্ষাকেন্দ্রর কিছু সরকারিকরন করা হয়েছে যা আমাদের বড়একটি অর্জন। ”
সারা বাংলাদেশে প্রতন্ত্য অঞ্চলে মোট ১০০৫টি শিশুকেন্দ্র কারিতাস এ প্রকল্প ৭ বছর যাবৎ পরিচালিত করেছে। উক্ত প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠানে খুলনা জেলার বিভিন্ন শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালনা কমিটির সভাপতি, স্থানীয় মেম্বার, প্রকল্পের শিক্ষক ও অনেক শিক্ষার্থী সহ কারিতাস খুলনা অঞ্চলের সকল কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালনা কমিটি, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগন প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হতাশ। তারা চায় কারিতাস যেন প্রকল্প এই প্রকল্প বন্ধ না করে তাদের কার্যক্রম অব্যহত রখার সর্বাত্বক প্রচেষ্ঠা করে। এতে স্থানীয়ভাবে তারা সাধ্যমত সহযোগীতা প্রদানের আশ^াস দেয়। তারা জানান শিশুরা এখানে শুধু লেখাপড়া নয় নৈতিকতা ও তাদের দৈনন্দিন অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সকল বক্তারা প্রকল্পের শিশুদের আগামী দিনের চাহিদার নিরিখে প্রকল্পটি চলমান রাখার জোরদাবি জানান।
ডিসিনিউজ/আরবি.ইউএইচ. ২৭ জানুয়ারি ২০১৯