শিরোনাম :
রবীন ভাবুক || ঢাকা
বিশ্বের বর্তমান নভেল করোনারভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রকোপের ভয়াল পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় যোদ্ধা হলেন ডাক্তার এবং নার্সরা। করোনা যুদ্ধে তারাই সামনা-সামনি সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছেন। বিশ্বের সব দেশের সরকার থেকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তাদের স্বীকৃতিও মিলেছে। কিন্তু দিন শেষে একটি বিষয়ই উঠে আসছে, তা হলো: ডাক্তার ও নার্সরাও তো মানুষ। তাদেরও সামাজিক ও পারিবারিক জীবন রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে এমনই একজন করোনা বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন ডাক্তারের অভিজ্ঞতা। তিনি আমার খুব কাছের একজন মানুষ। সব সময় তিনি মানুষের সেবা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। যিনি করোনার এই প্রকোপের সময় স্বাস্থ্য সেবা দিয়েছেন অকাতরে। নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন কোভিড-১৯ ভাইরাসে। তিনি হলে ডাক্তার এডুয়ার্ড পল্লব রোজারিও।
বাংলাদেশের একটি খ্রিষ্টান হাসপাতালের ডাক্তার তিনি। তাঁর সহভাগিতার কথাগুলোই হুবহু তুলে ধরার প্রয়াস করছি:
‘বাংলাদেশ সরকার যখন মার্চের শেষ দিকে পুরো বাংলাদেশ লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে, তখন হাসপাতালগুলোর ডাক্তার আর নার্সদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ চলে আসছে। সবকিছু বন্ধ থাকলেও আমরা হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করতে পারিনি। একে তো হাসপাতাল, তার ওপর খ্রিষ্টান প্রতিষ্ঠান। দুঃস্থের সেবা প্রদান খ্রিষ্টীয় ভালবাসার বহিঃর্প্রকাশ। সুতরাং আমাদের নিয়মিত সেবা প্রদান করাই প্রধান লক্ষ্য ছিল। যদিও এই সময় রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা আমাদের জন্য ছিল সত্যিই একটি কঠিন বিষয়। একে তো হাসপাতালে অন্যান্য ডাক্তার ও কনসালটেন্ট আসা বন্ধ করে দিয়েছে, আমাদেরও পরিবার পরিজন রয়েছে। তার ওপর হাসপাতালে উপচে পড়া ভীড়। বিভিন্ন হাসপাতালও করোনা উপস্থিতিতে লকডাউনের আওতায় চলে গেছে। সব মিলিয়ে সবার হিমশিম খাওয়ার অবস্থা।
আমাদের হাসপাতাল থেকে সকলেই করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেই এক প্রকার স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া শুরু করলাম। পরিবারের সবাই দুশ্চিন্তা করছে কখন কি হয়। তারপরও তাদের সাহস ও মনোবল প্রদান আমাদের আরো উৎসাহীত করে। তবে কিছুটা ঘাটতি আমাদের ছিল। তা হলো, পিপিই, মাস্ক ও গাউন। পরবর্তীতে আমি নিজের কিছু পিপিই এবং মাস্ক সংগ্রহ করি ও হাসপাতালে অন্যান্যদের সরবরাহ করি। বাংলাদেশ ডক্টরস্ ফাউন্ডেশন এর মতে, ৫ মে পর্যন্ত এদেশে প্রায় ৫৭৪ জন ডাক্তার, ৩৫৪ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স, ৫৮ জন স্যাকমো, ১০৯ জন মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট/ওয়ার্ডবয় করোনায় আক্রান্ত এবং ১১৩ জন সুস্থ হয়েছেন।
২৫ এপ্রিল কয়েকজন রোগী আসে হাসপাতালে। তখন তারা অন্য রোগের কথা বলে এসেছিল। আমাদের কয়েকজন হাল্কা সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হয়। পরে কর্তৃপক্ষ ডাক্তার, নার্স ও স্টাফদের কোভিড-১৯’র পরীক্ষা করতে বলেন। আমরা অনেকেই সেই পরীক্ষা করি। ২৯ এপ্রিল রিপোর্ট এলো এবং সেখানে আমিসহ আরো কয়েক জনের কোভিড-১৯ পজেটিভ রিপোর্ট এলো। সকলে কিছুটা শংকিত এবং ভীতও হলো। কিন্তু কিছু করার নেই। আমরা আমাদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছি এবং তা ছিল আমাদের আত্মতৃপ্তির। যদিও পরিবারের সবাই অনেকটাই আতঙ্কিত ও মর্মাহত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমরা মনোবল দৃঢ় করলাম। এরপর ২ মে আবার কোভিড-১৯’র টেস্ট রিয়েল টাইম – পিসিআর টেস্ট মহাখালীস্থ আইইডিসিআর এ করাই, সেখানে আমার নেগেটিভ রেজাল্ট আসে। পরবর্তী ৩য় রির্পোটটিও নেগেটিভ আসে । বেশির ভাগই হাসপাতালে এবং আমিসহ কয়েকজন বাসায়ই হোম কোয়ারিন্টিন ও পরে আইসোলেশনে চলে গেলাম ১৪ দিনের জন্য। এই ১৪ দিন শুধু ১৪ টা দিন নয়, মনে হচ্ছিল ১৪টা বছর।
বাসায় গিয়ে আমার সবকিছু আলাদা করে অন্য রূমে চলে গেলাম। দূর থেকে শুধু আপনজনদের সাথে একটু বলে নিলাম আমার অবস্থান সর্ম্পকে। হয়ে গেলাম আপন ভূমে নির্বাসন। একেই মনে হয় বলা হয়, নিজ দেশে পরবাসী। যে করোনা সারা বিশ্বকেই উলোট-পালট করে দিয়েছে।
প্রথম দিকে আমার হাল্কা জ্বর হয়েছিল। এরপর শুরু হয় ডায়রিয়া। জ্বর নিয়ে বেশি না ভুগলেও ডায়রিয়া নিয়ে আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। একটু পর পর আমাকে শৌচাগারে যেতে হয়েছে। সেই সাথে একটু পর পর খাবার এবং রাইস স্যালাইন খেয়েছি। অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছি। করোনার সাথে যুদ্ধে মিশে গেছি শরীর ও মনের সাথে অন্তর্যুদ্ধে। বয়স্ক মা, স্ত্রী ও সন্তান সবাইকে নিজেই দূরে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছি আমি। সবার ভীষণ মন খারাপ। কিন্তু কিচ্ছুটি করার নেই আমার। আমাকে যে না চাইলেও মেনে নিতে হবে সবকিছু!
নিজেকে শক্ত করে সঠিকভাবে হোম কোয়ারিন্টিন এবং আইসোলেশন পালন করছি। কয়েক দিন বাদে ডায়রিয়াও সেরে গেল। এখন আমি পুরোটাই সুস্থ। কোয়ারেন্টিনের এয়োদশ দিন চলছে। আমি জয় লাভ করেছি করোনার সাথে লড়াই করে। করোনা যুদ্ধে নিজের জন্য এবং অন্যের জন্য সকল ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে লড়াই করতে হয়।’
শেষের দিকে তিনি জানালেন, কোভিড-১৯ খুব যে মারাত্মক, তা নয়। তবে প্রাণ কেড়ে নিতে পারে যেকোনো সময়। বিশেষ করে একটু এদিক-সেদিক হলে বা সুযোগ পেলেই কোভিড-১৯ নষ্ট করে দিতে পারে সাজানো জীবন। কোভিড-১৯ অন্যসব সাধারণ রোগের মতোই একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। তবে এক সাথে অনেকগুলো লক্ষণের যেমন: জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, ঠোঁট নীল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সংমিশ্রণ ঘটায়। আর এর ভ্যাকসিন নেই বা চিকিৎসা না হলেও, সঠিকভাবে সাধারণ সর্দি-জ্বর, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করলেই আক্রান্ত ব্যক্তিটি বেশীর ভাগ ৮৫% ক্ষেত্রে ডাক্তারের সাধারণ চিকিৎসায় সেরে উঠবেন। অল্পজনকেই হাসপাতালে ভর্তি থেকে সেবা নিতে হয় । আর খুব অল্প সংখ্যক জনকে হাসপাতালে আইসিইউ সার্পোট-এ থেকে সেবা নিতে হয় । এই ভাইরাস রোগের সবচেয়ে বড় ঔষধ হলো আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেই অন্যান্য ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া, মনোবল দৃঢ় করার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। তাহলে করোনা কিছুই করতে পারবে না।
করোনা বর্তমান বিশ্বে একটি আতঙ্কের নাম। এটিকে অনেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিসেবেও গণ্য করছে। হয়তো এই ভাইরাস কেড়ে নিবে বিশ্বের অসংখ্য প্রাণ। অচিরেই হয়তো এর ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হবে। তখন এটি অন্যসব সাধারণ রোগের মতোই মানুষ মনে করবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে এক হয়েই এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কারণ করোনা শুধু প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্য যুদ্ধে নামেনি, বিশ্বের উন্নত অবকাঠামোও হুমকির মুখে ফেলছে। তাই সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে। নিজে সচেতন হয়ে, সবাইকে সচেতন করতে হবে॥