ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ফিচার একটি ব্যতিক্রমী হাসপাতাল: মানবতার প্রতীক ডা. বেকার

একটি ব্যতিক্রমী হাসপাতাল: মানবতার প্রতীক ডা. বেকার

0
1002
ডাক্তার এড্রিক বেকার। ছবি : স্টেফান উত্তম (ucanews)

মানবতার মূর্তপ্রতীক ছিলেন তিনি। ছিলেন সবার হৃদয়ে, গরীবের বন্ধু হয়ে। ভিনদেশি ডাক্তার এড্রিক বেকার হয়ে উঠেছিলেন আদিবাসীদের পরম বন্ধু। পাশ্চাত্যের আধুনিকতার ছোঁয়া ছেড়ে বাংলাদেশে এসে গারো আদিবাসী অধ্যুষিত ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন সেবার নিদর্শন; একটি ব্যতিক্রমী হাসপাতাল। এখানে এলাকার আদিবাসী-বাঙালি সকলেই চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকে।

২০০২ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা থেকে প্রায় ২৫ কি.মি. উত্তরে প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকায় শোলাকুড়ি ইউনিয়নের কাইলাকুড়ি গ্রামে চার একর জায়গার ওপর মহৎপ্রাণ ডা. এড্রিক বেকার এই সেবাধর্মী হাসপাতাল গড়ে তোলেন। গরিব এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় তিনি হয়ে ওঠেন নিবেদিত প্রাণ। প্রতিদিন প্রায় ১ শ রোগি এখানে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে।

নতুন রুগিদের নামমাত্র টিকিট মূল্য ২০ টাকা নেওয়া হয় । আর পুরাতন রুগির বেলায় ৫-১০ টাকা। হাসপাতালের ইন্ডরে ছোট ছোট ২৩টি মাটির ঘরে বিভিন্ন বিভাগ, যেমন- ডায়াবেটিকস, যক্ষ্মা, মা ও শিশু, ডায়রিয়া, প্রশিক্ষণ কক্ষ, মাতৃসদন বিভাগসহ নানা বিভাগ গড়ে তোলা হয়েছে। সব বিভাগ মিলিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ জন রুগি ভর্তি করানোর ব্যবস্থা রয়েছে এই হাসপাতালে।

রুগি ভর্তির সময় তার জন্য ২০০ টাকা এবং রুগির সঙ্গের লোকের জন্য ১০০ টাকা নেওয়া হয়। এই টাকায় রুগির থাকা-খাওয়াসহ যতদিন হাসপাতালে অবস্থান করবে তার ফি ধরা হয়।

ইন্ডোরে মাতৃসদনে দিলরুবা বেগমের (৩০) সাথে কথা হয় ডিসিনিউজের। দিলরুবা জানান, ‘আমি দুই বছর ধরে ডায়াবেটিকসের সেবা নিচ্ছি। ডায়াবেটিকস কন্ট্রোলে এনে দিদিদের সহায়তায় মেয়ে বাচ্চার মা হয়েছি। এখানকার ভাল সেবা না পেলে আমি কখনো মা হতে পারতাম না।’

01হতদরিদ্র রিক্সাচালক আয়ুমুদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলের বয়স ১৮ বছর। ডাক্তাররা কইসে হরমুনের অভাবে আমার ছেলে বাড়তাসে না। এ দিকে আবার ডায়াবেকটিস। তিন বছর ময়মনসিংহ চরপাড়া হাসপাতালে সেবা নিছি, কিন্তু ঐহানে অনেক তেহা লাগে। এহানে আইয়া কম তেহায় চিকিৎসা নিতাছি।’

‘এহন আমার পোলা ভাল আছে’ বলেন আয়ুমুদ্দিন।

ডা. বেকারের রেখে যাওয়া নিদর্শনে ঘুরে দেখা যায় পরম মমতার সেবা। সবাইকে যতেœর সাথে সেবা দিয়ে যাচ্ছে এখানে কর্তব্যরত ব্যক্তিরা। গভীর মমতা আর ভালবাসা দিয়ে গড়া এই ব্যতিক্রম হাসপাতাল।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ দেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানীদের বর্বরতা, নির্যাতন, হত্যার এবং ভারতগামী শরণার্থীদের ছবি দেখে মহৎপ্রাণ ডা. বেকারের মন কেঁদে ওঠে। তখনই তিনি সংকল্প করেন এসব মানুষের পাশে থাকবেন।

ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এ দেশে আসবেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং সেবার দ্বার খুলে নিবেদিত হন আত্মমানবতার সেবায়।

১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটনে এড্রিক বেকারের জন্ম। তার বাবা জন বেকার একজন পরিসংখ্যানবিদ এবং মা বেট্রে বেকার একজন শিক্ষিকা ছিলেন। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।

ডা. বেকার ডুনিডেন শহরের ওটাগো মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন। ওয়েলিংটনে ইন্টার্নি শেষে যান যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে। সেখানে কাজ করেন ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে তিনি ইংল্যান্ডে পোস্ট-গ্রাজুয়েশন কোর্স ট্রপিক্যাল মেডিসিন গাইনি, শিশু স্বাস্থ্য শেষ করেন।

বাংলাদেশে এসে প্রথমে তিনি মেহেরপুর মিশন হাসপাতালে দুই বছর, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর কুমুদীনিতে আট মাস সেবা দেন। কিন্তু ডা. বেকারের বড় কোনো হাসপাতালে কাজ করার ইচ্ছা ছিল না।

তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুস্থ-দরিদ্রদের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলেন। মানবতার কথা চিন্তা করে চলে আসেন মধুপুরে। জলছত্র মিশনে এক বছর বাংলা শিখেন তিনি। এর পর গড়ে তোলেন সেবার নিদর্শন এই ব্যতিক্রমী হাসপাতাল, হয়ে ওঠেন গরীবের পরম বন্ধু। দীন-দুঃখী মানুষের চিকিৎসা সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন পুরোপুরিভাবে। ডা. বেকার মধুপুরে প্রায় ৩৬ বছর সেবা দিয়ে গেছেন।

২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি হঠাৎ করেই সবাইকে কাঁদিয়ে পাড়ি জমান পরপাড়ে। শ্বাসকষ্টজনিত কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ছোট্ট মাটির যে ঘরটিতে তিনি থাকতেন, তার অপর বারান্দাতে শান্ত হিজল বনে শুয়ে আছেন এই মহৎপ্রাণ মানুষটি। ডা. বেকার রেখে গেছেন দক্ষ করে গড়ে তোলা ৯০জন সেবাকর্মী এবং হাজার হাজার শুভাকাঙ্খী।

নারায়নগঞ্জ থেকে আসা ডা. বেকারের একজন শুভাকাঙ্খী শাহিন বলেন, ‘ডা বেকার ছিলেন মহান একজন মানুষ। তিনি তার কর্মে যে সাক্ষর রেখে গেছেন, তা কেউ কোনো দিন ভুলবে না। আমরা চাই বেকার ডাক্তারের ছবি যেন বড় করে গেইটের সামনে বানানো হয়।’

স্থানীয় প্রাক্তণ মেম্বার এম.এ লতিফ (৬০) বলেন, ‘বেকার ভাইয়ের অবদানের কথা ভোলার না। তিনি সব সময় সবার সাথে হেসে কথা বলতেন। এই হাসপাতাল যেন শেষ হয়ে না যায়, সে জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।’

‘আমাদের এলাকার কেউই এখন আর বিনাচিকিৎসায় মারা যায় না। বেকার ভাইয়ের এই হাসপাতাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাননীয় সরকারদলের দৃষ্টি আকর্ষণ করি’ বলেন লতিফ।

হাসপাতালের ম্যানেজার বিজন কুবি ডিসিনিউজকে বলেন, ‘আমরা এই হাসপাতাল নিয়ে এখন আর্থিক সংকটে রয়েছি। ডা. বেকার নিউজিল্যান্ডের দাতাদের সহায়তায় এই হাসপাতাল পরিচালনা করতেন। এ ছাড়াও তাঁর দুইজন বন্ধু এই হাসপাতাল পরিচালনায় অনেক সহায়তা দিতেন। কিন্তু ডা. বেকারের সেই দুই বন্ধুও বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। সব মিলিয়ে আমরা এখন অনেক বড় সংকটে রয়েছি।’

আরো বেশি সমস্যা হলো, ‘সরকার বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ বলাতে দাতা গোষ্ঠী এখন আর সহায়তা আগ্রহী না। তাই সরকার যদি এই হাসপাতালের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো ঠিক রেখে পাশে এসে দাঁড়ায়, তাহলে প্রত্যন্ত এই অঞ্চলের এবং হাসপাতালের ভাল হবে’ বলেন ম্যানেজার কুবি।

আরবি/আরপি/১ আগস্ট, ২০১৭