শিরোনাম :
একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ
বিজিবি-এর অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও একাত্তরের বীরমুক্তিযোদ্ধা বিজয় ম্যানুয়েল পেরেজ-এর জন্ম ১৯৫৪ সালে, ঢাকার ফার্মগেইটে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৮ বছরের এক তরুন, পড়তেন তিতুমীর কলেজে, এইচএসসি প্রথম বর্ষে। ছিলেন প্রচন্ড নির্ভীক এক যোদ্ধা। যুদ্ধ করেছেন ২নং সেক্টরে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং দেশ-মাতৃকার টানে জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। পরবর্তীতে বিজিবির মেজর হিসেবে অবসরে যান। কেমন ছিল মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলো, সে কথাই তিনি জানিয়েছেন ডিসি নিউজের পাঠকদের জন্য। পাঁচ পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব ছাপা হল আজ। সম্পাদনা সুমন সাংমা।
অতঃপর ১৯৭০ সালে নির্বাচন হলো এবং আওয়ামী লীগ একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে নির্বাচিত হলো। ইয়াহিয়া সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। নানা টালবাহানা করে ১৯৭০ সাল অতিবাহিত করে দেন। আসল ১৯৭১ সাল। এদিকে ইয়াহিয়া এবং টিককা খান পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলায় নির্বাচনের পরই সামরিক আইন তীব্রতর করলেন। রাজধানীতে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং কিছু এলাকায় কারফিউ জারি করলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ কেন্দ্রীয় নেতাগণ বিভিন্ন জেলায় গিয়ে ভাষণ দিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন। সাথে বাম রাজনৈতিক মজলুম ন্যাপ নেতা ভাসানীসহ সকল বামপন্থী দলগুলোর আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ উত্তাল মিছিলের নগরীতে পরিণত হল। ঢাকার জনগণও প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। আমরা কারফিউ ভেঙে মিছিল শুরু করলাম। পাক-সেনারা মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে আর লোকজনকে পাখির মতো গুলি করে মারছে। মিছিল ভেঙে লোকজন দৌঁড়ে পালাচ্ছে। অন্যদিকে গিয়ে পুনরায় একত্র হয়ে মিছিল বের করছে। এভাবেই সেদিন ঢাকার রাজপথগুলো বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল।
দিনের পর দিন পশ্চিমাদের অত্যাচার বেড়েই চলছিল। অবশেষে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্র্স ময়দানে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে স্বাধীনতার ডাক দিলেন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, ছাত্রজনতা সকলেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিল এবং এমন নির্দেশনার জন্যেই আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। বাংলার প্রতিটি মানুষ সেই নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিল।
নির্ধারিত সময়ের দু-তিনদিন আগে থেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন বাস, ট্রেনে করে রাজধানী ঢাকায় জড়ো হতে লাগল। কারফিউ ভেঙে সেদিন ঢাকা শহর মিছিল ও স্লোগানের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ নির্দেশনার জন্য লাখো মানুষ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জড়ো হয়েছিল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্রলীগের বন্ধুদের নিয়ে তদানীন্তন ঢাকা সদর উত্তর মহকুমা টঙ্গী স্টেশন রোডের মেডিকেল হাসপাতালের মাঠে একত্রিত হলাম এবং সেখান থেকে ছাত্রলীগের সকল নেতা-কর্মীসহ শত শত ট্রাক-বাস যোগে মিছিল নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে হাজির হলাম। সেদিনের গণজমায়েত দেখে পাক-হানাদার বাহিনী এবং জেনারেল ইয়াহিয়া ও টিককা খানের বুক কেঁপে উঠেছিল।
তাঁরা আচ করতে পেরেছিলেন যে, বাংলার মাটিতে তাঁদের আর কোন কর্তৃত্বই টিকবেনা। তাই বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে, বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করতে গোপনে নীলনকশা করতে লাগলেন। সেই নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য ২৫ মার্চ হতে ধাপে ধাপে রাতের অন্ধকারে নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির ওপর গণহত্যার মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলেন। (চলবে)
এসএস/আরপি/২২ মার্চ, ২০১৭