শিরোনাম :
একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ
(বীরমুক্তিযোদ্ধা ও বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত মেজর বিজয় ম্যানুয়েল পেরেজ)
বীরমুক্তিযোদ্ধা ও বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত মেজর বিজয় ম্যানুয়েল পেরেজ-এর জন্ম ১৯৫৪ সালে, ঢাকার ফার্মগেইটে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৮ বছরের এক তরুন, পড়তেন তিতুমীর কলেজে, এইচএসসি প্রথম বর্ষে। ছিলেন প্রচন্ড নির্ভীক এক যোদ্ধা। যুদ্ধ করেছেন ২নং সেক্টরে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং দেশ-মাতৃকার টানে জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। পরবর্তীতে বিজিবির মেজর হিসেবে অবসরে যান। কেমন ছিল মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলো, সে কথাই তিনি জানিয়েছেন ডিসি নিউজের পাঠকদের জন্য। পাঁচ পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব ছাপা হল আজ। সম্পাদনা সুমন সাংমা।
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে জাতীর উদ্দেশে কী নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে সবাই অবগত। সেদিন গণজমায়েত দেখে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ভয়ে-আতঙ্কে রেসকোর্স ময়দানের চারদিকে সেনা টহল বৃদ্ধি করল। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেনারা টহল দিচ্ছিল। আমরা উৎকন্ঠায় ছিলাম পরিস্থিতি যেকোনো মূর্হুতে খারাপ হতে পারে এবং যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।
কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মিলিটারী সৈন্য গাড়ি নিয়ে মেশিনগান তাক করে বেরুচ্ছে। নেতারা ভাবছে, যেকোনো মুহুর্তে তারা গ্রেপ্তার হতে পারেন, এমন কি মৃত্যু পর্যন্ত। সবাই আতঙ্কে সময় কাটাতে লাগলাম। রেসকোর্স ময়দান তখন লোকে লোকারণ্য। সবাই অপেক্ষা করছে বঙ্গবন্ধু আসবেন। অন্যান্য নেতারা সবাই এসে পড়েছেন কিন্তু তিনি আসছেন না। অনেকের মনে নানা শঙ্কা। অনেকেই বলাবলি করছিল, তিনি তো এরকম কোনোদিনও করেন না। নির্ধারিত সময় অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। অনেকেরই ধারণা হয়তো বা গ্রেপ্তার হয়ে গেলো কিনা! সকলের ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে অবশেষে বঙ্গবন্ধু প্রায় বেলা ২টার দিকে জনতার ভিড় ঠেলে রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে হাজির হলেন।
জনতার স্লোগানে পুরো ঢাকা শহর প্রকম্পিত হয়ে উঠল। তিনি স্বাধীনতার ডাক দিলেন এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রুর মোকাবেলা করতে বললেন। স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা, অফিস-আদালত- সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বললেন। জনতার উদ্দেশে তিনি আরও বললেন, ‘আমি যদি আদেশ দিতে নাও পারি, তোমরা এই ভাষণের পর সেইমতো কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টই বোঝা যায়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে আর কোনো ধরনের আপোসের সুযোগ নেই। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্যে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হবে। নইলে তারা কোনোদিন বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তিনি বলেছেন, ‘ভাতে মারবো, পানিতে মারবো, তবুও এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাাল্লাহ।’
সেদিন প্রতিটি বাঙালি তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। ভাষণ সংক্ষিপ্ত করে তাঁর ময়দান ত্যাগ করার পর পরই মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে ব্রাস্টফায়ারের শব্দ শোনা গেলো। মনে হলো, সৈন্যদের মেশিন গানের ফায়ার। জনসভায় হুলস্থুল লেগে গেল। মানুষ দিকবিদিক ছুটোছুটি করছে।
এক সময় খেয়াল করলাম আমি রামপুরা টিভি সেন্টার অতিক্রম করে চলে এসেছি। জনসমুদ্রের ভিড় ঠেলে কীভাবে চলে এলাম নিজেও বলতে পারব না। সেদিনের ঘটনায় কত মানুষ যে আহত হয়েছিল তা জানা নেই। এরপর পাক-সরকার ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করল। মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারত না, দেখলেই গুলি করত। সারা শহরে মিলিটারী সৈন্যদের টহল গাড়ি। মানুষ ঢাকা শহর ছেড়ে আস্তে আস্তে গ্রামের দিকে চলে যেতে লাগল।
ছাত্রজনতা পরিস্থিতি বুঝে রাজপথে মিছিল বের করতে থাকে।মিলিটারী গাড়ি দেখলে আবার পালিয়ে যায়। বাংলার প্রতিটি শহর, গ্রাম-গঞ্জের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে জীবন-যাপন করছে। কখন যে কী হয় বলা মুশকিল। দেশ সংকটময় মূহুর্তে উপনীত হল। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, সড়ক-রেলপথ, অফিস-আদালত বন্ধ এবং এক পর্যায়ে জনগণই তা স্বেচ্ছায় বন্ধ করে দিল। এ ধরনের বয়কট ও অবরোধ পৃথিবীর আর কোনো দেশে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
এই অবস্থা দেখে পাক-হানাদার বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া ও টিককা খানের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তখন ইয়াহিয়া খান নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে থাকেন। যতদূর মনে পড়ে, ২২ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া শুধু শেখ মুজিব তথা আওয়ামী লীগের সাথে বৈঠক করলেন। বৈঠকগুলো কালক্ষেপন ছিল মাত্র। ভেতরে ভেতরে পাক-সেনারা ঢাকায় জমায়েত হচ্ছে। গোলাবারুদ এবং পুরোপুরি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একের পর এক বৈঠক হচ্ছে কিন্তু কোনো সমাধান নেই।
শেখ মুজিব বুঝে গিয়েছিলেন তারা আর ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। জানতেন যেকোনো সময় তিনি গ্রেপ্তার হবেন। গেপ্তার হওয়ার আগেই শেষবারের মতো জাতীর উদ্দেশে হাতে লিখে তিনি গোপনে পিলখানায় ইপিআর-এর ওয়ারল্যাস অপারেটরের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। যাতে প্রতিটি জেলায় পাঠিয়ে সকলকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, প্রতিটি জেলার প্রতিটি থানা সদরে ইপিআর তথা বিডিআর ক্যাম্পে এই বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু ছিল। শেখ মুজিবের এই বার্তা বাঙালি অপারেটরগণ মূহুর্তে বিডিআর এবং দেশের জনগণকে অবহিত করেছিলেন। এর পরেই পাক-বাহিনী শেখ মুজিবকে তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে এবং তিনদিন পরে বিমানে করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। (চলবে)
এসএস/আরপি/২৩ মার্চ, ২০১৭