শিরোনাম :
একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ
বীরমুক্তিযোদ্ধা ও বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত মেজর বিজয় ম্যানুয়েল পেরেজ)
বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও একাত্তরের বীরমুক্তিযোদ্ধা বিজয় ম্যানুয়েল পেরেজ-এর জন্ম ১৯৫৪ সালে, ঢাকার ফার্মগেইটে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৮ বছরের এক তরুন, পড়তেন তিতুমীর কলেজে, এইচএসসি প্রথম বর্ষে। ছিলেন প্রচন্ড নির্ভীক এক যোদ্ধা। যুদ্ধ করেছেন ২নং সেক্টরে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং দেশ-মাতৃকার টানে জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। পরবর্তীতে বিজিবির মেজর হিসেবে অবসরে যান। কেমন ছিল মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলো, সে কথাই তিনি জানিয়েছেন ডিসি নিউজের পাঠকদের জন্য। পাঁচ পর্বের ধারাবাহিকের চতুর্থ পর্ব ছাপা হল আজ। সম্পাদনা সুমন সাংমা।
পরদিন সকাল ৮টার দিকে ঘুম ভাঙলো। ফ্রেশ হয়ে দুজনে গলির মোড়ে ছোট্ট হোটেলে নাস্তা করলাম এবং লোকজনের কথা শুনতে লাগলাম। দিনের বেলা কারফিউ শিথিল হলেও বিশ্বাস করতে পারছি না। আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে রাস্তায় কিছু মানুষের আনাগোনা দেখে একটু সাহস হল। হোটেল থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে এসে বড় রাস্তা পার হলাম এবং পশ্চিম পাশে খেঁজুর বাগান এলাকায় প্রবেশ করলাম। বর্তমান খামারবাড়ি তখন খেঁজুর বাগান এলাকা নামেই সবাই চিনত।
ওই সময় মেইন রোডের আইলে-এত চওড়া ছিল না। সরু রাস্তা এবং রাস্তার দুই পাশে ৫০-৬০ বছর আগের শীলকড়াই গাছগুলো ২৫-৩০ হাত দূরে দূরে সারিবদ্ধ অবস্থায় ছিল। আমরা অনায়াসে রাস্তা পার হয়ে বর্তমান আনন্দ সিনেমা হলের সামনে রিক্সা স্ট্যান্ডে আসলাম। তখন আনন্দ সিনেমা হল ছিল না। পুরো অঞ্চলটাই ছিল খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। রিক্সা খুঁজতে লাগলাম কিন্তু ভয়ে কেউ-ই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেতে রাজি হচ্ছিল না। হঠাৎ মধ্যবয়সী এক রিক্সা চালক সামনে এসে দাঁড়ালো এবং বলল, ভাই আমি যাব তবে ভাড়া একটু বেশি লাগবে। বললাম, কত দিতে হবে? সে বললো, ৩ টাকার পরিবর্তে ৫ টাকা লাগবে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম তবে শর্ত জুড়ে দিলাম আমরা বিশ্ববিদ্যালয় আশেপাশের এলাকাতেও যাবো, না করতে পারবে না। সেও রাজি হয়ে গেলো। উঠে পড়লাম রিক্সায়।
গ্রীনরোড ধরে এগুতে থাকলাম। রাস্তায় যানচলাচল কম। কেমন যেন একটু থমথমে ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় মিলিটারী পাহারা, অস্থায়ী ক্যাম্প। বালির বস্তা এবং মেশিনগান তাক্ করে সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে। আমরা নিউমার্কেট পার হয়ে বাম দিকে টার্ন নিয়ে নীলক্ষেতের দিকে যেতে থাকি।এক ভদ্রলোক আমাদের রিক্সা থামিয়ে বলল, সামনেই মিলিটারী ক্যাম্প, আপনারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকবেন না। আপনাদের আটকাবে, ভিতরে যেতে দিবে না। লোকটির কথায় চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কিন্তু রিক্সা চালক আমাদের বলল, ভাই চিন্তা কইরেন না, আমি এই এলাকার সব রাস্তাই চিনি। বসেন, আমি আপনাদের নিয়ে যাব।
স্থির করলাম ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে রোগী দেখার কথা বলে চেকপোষ্ট পার হব। কারণ, রাতেই কসমসদাকে বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে যাব। দাদাকে বললাম, তুমি তো নিজেই বলেছিলে সেখানে পাক-বাহিনী ছাত্রছাত্রীদের হলগুলোতে ঢুকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে এবং পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে। দাদা তখন বলল, বলেছিলাম কিন্তু এখন কি সেগুলো দেখতে পারব? এতক্ষণে হয়তো তারা সব সরিয়ে ফেলেছে। আর এত ঝুঁকি নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না, চল ফিরে যাই। আমি বললাম না এতদূর এসে ফিরে যাব না। আর রিক্সাচালক তো বলেছে, সে আমাদের নিয়ে যাবে।
রিক্সাচালক সঙ্গে সঙ্গে বলল, ভাই মেডিকেলের পাশ দিয়ে ১টা সরু রাস্তা আছে। বর্তমান টিএসসি এবং ভিসির বাসস্থানের পেছনের রাস্তা দিয়ে আপনাদের নিয়ে যাব। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তখন এতো দালান-কোঠা ও রাস্তা ছিল না। মাঝে মাঝে ঝুপড়ি জঙ্গল ছিল। রাস্তার আশেপাশে ছোট-বড় গর্ত ছিল। উদয়ন স্কুলটি বর্তমান অবস্থানে ছিল না। কসমসদা কিছুক্ষণ চিন্তা করে রাজি হয়ে বলল, এক কাজ করা যায়, মেডিকেলে গিয়ে রিক্সা রেখে যাই। দাদার কথায় খুশি ও ভয় দুই-ই কাজ করছে। তারপরও বললাম, দাদা, চলো।
কিছুদুর যেতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক গেটে সেনাদের অস্থায়ী বালির বস্তায় নির্মিত পাহারা চৌকি চোখের পড়ল। ইশারা করল ভেতরে যাওয়া যাবে না। আমাদের দক্ষিণ দিকে মেডিকেলের দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিল। ওদের দিকে না তাকিয়ে একরকম ভয়ে জড়োশড়ো হয়ে রিক্সা চালককে বললাম, তাড়াতাড়ি চল। রিক্সা দ্রুত এগিয়ে চলছে। আমরা শহীদ মিনারের গলিতে ঢুকে পড়লাম। সামনে এগুনোর পর জগনাথ হলের গেইটে আসতেই দেখি মিলিটারী চেক পোস্ট। আমাদের থামিয়ে চেক করল এবং জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?
তখন আমি ভাল উর্দু বুঝি না। দাদা বললেন, রোগী দেখতে হাসপাতাল যাব। কসমসদা যে ভাল উর্দু বলতে পারে, তা আগে জানা ছিল না। কথা প্রসঙ্গে দাদা তাদের বলল, আমরা খ্রিষ্টান, আমাদের ধর্ম ইসাই। এটা বলার পরে ছেড়ে দিল। আমরা মেডিকেল গেইটে এসে দাঁড়ালাম। রিক্সা রেখে তিনজন বর্তমান শহীদ মিনার পার হয়ে উত্তর দিকে “ল” ফ্যাকাল্টির গা ঘেষে টিএসসির পথে এগিয়ে গেলাম। ছোট রাস্তা ও আশেপাশে ঝুপড়ি জঙ্গল।
দিনের বেলা সবকিছু নিস্তব্ধ, নির্জন লাগছিল। তিনজনই পায়ে হেঁটে যাচ্ছি। টিএসসি এবং রোকেয়া হলের কাছে আসতেই হঠাৎ একটি শিয়াল পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে দৌঁড়ে রাস্তা পার হল। দুষ্টুমির ছলে শিয়ালটা ধাওয়া করে পশ্চিম দিকে রোকেয়া হলের সাথে দক্ষিণ পাশের সামসুন্নাহার হলের গলির শেষ মাথা পর্যন্ত ভাঙা প্রাচীরঘেরা দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওইদিকে আর কোনো রাস্তা নেই। শিয়ালটি ঝুপড়ি জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে ফিরে আসার জন্য ডান দিকে মোড় নিতেই দেখি পাশে বড় একটা গর্ত। গর্তের পারে প্রকা- এক শিলকড়ই গাছ। গর্তের দিকে চোখ পড়তেই দেখি পাঁচ-ছয়টি মানুষের লাশ পড়ে আছে, মাছি ভনভন করছে। আটকে উঠলাম এবং এগিয়ে এসে চিৎকার করে দাদাকে ডাকলাম।
দাদা রিক্সাচালককে নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলে লাশের বর্ণনা দিলাম। দাদাসহ আবার সেখানে গিয়ে দেখি লাশগলো পড়ে আছে। আরেকটু গর্তের দিকে আগাতেই দেখি আরও লাশ। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। খালিগায়ে, অর্ধ কাপড়ে অনেক নারী-পুরুষের লাশ। অনুমানে প্রায় ৫০-৬০টি হবে। দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, একটির ওপর আরেকটি চিৎ-উপুর হয়ে পড়ে আছে। তখন মনে হয়েছে এবং দাদাও বলল হয়তো ২৫ মার্চে রোকেয়া হলের হত্যাযজ্ঞের কিছু লাশ পাক-সেনারা এখানে ফেলে রেখে গেছে। তখন আর বুঝতে বাকি রইলনা শিয়ালটি কেন ওই দিকেই দৌঁড়ে এসেছিল। জানিনা লাশগুলোর অবস্থা শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল? হয়তো সেখানেই পড়ে ছিল আর শিয়াল-কুকুরে টেনেহিচড়ে খাবলে খেয়েছিল। অবশিষ্ট লাশগুলো হয়তো পচে গলে ঐ মাটিতেই মিশে গেছে। কার মায়ের বুক যে খালি হয়েছে কে জানে?
আমরা বিচলিত হয়ে উর্ধ্বশ্বাসে সেখান থেকে দৌঁড়ে মেডিকেল হাসপাতালের সামনে এসে পুনরায় রিক্সা নিয়ে সোজা তৎকালীন পাকমটর হয়ে বাসায় ফিরে গেলাম। মনে হলো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সেদিনের কথা মনে হলে গা এখনো শিউরে উঠে এবং গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। সেদিন তো এখনকার মতো ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন ছিল না। আফসোস হয়, যদি ওই অবস্থার ছবি তুলে রাখতে পারতাম!
ঘরে এসে আমি আর কসমসদা প্রতিজ্ঞা করলাম এই হত্যার প্রতিশোধ নিতেই হবে। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করব। রাস্তায় মিছিল করে তো লাভ নেই। প্রতিশোধ নিতে হলে ওদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হবে। কিন্তু অস্ত্র কোথায় পাব? ভাবনা শুরু হয়ে গেল কী করে ওদের প্রতিহত করা যায়।
এলাকার কিছু যুবকদের সাথে পরামর্শে বসলাম। স্থির করলাম, রাতে কারফিউ ভেঙে প্রধান সড়কের ওপর গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করব, যাতে সৈন্যদের গাড়ি চলাচল ও টহল দিতে না পারে। বঙ্গবন্ধু তো ৭ মার্চ সবকিছু বলেই দিয়েছেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। ফন্দি আটলাম, ২৭ মার্চ দিনের বেলায়ই কারওয়ান বাজারে গিয়ে “স” মিল থেকে কিছু লম্বা কড়াত জোগার করে রাতের বেলা ফার্মগেইটের নিকটবর্তী খেঁজুর বাগান এলাকার ঠিক উল্টো দিকে হোটেল সালিমার কাছে বড় একটি শীল কড়ই গাছ কেঁটে রাস্তা ওপর ফেলব। আর এটাই হবে পাক-সেনাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম অভিযান। (চলবে)
এসএস/আরপি/২৭ মার্চ, ২০১৭