শিরোনাম :
কথার কথা
|| নয়ন যোসেফ গমেজ, সিএসসি ||
একজন মানুষের সুন্দর করে কথা বলা অন্যতম একটি গুণ। সুন্দর কথা বলা একটি শিল্প। যিনি সুন্দর কথা বলেন, তিনি শিল্পী, বাক্শিল্পী। কারো চেহারা ভালো হলে বলি, সুন্দর। এই সৌন্দর্য তার জন্মগত রূপ। কেউ সুকণ্ঠের অধিকারী হলে বলি, বাহ্! কী সুন্দর গলা! কেউ যখন খুব সুন্দর গান করে শ্রোতাদের প্রিয় হয়ে ওঠে, আমরা বলি, জন্মগত প্রতিভা। এভাবে নানা বিষয়েই আমরা সৌন্দর্যের তারিফ করে থাকি। কিন্তু কেউ যদি দেখতে কম সুন্দর হন! তিনি যদি পরিচচ্ছন্ন ও মানানসই পোশাক পরেন, তবে কিন্তু কম-সুন্দর ব্যক্তির চেহারায়ও সৌন্দর্যের আলো ফুটে ওঠে। আমরা দেখি, জন্মগত প্রতিভা ছাড়াও অনেক গায়ক কেবল ধারাবাহিক অনুশীলনের মাধ্যমে শ্রোতার মন জয় করে ক্রমে জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তেমনি জীবনের সব ক্ষেত্রে আমরা দেখি জন্মগত প্রতিভা ছাড়াও একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও ক্লান্তিহীন অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। অনন্য হিসেবে নিজেকে উজ্জ্বল করেছেন। কণ্ঠস্বরের সৌন্দর্যকে আমরা জন্মগত বলে ধরে নিতে পারি। কিন্তু কথার সৌন্দর্যকে জন্মগত সৌন্দর্য বলতে পারি না। কেবল সুন্দর কণ্ঠস্বরই সুন্দর কথার পূর্বশর্ত নয়। সুন্দর কথার প্রধান শর্ত ভাষা, বাচনভঙ্গি, কণ্ঠস্বর।
সুন্দর করে যারা কথা বলেন, তাদের কথা থেকে রুচি আর ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।যার চিন্তা যত পরিষ্কার, যার জ্ঞান যত গভীর, যার মন যত সংবেদনশীল তার কথা বলাটাও তেমনি আকর্ষণীয় হয়। অনেক অনেক কথা না বলে যিনি অল্প কথায় অনেক কিছু বোঝাতে পারেন তিনিই সুন্দর কথক। আমরা যদি একটু আন্তরিকভাবে চেষ্টা করি তবেই চর্চা করে সুন্দর কথা বলার অভ্যাস করতে পারি। নিজেকে সুন্দর বাচনভঙ্গির মাধ্যমে সবার কাছে উপস্থাপন করতে পারলে জীবন গঠন অনেক সহজ আর আনন্দময় হয়ে উঠবে। সুন্দর করে কথা বলাটা যে খুব বেশী কঠিন এমনটা কিনা। তাহলে আসুন জেনে নেয়া যাক, সুন্দর করে কথা বলার কিছু কার্যকারী টিপস:
প্রথমে শুনুন: কোন একটা আলোচনায় যোগ দিতে গেলে আগে শুনুন কে কী বলছে। হুট করে কোন মন্তব্য করা বোকামির কাজ। মূল বিষয়টি নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করুন । এটা সব সময় সম্ভব নয়! তবুও কে কিভাবে কথা বলছেন সেটা খেয়াল করুন। যিনি সুন্দর করে কথা বলছেন তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তিনি হয়ত আপনার থেকে অনেক জানেন, তাতে কি! আপনিও একসময় জানবেন। অনুসরণ করুন আর মনে মনে ভাবyন কিভাবে নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করবেন। শুধু মাত্র আপনিই হড়বড় করে সব বলে যাবেন, এটা স্মার্টনেসের মধ্যে পড়ে না। বরং আপনি যার সাথে কথা বলছেন তার প্রত্যেকটা কথা শোনা এবং বোঝাও স্মার্টনেসের অন্তর্ভুক্ত। কেউ আপনার সাথে কথা বলার সময় সরাসরি তার দিকে তাকান, তার চোখের দিকে। কোন কথা বুঝতে সমস্যা হলে তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করুন সে কি বলছে। তার কথায় সম্মতি জানান, মাথা বা হাত নেড়ে তাকে বোঝান যে আপনি তার কথা মন দিয়ে শুনছেন। কারো কথা শোনার সময় মন দিয়ে শুনুন এবং তার প্রশ্ন বুঝার চেষ্টা করুন। কারণ, প্রশ্ন ঠিকভাবে বুঝলেই কেবল আপনি ঠিক উত্তরটা দিতে পারবেন, এতে অনেক ভুল বুঝাবুঝিও কমবে।
টপিকের দিকে খেয়াল: অনেকেই আছেন কথা বলা শুরু করেছেন, মাঝে একটা উদাহরণ দিতে গেলেন, উদাহরণের মাঝে সুন্দর একটা গল্প কৌতুক শুরু করে দিলেন। আর আসল টপিক ভুলে গেলেন। গল্প শেষে নির্লজ্জের মতো হাসি দিয়ে বললেন- আমি কোথায় যেন ছিলাম? এসব মানুষের কথায় উপস্থিত সকলের কঠিন বিরক্ত হয়। রাগ হয়। পরের বার আর শুনতে চান না কেউই। সবায় নিশ্চয় তাদের মূল্যবান সময় সেই ব্যক্তির গল্প শুনে নষ্ট করতে চাইবেন না। তাই টপিকের দিকে মনোযোগ দিন। যদি এমন হয় তবে লিখে রাখুন। কাগজে লিখে তবেই গল্প, উদাহরণ যা দেবার দিন। এতে আপনার মনে থাকবে আপনি সত্যিই কোথায় ছিলেন।
অঙ্গভঙ্গির ব্যবহার: কথা বলার সময় সংশ্লিষ্ট অঙ্গভঙ্গির গুরুত্ব অনেক। অনেকেই আছেন এক হাত পকেটে রেখে অন্য হাত নাড়িয়ে কথা বলেন। অনেকেই দু’হাত নাড়িয়ে কথা বলেন। আবার অনেকে হাত না নাড়িয়েই কথা বলেন। যখন যা বলবেন তা বুঝাতে যেভাবে অঙ্গ সঞ্চালন দরকার সেটাই করা উচিত। সুন্দর করে কথা বলার ক্ষেত্রে এটাও আবশ্যক। আপনার কথার মূল্য অনেকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে সঠিক অঙ্গভঙ্গি। আপনার দাঁড়ানো বা বসার ভঙ্গি, হাত নাড়ানো এসব দিকে মনযোগ দিন। কোন কিছুই অতিরিক্ত করার দরকার নেই। তবে কথার সাথে যেন অঙ্গভঙ্গি খাপ খায় সে চেষ্টা করুন। অনেকের অভ্যাস থাকে অন্যের সাথে কথা বলার সময় কাঁধে হাত দেয়া বা বারবার গায়ে খোঁচা দিয়ে নিজের দিকে মনযোগ ফেরানোর। আপনার যদি এমন কোন অভ্যাস থেকে থাকে, দয়া করে এখনি পরিহার করুন । কেননা তা মোটেই সুন্দর নয়।
আঞ্চলিকতা পরিহার করুন: আমাদের দেশে বেশ কিছু আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে কিছু শুনে তো প্রথমে বোঝার কোন উপায়ই নেই যে সেগুলো বাংলা ভাষা নাকি অন্য কিছু! নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষাকে সম্মান করতে শিখুন। সে ভাষায় কথা বলুন। কিন্তু এটাও খেয়াল রাখবেন তা যেন আপনার কথায় কোন ছাপ না ফেলে যায়। আপনার কথায় যদি আঞ্চলিক উচ্চারণ ভঙ্গি চলে আসে বা কোন আঞ্চলিক শব্দ ঢুকে পড়ে তবে অফিস, ক্লাসে বা বন্ধুদের সামনে যেখানেই যান, আপনাকে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। বিশেষ করে চাকরির ইন্টারভিউ দেবার সময় সর্বাবস্থায় আঞ্চলিক বাচনভঙ্গি পরিহার করুন।
হাসিমুখে কথা বলা: মানুষের মুখের কথাতেই তার হৃদয়ের পরিচয়। বলুন তো, পৃথিবীর যে কোন মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর লাগে কখন? একটা মানুষকে সব থেকে সুন্দর লাগে যখন সে হাসে। এবার ভাবুন তো, কোন দোকানে যেতে আপনার ভাল লাগে? যেসব দোকানে হাসিমুখে আন্তরিকতার সাথে কথা বলে নাকি যেখানে সবসময় গুমট হয়ে মুখ অন্ধকার করে কথা বলে? অথবা চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, কোন মানুষটাকে আপনার ভাল লাগে?
দেখবেন, হাসিমুখের মানুষগুলোই আপনার মনে প্রিয় জায়গাটি দখল করে বসে আছে। তাই ঈশ্বর প্রতত্ত এই অসম্ভব সুন্দর গুণটিকে ব্যবহার করুন।
নেতিবাচক কথা বলবেন পরিহার: দৈনন্দিন কথার মাঝে কখনই কোন নেতিবাচক কথা ব্যবহার করবেন না। কারণ নেতিবাচক কথা বার্তা হতাশার সৃষ্টি করে। একটা উদাহরন দেয়া যাক, একবার এক ম্যারেজ কাউন্সিলের কাছে এক দম্পতি গিয়েছিলেন পারিবারিক সমস্যায়। ম্যারেজ কাউন্সিলর তাদের সাথে কথা বলে জানলেন, প্রতিদিন মহিলা তার স্বামীকে বাজার প্রসঙ্গে বলে: “চাল নাই, ডাল নাই, চিনি নাই, লবণ নাই, মাছ নাই, মাংস নাই” ইত্যাদি ইত্যাদি। এই নাই-নাই শুনতে শুনতে ভদ্র লোক একটি শূণ্যতা অনুভব করেন। এই কথা শুনে ম্যারেজ কাউন্সিলর পরামর্শ দিলেন, এখন থেকে কথাগুলো একটু ঘুরিয়ে বলতে। যেমনঃ এই ‘নাই’ এর জায়গায় বলবেন ‘লাগবে’। কিন্ত এই কথাগুলোই যদি ঐ ভদ্র মহিলা এভাবে বলতেন যে, “চাল লাগবে, ডাল লাগবে, চিনি লাগবে, লবণ লাগবে, মাছ লাগবে, মাংস লাগবে”। তাহলে হয়ত সংসারে অশান্তি অনেক কমে যেত। কারণ ‘নাই’ শব্দটির চেয়ে লাগবে শব্দটি ইতিবাচক। এটি ভাল অনুরনণ সৃষ্টি করে। তাই আজই নেতিবাচক কথা বা শব্দগুলোর ইতিবাচক প্রতিশব্দ খুঁজে বের করুন এবং নিয়মিত ইতিবাচক অভিব্যক্তির চর্চা করুন।
বিদ্রূপের জবাব দিন : রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে। পশ্চিমাদের অনেকেরই এটা সহ্য হচ্ছিল না। একবার এক পশ্চিমা সাহেব রবীন্দ্রনাথকে একবার বলেই বসলেন, গীতাঞ্জলি বইটি দারুণ হয়েছে।
তবে বলোতে বাপু, কে আসলে ওটা লিখে দিয়েছিল তোমার হয়ে? সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো কwবগুরুর বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। রবী ঠাকুর বললেন, তার আগে আপনি বলুন দেখি কে আসলে আপনাকে পড়ে দিয়েছে
গীতাঞ্জলির মতো কাব্য। একবার নিজেকে কবিগুরুর ঐ সময়ের স্থানে বসিয়ে ভাবুন তো, আপনি কি উত্তর দিতেন? তাই নিজের বুদ্ধিকে ব্যবহার করুন। বিদ্রুপকারীর সাথে তর্কে লিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে বিদ্রূপের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করুন।
সততার সাথে কথা বলুন: আপনার সততা আপনার শ্রোতাকে প্রভাবিত করবে। সবাই আপনার ভেতরকার মানুষটাকে শুনতে চায়। আমাদের মধ্যে নানা কপটতার ফলে এই গুণ ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়। তাই সততার সাথে কথা বলুন, কিন্তু সততাকে যেন ঘিরে রাখে ভালোবাসা ও সহনশীলতা। ভালোবাসা আর সহনশীলতা মেশানো সততা আপনাকে করে তুলবে সবার থেকে আলাদা। আপনার নিজস্বতাই আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। নিজের সত্যিকারের বিশ্বাস ধ্যান-ধারণা আপনার কথার মাধ্যমে প্রকাশ করুন। আপনার নিজস্বতাই আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি। এটিই আপনাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তোলে।
পরিশেষে, একটু চিন্তা করুন তো একজন মানুষকে চেনেন না, জানেন না, তার বংশ বা পড়াশুনা কোন কিছুই আপনার অবগত না। তবyও মানুষটির সাথে একটু কথা বলার পরই তার সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা আপনি করে ফেলতে পারেন। পরবর্তী সময়ে তার সাথে আপনার আচরY কেমন হবে তার একটা পরিকল্পনা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আপনার মাঝে তৈরি হয়ে যায়। বলতে পারেন এর কারণ কি? এর কারণ হল তার কথা বলার ধরন এবং অভিব্যক্তি! একজন মানুষকে তুলে ধরে তার কথা বলার ধরন। বাহ্যিক সৌন্দর্যের একটি অন্যতম উপাদান হল সুন্দর করে কথা বলা। আপনার ব্যক্তিত্বের একটি বড় অংশ হলো কথা বলার ধরন।y সুন্দর করে কথা বলতে পারার সবচেয়ে ইতিবাচক দিকগুলো হল; আত্মবিশ্বাসী থাকা যায়, উদ্যমী হওয়া যায়, অন্যের চোখে প্রকৃত ভাবমূর্তি তৈরি করা যায়, মানুষকে সহজে প্রণোদিত করা যায় | অনেকেই আছেন খুব সুন্দর মনের মানুষ, দেখতেও অনেক সুন্দর কিন্তু তিনি ভাল কথা বললেও যিনি শুনছেন তাঁর রাগ উঠে। নিজেকে নিজে তিনি বোঝাতে পারেন না যে কী করবেন! তাই তাঁর সব কিছুতেই অস্থির লাগে। মন ভাল হলেও তিনি ভাল মানুষ হিসেবে পরিচিতি পান না। সমাজে তার নানা ধরনের জটিলতায় পড়তে হয়। শুধুমাত্র কিভাবে সুন্দর করে কথা বলতে হয় সেটা না জানার জন্যে।
ছবি: সংগৃহীত