শিরোনাম :
করোনা সংকট ও পরবর্তী জনজীবন: পরিবেশের ভারসাম্য
রবীন ভাবুক ॥ ঢাকা
সারাবিশ্বে চলছে লাগাতার লকডাউন! স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। করোনা সংকট বিশ্বের এমন কিছু বাদ রাখেনি, যার উপর প্রভাব ফেলে যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক, পরিবেশগত সমস্তকিছুর উপর করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রভাব বিস্তার করেছে। পূর্বের কলামগুলোতে বলেছিলাম, করোনা সংকটের পরবর্তী সময়ে বিশ্বের জন্য নতুন কিছুই অপেক্ষা করছে। হতে পারে অনেককিছুই। বিভিন্ন সেক্টরের বিশেষজ্ঞরাও পর্যালোচনা করে নানান মত দিচ্ছেন।
করোনার আঘাত যেমন ক্ষতি করে যাবে ব্যাপকভাবে, তেমনি নতুন নতুন সুযোগও সৃষ্টি করে যাবে। ধরিত্রীমাতা এতটা নিষ্ঠুর নয়, তা ইতিহাস থেকেই জানা যায়। আবার দিনের পর দিন, যেভাবে আমরা পরিবেশ নষ্ট করে ধরিত্রীমাতাকে আঘাত করেছি, তার কিছুটা প্রতিঘাত তো আমাদের পেতেই হবে। কিন্তু ধরিত্রীমাতা এতটাই মমতাময়ী, সে অবশ্যই নতুন কিছু দিয়ে যায়।
ঢাকা শহর ইতিমধ্যে বিশ্বে বিভিন্ন শহরের মধ্যে সেরা দূষণের শহরে কাতারে চলে গিয়েছিল। জনসংখ্যার ঘনত্ব, অনিয়মতান্ত্রিক অবকাঠামো, যত্রতত্র যানবাহনের কালো ধোঁয়া, কলকারখানার অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য ঢাকা শহরকে করে তুলেছিল একটি অবাসযোগ্য নগরীতে। কোভিড-১৯’র কারণে ঢাকা শহর এখন একটি যেন ভুতুরে নগরীতে পরিণত হয়েছে। কলকারখানা, অফিস-আদালতসহ সবকিছু এখন বন্ধ। বাংলাদেশ সরকার সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করার পর শহরকেন্দ্রীক মানুষ গ্রামে পাড়ি জমিয়েছে। এতে ব্যস্ত নগরী এখন ফাঁকা শুনশান নিরবতা পালন করছে।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নড়বরে হয়ে গেলেও কিছু আশার সঞ্চার রয়েই গেছে। মূলত ধরিত্রী যাবতীয় কিছুই, তাকে ঘিরেই আবতৃত হয়। জীবন থেকে শুরু করে মানবীয় হোক বা পরিবেশগত হোক সবকিছুই ধরিত্রী ঘিরেই গড়ে ওঠে। তাই পরিবেশ বাঁচলে, বেঁচে যাবে জীব। মানুষ তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তার প্রয়োজনে পুরো পৃথিবীর উপর কতৃত্ব করতে গিয়েই আজ করোনার প্রকোবে নিমজ্জিত হয়েছে।
করোনা ভাইরাস ইতিমধ্যে কয়েক লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। অসুস্থ্য হয়ে মৃত্যু দ্বারে পড়ে রয়েছে লাখো মানুষ। বাংলাদেশেও নিয়মিত করোনা আক্রান্তের রোগির সংখ্যা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক জীবন এখন হুমকির মুখে। কিন্তু এরপরও আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে কোভিড-১৯ একটি বিষয় দেখিয়ে দিয়েছে, ধরিত্রীকে আঘাত না করলে, ধরিত্রী সবাইকে সন্তানের মতোই আগলে রাখে। যার প্রমাণ মিলে বর্তমান পরিবেশের দিকে একটু নজর দিলেই।
ইট-পাথরের যান্ত্রিক ঢাকা শহরে মানুষের কোলাহল, যানবাহনের বিকট শব্দ, ধূলাবালির পরিবর্তে এখন একটি শান্ত আবহাওয়া বিরাজ করছে। নেই কোনো কানঝালাপালা করা বিকট শব্দ, মানুষের ভীরে আর নিজেকে অসহায় মনে হয় না। দুই মাসের লকডাউনে যেন পাল্টে গেলো ঢাকার আবহাওয়াও। চৈত্র এবং ভাদ্র মাসে গরমে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিন্তু ইতিমধ্যে চৈত্র চলে গেল, ভাদ্র চললেও নেই কাঠফাটা গরম। নিয়মিত বৃষ্টির পরশ দিয়ে যাচ্ছে জনজীবনে। গাছপালায় ধূলার আস্তরণের পরিবর্তে সজীবতায় ছেয়ে রয়েছে। এপ্রিল চলে গেলেও ঢাকার রাস্তায় লাল রঙে ছেয়ে রয়েছে কৃষ্ণচূড়ায়। বাহারী সাজে সেজেছে বিভিন্ন ফুলে। এ যেন একটি নতুন ঢাকার শহর।
করোনার আঘাত মানুষের জন্য একটি অভিশাপই বটে। কলকারখানা, অফিস আদালত বন্ধের কারণে মানুষের আয় রোজগার নেই। উৎপাদনও থেমে গেছে। মানুষের ঘরে ঘরে অভাব যেন ঝেঁকে বসছে ধীরে ধীরে। সবার মধ্যে হাপিত্যেশ যেন বেড়েই চলেছে। বর্তমান অবস্থায় মানুষ অসহায় বোধ করছেই, কিন্তু করোনা সংকটের পরবর্তী সময়ে কী হবে তা নিয়ে কারোই যেন ভাবার উপায় নেই। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ বাঁচবে কি করে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনাও চলছে। সরকারে পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন। যে যেভাবে পারছে একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও তাদের সুবিধাগুলো দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর কতো দিন! এর শেষ কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাস পৃথিবী থেকে কোনোদিনও শেষ হবে না। হয় এর ভ্যাকসিন বা টিকা বের করতে হবে, না হলে করোনার সাথে সহাবস্থান করেই জীবন চালাতে হবে। কোনো দেশ টিকা বা ভ্যাকসিনের আশার আলো দেখালেও, তা যেন অধরাই থেকে যাচ্ছে। তারপরও মানুষ আশা হাতরে চলছে, কোনো একটা সমাধানের। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে সবাইকেই একসাথে কাজ করতে হবে। বাড়াতে হবে সচেতনতা। করোনা ভাইরাস বন্ধ না করতে পারলেও এর বিস্তার রোধ সম্ভব। এর এটাই তখনই সম্ভব হবে, যখন সবাই সম্বলিতভাবে নিজ নিজ জায়গায় থেকে সচেতন হয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা মেনে চলবে। অন্তত এইটুকু আমরা করতে পারি নিজেদের গন্ডির মধ্যে থেকেই।
আর এই ফাঁকে ধরিত্রী মাতাও একটু বিশ্রাম নিয়ে নতুন করে জেগে উঠুক। আর আমাদের শিক্ষা হোক সংযমের। কর্তৃত্ববাদ কখনোই ভালকিছু এনে দিতে পারে না। তা মানুষের ক্ষেত্রে থেকে শুরু করে এই পৃথিবীতেও। যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ফলই আজ এই কোভিড-১৯।