শিরোনাম :
করোনা সংকট: বিশ্ব রাজনীতি ও অভ্যন্তরীন রাজনীতির মেরুকরণ
রবীন ভাবুক:
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যখন কোনো সংকট শেষ করে তারপরই প্রতিটা দেশের মধ্যে একটি রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়। সংকটগুলো যখন সৃষ্টি হয়, তার পরবর্তী সময়গুলো অনেক বেশি তীক্ষ্ম হয়ে ওঠে। বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) এর আঘাতে সারা বিশ্ব যখন মোকাবেলা করছে, তখন থেমে নেই আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯ সৃষ্টি ও বিস্তার নিয়ে অনেক জলঘোলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো বরাবরই বলে আসছে চীনের হুয়ান প্রদেশে করোনা ভাইরাস তৈরি করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ইরান আঙ্গুলি করছে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। বিশেজ্ঞরা বলছেন মানুষের ভুলের জন্যই করোনা আঘাতে বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। মানুষ পৃথিবীর সকলকিছুর উপর কর্তৃত্ব সৃষ্টির চেষ্টার জন্যই প্রকৃতির সুপ্ত বিষয়গুলো বেরিয়ে আসছে। লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনা তারই একটি ফল।
হতে পারে অনেক কিছুই। বিশ্বে ভাল-মন্দ সবকিছু নিয়ে রাজনীতির মেরুকরণের উদাহরণ রয়েছে। বিশ্বের বুকে নিজেদের দেশকে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ করা, অর্থনৈতিক স্বার্থসহ বিভিন্ন কারণে রাজনৈতিক খেলাগুলো চলতেই থাকবে। ছোট দেশ থেকে শুরু করে বড় দেশগুলো নিয়ে এই রাজনৈতিক খেলা হবেই। এটা একটি জোটবন্ধী খেলার মতোই। আবার প্রতিটা দেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও চলবে।
বাদ যাচ্ছে না বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশটিও। অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ এমনিতে না চাইলেও সব সময় রাজনৈতিক একটি বলয়ে থাকতে হচ্ছে। চীন-ভারত উভয় দেশকে সন্তুষ্ট রেখে বাংলাদেশকে যেভাবে এগুতে হয়, তেমনি দুই দেশের মিত্রদের সাথেও সেইভাবে সম্পর্ক ঠিক রেখে চলতে। বাংলাদেশ কোনো ক্ষেত্রেই স্বয়ং সম্পূর্ণ নয় যে, কোনো দিক থেকে কাউকে বাদ দিতে পারে। ধীরে ধীরে হাঁটতে শেখা বাংলাদেশ ইতিমধ্যে হতদরিদ্র দেশের স্বীকৃতি থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নত হয়েছে। কিন্তু নভেল করোনার আঘাতে পর দেশটির অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কিছুটা অনুমান করা গেলেও ঠিক অবস্থা বলা যাচ্ছে না।
এরমধ্যে নিয়মিত আলোচনার বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ছক কেমন হবে। দেশে দুটি সক্রিয় রাজনৈতিক দল রয়েছে। একটি সরকারী দল আওয়ামী লীগ, অন্যটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। অন্য একটি দল জাতীয় পাটি (জাপা) সরকারী দলের পোষ্য হিসেবেই সবাই জানে। আওয়ামী লীগ সকরার পরপর তিন মেয়াদে সরকার প্রতিষ্ঠা করে দেশ শাসন করছে। পাওয়া- না পাওয়ার হিসেব অনেকই রয়েছে। তবে বর্তমানে করোনা ভাইরাসের সংকটের বেশিরভাগ দায়ই আওয়ামী লীগ সরকারকেই নিতে হবে। যদিও সরকার নভেল করোনা দাওয়াত দিয়ে আনেনি। কিন্তু করোনা বিস্তার, যাবতীয় দায়-দায়িত্ব পালনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সরকারেরই। ইতিমধ্যেই সরকার সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছে করোনা বিস্তারে। করোনা বিষয়ে সরকার অনেক দেরিতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসীদের বিষয়ে সরকার পূর্বে থেকে সতর্ক হলে দেশে করোনার বিস্তার হতোই না। জানুয়ারির পর থেকে বাংলাদেশ প্রায় সাড়ে ৬ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশে ঢুকেছে। এর মধ্যে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্রসহ সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত দেশ থেকেই বাংলাদেশে বেশি প্রবাসী এসেছে। সরকারের পররাষ্ট্র দফতর নিশ্চয়ই করোনা বিষয়ে জানতো। কেননা নভেম্বর ২০১৯ থেকেই করোনা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে সংবাদ আসতে থাকে। সুতরাং ব্যাপকভাবে করোনার বিস্তারের দায় সরকারকেই নিতে হবে। অন্য দিকে স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন সেক্টরে দুর্বলতা তো ইতিমধ্যে করোনাই প্রমাণ করে দিয়েছে।
সরকার প্রশংসনীয় অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে তা অনেক দেরিতে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ছিল দুর্বলতা ও ত্রুটিপূর্ণ। আবার দেখা গেল রাজনৈতিক দলগুলো এই সংকটময় মুহূর্তেও নিজেদের রাজনীতির সুবিধার্থে নিজেদের মতো কথা বলছে এবং জায়গা পোক্ত করছে। বিভিন্ন উন্নত এমনকি অনুন্নোত দেশগুলোতেও দেখা গেছে সব মতনির্বিশেষে রাজনৈতিক দলগুলো করোনা সংকট মোকাবেলা করতে এক জোট হয়ে কাজ করছে। সেখানে বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলো দোষ চাপানোর কাজে ব্যস্ত। বিএনপি তো আওয়ামী লীগ সরকারকে কাঠ গড়ায় দাঁড় করাতে একটুও ভুলছে না। আবার তাদের আরেকটি ক্ষোভ দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্নিতী মামলা থেকে করোনাকালেই শর্তারোপ করে জামিন দিয়েছে। সবমিলিয়ে সব দলই নিজেদের অবস্থান ঠিক রাখতেও তৎপর। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, কিছুটা হলেও দলীয় স্বার্থ অনেকাংশে কিছুটা কম।
সরকার দলের একটি বিষয় মানুষকে কিছু হলেও স্বস্তি দিয়েছে, তা হলো করোনা সংকট মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সে সমস্ত নেতা বা প্রতিনিধি সরকারী ত্রাণ ও দ্রব্য নিয়ে দুর্নিতী বা চুরির মতো ঘৃণ্য অপরাধ করেছে তাদের শাস্তি নিশ্চিতসহ দল থেকেও বহিস্কার করা হয়েছে। আবার বিরোধী দলও সরকারের কিছু কিছু পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। করোনা পরবর্তী সময়ে হতে পারে অনেক কিছুই। ভাল খারাপ নির্ভর করছে দেশের মানুষ ও সরকার দল ও বিরোধী দলগুলোর অবস্থানগত নৈতিকতা এবং সহযোগিতার উপর। তবে অবস্থা দৃষ্টে আশা করা যায়, দেশের সামগ্রিক চিত্র অনেকাংশেই সুষ্ঠ ও সৃজনশীল হবে। দেশের মানুষ এটাও হয়তো দেখবে, সকল রাজনৈতিক দল এক যোগে দেশের উন্নয়নে কাজ করছে। যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটা দুরূহ।
পাশাপাশি সরকারী কর্মকর্তাদেরও তাদের নৈতিক দায়িত্ববোধ সম্পন্ন হওয়া নিশ্চিত করতে যে সরকারই আসুক না কেন, তাদের পশ্রয় দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সরকারী কর্মচারীদের জন্য সরকার নানা ধরণের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বেতন কাঠামোও করেছে আকর্ষণীয়। এরপরও সরকারী কর্মচারীদের দুর্নিতী ও দায়িত্ব পালনে অবহেলার চিত্র দেখা যায়। সরকার কঠোর হাতে তাদের দমন করলে সরকারের সকল পদক্ষেপই সফল হবে।
নভেল করোনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, যোগাযোগসহ সবকিছুই নড়বরে। সরকারের এখনই উপযুক্ত সময় এই সমস্ত জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করার। মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে। তাই এটাও আশা করতে পারা সম্ভব, সরকার ও সকল রাজনৈতিক দলের সহাবস্থান।