শিরোনাম :
কারিগরি শিক্ষা হলো জীবনমুখী : সিটিএসপি প্রজেক্ট ম্যানেজার ডমিনিক দিলু
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে! এগিয়ে যাচ্ছে দেশ এবং সমাজের গতিপ্রকৃতি। বর্তমানে বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। দারিদ্রতার কবল থেকে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলেছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে উন্নয়নের প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অবকাঠামোগত পরিকল্পনা, শিক্ষাসহ নানা বিষয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে নিজেকে একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়তে যাচ্ছে। শিক্ষায় এসেছে নানামুখী পরিবর্তন। বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার কারিগরি শিক্ষা বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষা ব্যাবস্থায় কারিগরি প্রশিক্ষন একটি বিশেষ ধারণায় উন্নীত। সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কারিগরি কার্যক্রম নিয়ে দেশে দক্ষ কর্মী তৈরীতে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ‘কারিতাস টেকনিক্যাল স্কুল প্রজেক্ট (সিটিএসপি)’ সুনামের সাথে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে কারিগরি প্রশিক্ষণে অবদান রেখে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন বিভাগে স্থায়ী টেকনিক্যাল স্কুল এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেকগুলো ভ্রাম্যমান স্কুল পরিচালনা করছে সিটিএসপি। কারিগরি শিক্ষা, প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব, চ্যালেঞ্জ এবং ক্যারিয়ারসহ নানা বিষয়ে ডিসিনিউজের নিউজ চীফ রবীন ভাবুক কথা বলেন ‘কারিতাস টেকনিক্যাল স্কুল প্রজেক্ট (সিটিএসপি)’ এর প্রজেক্ট ম্যানেজার ডমিনিক দিলু পিরিছ এর সাথে। তিনি বিস্তারিত তুলের ধরেন কারিগরি শিক্ষার বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং দিকনির্দেশনা।
কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব
ডমিনিক দিলু : আমরা যদি আন্তরিকতা নিয়ে কারিগরি শিক্ষা পরিচালনা করি তাহলে যে সকল পরিবর্তন দেখতে পাব; কারিগরি শিক্ষার ফলে দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরী হবে, লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ হবে এবং পর্যায়ক্রমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, দারিদ্র্য বিমোচনে এ শিক্ষা সক্রিয় ভূমিকা রাখবে, দক্ষ জনশক্তিকে বিদেশে পাঠিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে, মহিলারা কর্মমুখী হবে, পরিবারে ও সমাজে তারা মূল্যায়িত হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়বে, কর্মে নিয়োজিত হলে হতাশা দূর হবে, অসহায় তালাকপ্রাপ্ত বিধবা মহিলারা আশার আলো দেখতে পাবে। আত্মসম্মান বজায়ে রেখে আত্ম-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হতে পারবে।
সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করণ
ডমিনিক দিলু : আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য জীবনমুখী শিক্ষার আরো বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। কারিগরি শিক্ষার বিষয়টি আমরা এখনও সহজভাবে নেই না। কোন ছেলে মেয়ে একটু দুষ্টুমী করলে বা পরীক্ষায় ভাল ফলাফল না করলে সবাই বলতে থাকবে ওকে/ ওদের টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি করে দাও। কিন্তু এটা সত্য, সাধারণ শিক্ষা শেষ করে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বেকার এবং হতাশায় ভুগছে। আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো সেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশী কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত। তাই আমার মতে আমাদের দেশের উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার সিলেবাসে কারিগরি শিক্ষার কিছু বিষয় সংযুক্ত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার পর্যাপ্ততা এবং নানামুখী পদক্ষেপ
ডমিনিক দিলু : বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের কথা ভাবতে গেলে অবশ্যই দেশের শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিতদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। বেকার ও কর্মমুখী যুবকদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে দেশের অর্থনীতির চিত্রটাই সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে পারে। সারাবিশ্ব প্রযুক্তিসহ সবদিকে ঈর্ষণীয়ভাবে এগিয়ে গেছে তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টার কারণে। আমাদের অসচেতনার ফলে দেশে বেকার বা কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ফলে শিক্ষা, অর্থনীতিসহ অনেক ক্ষেত্রেই কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জন করতে পারছে না। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠির হার বর্তমান ৩% হতে বৃদ্ধি করে ২০% করার যে নীতি সরকার স্থির করেছে সে অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে অবশ্যই একটা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাবে।
আমাদের দেশে আমরা কাজ করতে গেলে কতটুকু আন্তরিকতার সাথে করি সেটা প্রায় সব সময় প্রশ্নবোধক হয়ে যায়। সরকার পরিচালিত বেশির ভাগ টেকনিক্যাল স্কুলে নির্ধারিত শিক্ষক নাই অথবা শিক্ষক সঠিক সময়ে ক্লাস নিচ্ছেন না। আবার অনেক যন্ত্রপাতি আছে বছরের পর বছর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, ছাত্রদের শিখানো হচ্ছে না। এ ছাড়াও কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে যে সকল বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার তা হল; সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো। একটি স্তর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষা থাকা দরকার (হতে পারে অষ্টম শ্রেণী) এবং পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত শিক্ষার স্তর ঠিক করা। দেশের ও দেশের বাইরের শ্রমবাজারের চাহিদা বিবেচনা করে কারিগরি শিক্ষার স্তর বিন্যাস করা ও সিলেবাস ঠিক করা। সরকারের কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোগকে গুরুত্ব দেয়া এবং উভয়কেই জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা। সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষকসহ অন্যান্যদের প্রয়োজনীয় পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দেয়া। প্রয়োজনীয় অবকাঠমো নির্মাণ করা।
কারিতাস টেকনিক্যাল স্কুল প্রজেক্ট (সিটিএসপি)
ডমিনিক দিলু : বিগত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কারিতাস পেশাভিত্তিক ও দক্ষ জনশক্তি তৈরীতে সহায়তা করছে। বর্তমানে ২০টি ভ্রাম্যমান (মোবাইল) ও ১০টি স্থায়ী স্কুল অর্থাৎ এ দু’ধরণের প্রকল্পের মাধ্যমে দুই বছর, এক বছর, ছয় মাস ও তিন মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। সিটিএসপির মাধ্যমে অটোমেকানিক, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড মটর ওয়্যান্ডিং, ওয়েল্ডিং এন্ড ফেব্রিকেশন, ইলেকট্রনিক্স এন্ড মোবাইল ফোন সার্ভিসিং, টেইলারিং এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সুইং, পশুপালনসহ বিভিন্ন চাহিদাভিত্তিক বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া। সিটিএসপি পরিচালিত স্কুলগুলোতে যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার উর্ধ্বে এসএসসি, বয়স ১৬ হতে ২২ এবং অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র পরিবারের যুবক/ যুব মহিলা, বিশেষ করে আদিবাসী/ উপজাতি, বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, গুনগত ও সময়োপযোগী কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, সুবিধাবঞ্চিত যুবক ও যুব-মহিলাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির সুযোগ প্রদান করা, পাশকৃত প্রশিক্ষণার্থীদের বিভিন্ন কোম্পানীতে চাকুরীর জন্য সহযোগিতা করা, পাশকৃত প্রশিক্ষণার্থীদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন করা। এছাড়াও যারা চাকুরীতে যাবে না তাদের জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায় সহযোগিতা করা।
ছেলেমেয়েদের কারিগরি সেক্টরে ক্যারিয়ার
ডমিনিক দিলু : বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বই পড়ে মুখস্ত করা হয় । যার কারণে সবাই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় কিন্তু পরবর্তীতে বাস্তবতার সাথে কোন সম্পর্ক থাকে না। ক্যারিয়ার প্লানিং বলে আমদের বেশিরভাগ মানুষেরই কোনো ধারণা থাকে না। তবে এটা সত্যি কারিগরি শিক্ষা এবং সাধারণ শিক্ষার প্রধান পার্থক্যটাই হচ্ছে কারিগরি শিক্ষাটা হবে জীবনমুখী। সে ক্ষেত্রে যারা এই সেক্টরে আসতে চায় তাদের আগেই ঠিক করতে হবে সে আসলে ভবিষ্যতে কি করতে বা কি হতে চায়। কারন এখানে যা পড়বে শিখবে বাস্তব জীবনে যেন সে সেটাই করতে পারে। অর্থাৎ ডাক্তারী পড়ে আইনী অথবা আইন পড়ে কেউ যেন ডাক্তারী পেশা হিসেবে না নেয়। তবে খুব সাদামাটা উত্তরটি আমার এ রকম যে, বর্তমানে দেশে লক্ষ লক্ষ বেকার থাকলেও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে এখনো বেকার রয়েছে এ রকম কেউ নেই।
দীর্ঘদিন কারিগরি শিক্ষায় অবদান রাখা সিটিএসপির অভিজ্ঞতা, ব্যর্থতা সফলতা এবং অর্জন
ডমিনিক দিলু : কারিতাস টেকনিক্যাল স্কুল প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে এ পর্যন্ত লক্ষাধিক বেকার, সল্পশিক্ষিত দরিদ্র ছেলেমেয়েদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলেছে। এদের মধ্যে গড়ে নব্বই শতাংশেরই দেশে বা দেশের বাইরে কর্মসংস্থান হয়েছে। পরিবারে সকলের মুখে হাসি ফুটেছে, দেশের সম্পদ বৃদ্ধিসহ না পরিবতর্ন হয়েছে। আমাদের প্রকল্পের উদ্দেশ্য শতভাগ সফল হয়েছে। এ পযার্য়ে আমি প্রয়াত ব্রাদার ডোনাল্ড বেকার সিএসসির নাম কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি যার দূরদর্শিতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং তার হাত ধরে কারিতাসের এই অর্জন।
দেশের অবকাঠামোগত পরিবর্তনে কারিগরি শিক্ষার ভূমিকা
ডমিনিক দিলু : দেশের অবকাঠামোগত পরিবর্তনে কারিগরি শিক্ষা অবশ্যই ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। কারিগরি শিক্ষার ছাড়া দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরী হবে না। আর দক্ষ জনশক্তি ব্যতিত আমরা উন্নয়ন প্রত্যাশা করবো কিভাবে? আমরা যে সকল দেশকে উন্নত দেশ বলি তাদের ৬০ ভাগের বেশি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশেরও শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করতে হবে। আজ সিটিএসপি বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য জনশক্তিকে প্রশিক্ষিত করে যাচ্ছে। সরকারের উচিত কারিগরি শিক্ষাকে গণমুখী করার লক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নেওয়া এবং জনসাধারণের মধ্যে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে একটি ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করা।
আরবি/আরপি/এসএন/১০ জানুয়ারি, ২০১৬