শিরোনাম :
চিরবিদায় : দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের এক মহানায়ক ফাদার রবার্ট এস্টোরিনো
|| রাফায়েল পালমা ||
লেখালেখির জীবনে যাঁকে গুরু হিসেবে বিবেচনা করি, তিনি আমার তৎকালীন বস মি. যেরোম ডি’কস্তা। উনার পর যিনি আরো খুঁটিনাটি বিষয়ে বিশদ দীক্ষা দিয়েছিলেন, তিনি বিগত ২৫ জুন (২০২০) আমেরিকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মেরীনোল সম্প্রদায়ের ফাদার রবার্ট এস্টোরিনো (ফাদার বব)। মৃতকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
১৯৮৮ সালে ফাদার এস্টোরিনো, যিনি ফাদার বব নামে বহুল পরিচিত, প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন। তৎকালীন উকান (UCAN) বা ইউনিয়ন অব ক্যাথলিক এশিয়ান নিউজের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক। উকানেরই এশিয়া ফোকাশ নামে আরেকটি সাপ্তাহিক প্রকাশনা তাঁরই তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হতো।
পরে তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল এ দেশের কিছু উদীয়মান যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে উকান প্রতিনিধি করা। তাঁর মহাপ্রয়াণে বারংবার তার মুখোচ্ছবি ভেসে উঠছে আমার মনে। তিনি একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে চার্চে কাজ করেছিলেন। ক্যাথলিক মন্ডলীকে নানাভাবে সংস্কার করাই ছিল এই সংবাদ নেটওয়ার্কের প্রধান উদ্দেশ্য। তিনি পরে ভাতিকানে পোপের খুব কাছের একজন হয়েও কাজ করেছিলেন বলেও জানা যায়।
ফাদার বব যখন আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন, তখন সর্বদা বলতেন বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে বৈচিত্র্যের দিক থেকে সেরা। তাই প্রথমেই তিনি আমাদের হাতেগোণা ছয়-সাতজন প্রতিনিধি তৈরি করার জন্য সুদূর হংকং থেকে চলে আসেন। সেখানেই ছিল তাঁর প্রশাসনিক অফিস। তখন সম্পাদকীয় কার্যনির্বাহের জন্য থাইল্যান্ডে অফিস নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে থাইল্যান্ডেই এই অফিস বিদ্যমান।
দৈহিকভাবে ফাদার বব ছিলেন একজন দীর্ঘদেহী সুপরুষ। তাঁর প্রশিক্ষণের চৌকসতা সবাইকে মুগ্ধ করতো। প্রথমেই সকল অংশগ্রহণকারীর পরিচয় জেনে নিতেন তিনি। নিজের পরিচয় দিতেন। তারপর পর্যায়ক্রমে সংবাদ পরিচিতি শুরু করতেন। নিখুঁতভাবে আমাদের বুঝাতেন কোনটি সংবাদ এবং কোনটি সংবাদ নয়। কেন একটি ঘটনা সংবাদ হয়, আবার কেন সংবাদ হয় না, তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বুঝাতেন। তাঁর যুক্তি ছিল অকাট্য।
দ্বিতীয় পর্যায়ে উকান সংবাদ কোনটি এবং কেন, তার ব্যাখ্যা দিতেন উদাহরণসহ। সংবাদের মধ্যে ফিচার লুকিয়ে থাকে কীভাবে তা-ও তিনি সরল ইংরেজি ভাষায় বুঝাতেন। পরে সংবাদের সাথে ফিচারে পার্থক্য বুঝাতেন। তাঁর কথা বলার ভঙ্গিমা, পদক্ষেপের ধরন, উপস্থাপনার কৌশল- সকলকিছুই ছিল অপূর্ব। তাঁর বক্তব্য আমাদের অন্তরে ও মস্তিষ্কের গভীরে প্রবেশ করতো।
ফাদার বব আরেকটি বিষয় আমাদের অতি সতর্কতার সাথে শিক্ষা দিতেন। কীভাবে আন্তর্জাতিক পাঠকদের জন্য সংবাদ লিখতে হয়। একটি ঘটনার বিষয় দেশি পাঠকের (অডিয়েন্সের) জন্য যে ভাষায়-ঢঙে ও যে কৌশলে লেখা হয়, একজন বিদেশি পাঠক, যিনি বাংলাদেশ সম্বন্ধে তেমন কিছু জানেন না, তার জন্য একই ঘটনার বর্ণনা করতে গেলে কিছু অন্যরকম কৌশল ব্যবহার করতে হয়। তিনি আরো একটি কথা জোরেশোড়ে বলতেন, সেটি হলো, ‘বেবিটক’ বা শিশুর মতো কথা বলে ঘটনার বিষয়বস্তু পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরার কৌশল। এতে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল শ্রেণির মানুষ ঘটনার আদিঅন্ত পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন। তাতে সার্থক হয় সংবাদ লেখক, সফল হয় তার সংবাদ লেখার উদ্যোগ।
মোটকথা, ফাদার ববের কথা ছিল, ছোট ছোট বাক্যে, কাটা-কাটা অংশে, ছোট ছোট প্যারাতে বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বর্ণনা তুলে ধরতে হবে। এতে ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ বুঝতে পাঠকের কোনো অসুবিধা হয় না। বিষয়টি হলো এই যে, যত বেশি পাঠক একজন সংবাদকর্মীর লেখা পড়ে সহজে বুঝতে পারবে, সংবাদকর্মী ততই সংবাদশৈলিতে সফল হিসেবে বিবেচিত হবো। ভবিষ্যতে পাঠক সেই সাংবাদিকের লেখা খবরের দিকে স্বাভাবিকভাবেই বেশি নজর দেবেন। তার লেখা সংবাদ পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করবে।
বলছিলাম ফাদার ববের মহাপ্রয়াণের প্রসঙ্গে। তিনি প্রশিক্ষণের মাঝে মাঝেই আমাদের হাতের কাজ দিয়ে একটু আড়াল গিয়ে ধূমপান করতেন। চেঞ্জস্মোকার হিসেবেই তিনি পরিচিত। তবে পরে হৃদযন্ত্রের নানা জটিলতা শুরু হলে তিনি নিয়মিত হাঁটতেন ও ধূমপানও বন্ধ করে দেন।
ফাদার বব ১৯৮৮ সালে যখন ঢাকায় আমাদের প্রথম প্রশিক্ষণ দিতে আসেন, তখন মাত্র আমি বিয়ে করেছি। কারিতাসের প্রধান কার্যালয় ছেড়ে ওয়ার্ল্ড ভিশনে যোগ দিয়েছি। যাহোক, কারিতাসের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ কোর্সের দিনের শেষে তিনি আমার প্রস্তাবে রাজী হলেন আমার লক্ষ্মীবাজার ভাড়া বাসায় ভিজিট করতে। আমি নিজে সাধারণত বাসে চলাচল করলেও সেদিন তাঁকে নিয়ে রিক্সায় করে মালিবাগ থেকে লক্ষ্মীবাজারের কুলুটোলা কাঠেরপুল এলাকায় গিয়েছিলাম। তাতে তিনি ঢাকার কিছু প্রাচীনতম নিদর্শন দেখতে পেয়েছিলেন। পুরান ঢাকার নতুন-পুরান অবকাঠামো দেখে এই শহরের ঐতিহ্য সম্বন্ধে অনেককিছুই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।
লক্ষ্মীবাজার আমার বাল্যবন্ধুর সাথে আমরা নবদম্পত্তি সাবলেট হিসেবে থাকতাম। সেই ছোট বাসায় পৌঁছে আমার স্ত্রীকে প্রথম দর্শনে বলেছিলেন: ‘This is your black diamond.’ তিনি যেকোনো বিষয় ও বস্তুকে অতি সাধারণ ও সাদামাটা ভাষায় স্পষ্ট ও জীবন্ত করে অন্যের কাছে চিত্রায়িত করতে পারতেন। মনোমুগ্ধকর বাচনভঙ্গি ও প্রকাশ ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে।
প্রশিক্ষণে মাঝে মধ্যেই তিনি একটি কথা বারবার বলতেন, একজন বক্তা যখন মানুষে মাঝে কথা বলে, তখন তাঁর বাচনভঙ্গির সাথে তার শরীরের ভাষার সংমিশ্রণ ঘটে। উনি মুখের কথার অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তার চিন্তা-আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটান। কিন্তু একজন সংবাদ লেখক বা সংবাদকর্মী যখন তার লেখনীর মাধ্যমে লিখেন, লিখিত ভাষার মাধ্যমে অন্য পাঠকের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে চান, তখন তাঁর উপযুক্ত শব্দ, বাক্য, বিশেষণ ব্যবহারের মাধ্যমে ওইসব শরীরের ভাষার বা আবেগের প্রকাশ ঘটাতে হবে। এই কৌশলের পূর্ণ ব্যবহার করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুল ইসলাম, হুমায়ূন আহমেদ, প্রথম আলোর আনিসুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবু সায়ীদ চৌধুরী ও হুমায়ূন আজাদসহ অনেক লেখক-সাহিত্যিক।
উকান প্রতিষ্ঠাতা ফাদার ববের কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি, নিত্যদিন তার ব্যবহার করার চেষ্টা করে চলেছি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার। ফাদার প্রশিক্ষণের মধ্যে প্রশ্ন-উত্তরের সেশনে আমি একবার প্রশ্ন করেছিলম, ‘যদি কোনো ব্রতধারী একজন ব্রতধারিণীকে নিয়ে উধাও হয়ে যান, তবে সেটি কি উকান নিউজ হবে কি-না?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘No, that is not a news, that is scandal. প্রতিত্তোরে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, Scandal কি নিউজ নয়? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, `That is news, but not UCAN news.’ যদিও তাঁর ব্যাখ্যা আমার মনোপুতো হয়নি, আমি বুঝে নিয়েছিলাম উকানের চাহিদা কী? তারপর থেকে সক্রিয়কর্মী হিসেবে ২০-২২ বছর প্রায় ৪০০-৫০০টির মতো নিউজ, ফিচার, সাক্ষাৎকার ও নিজের তোলা ছবি দিয়ে তৎকালীন উকান ও এশিয়া ফোকাসকে সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করেছি। আমি মনে করি, মূল স্রোতধারা চাকরির পাশাপাশি উকানে নিউজ ও নানা ধরনের লেখার চর্চা আমার সংবাদজ্ঞানকে কিছুটা হলেও বৃদ্ধি করেছে। আমাকে আর্থিক দিক থেকেও সমৃদ্ধ হতে সহায়ক হয়েছে।
‘সংবাদ লিখন ও নেতৃত্ব’ শিরোনাম সেশনে প্রসঙ্গক্রমে নেতা কত প্রকার ও তাঁরা কীভাবে সমাজে নেতৃত্ব দিতে পারেন তারও বিস্তারিত বর্ণনা দিতেন। তিনি বলতেন, যাঁরা লেখক-সাংবাদিক, তাঁদের সুদক্ষ ও যুক্তিপূর্ণ লেখার কারণে রাষ্ট্রে ও পৃথিবীতে বড় বড় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়, তাতে বিশ্বটা বদলাতে পারে। এভাবে উৎসাহ দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করতেন। বিশ্বনেতাসহ প্রচলিত নেতাদের ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে মিথ্যাবাদী। একটু ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, ‘সামাজের স্বার্থে হোক বা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে হোক- তাঁরা মিথ্যাবাদী। রাষ্ট্রের স্বার্থে হোক, মানবতার স্বার্থে হোক বা ধর্মের স্বার্থে হোক তাঁরা মিথ্যাবাদী।’ তবে কোনো অবস্থানেই নেতার অনুপস্থিতিকে অবজ্ঞা করেননি তিনি। কারণ, নেতাদের ঘিরেই নানা সংবাদ আবর্তিত হয়।
ফাদারের কয়েকবার বাংলাদেশে আসা ও সংবাদবিষয়ক সেশন দেওয়ার কারণে আমার মনের মধ্যে কিছু বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। বার বার আমার মনে হয় সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে সমাজে সাধারণ মানুষের ও রাষ্ট্রের উপকার করার স্বাদ যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা সংবাদ মাধ্যম নিয়েই জীবন অতিবাহিত করবেন। এই স্বাদ পেতে আমাকে আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন ফাদার বব। জীবনে সঠিক পথ বেছে নেওয়ার প্রশ্নে যখন নানাভাবে দ্বিধান্বিত ছিলাম, ঠিক তখন ফাদার ববের মতো একজন সাহসী ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য আমাকে গৌরাবান্বিত করেছে। সংবাদকর্মী কখনো সম্মান পাবেন, আবার কখনো অপমানিত হবেন; বিষয়টি মাথায় নিয়েই সংবাদকর্মীকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। ফাদারের সেশন বদলে দিয়েছেন আমার মতো আরো অনেকের জীবনধারা। ফাদার ববের মহাপ্রয়াণে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম।
ছবি: উকান