শিরোনাম :
ছয় দফায় বাংলার মুক্তি
।। রেমন্ড আরেং ।।
৭ জুন। বাঙালির মুক্তিসনদ ঐতিহাসিক ’ছয় দফা’ দিবস। জাতির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে একটি অনন্য দিন। প্রতিবাদী বাঙালির আত্মত্যাগের সংগ্রামী দিন এটি। বাংলার মানুষের ওপর জেঁকে বসা উপনিবেশিক পাকিস্তানিদের অত্যাচারী শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের শিকার বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ আধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ’ছয় দফা’ দাবি উত্থাপন করেন।
বাঙালি বরাবরই একটি সংগ্রামী, প্রগতিশীল জাতি। যুগে যুগে, কালে কালে বিভিন্ন অন্যায়-অবিচার, শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার থেকেছে, সংগ্রাম করেছে। কোনো শক্তির কাছেই মাথা নত করেনি কখনো। অসীম শক্তিধর বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে যেমন বাঙালি সোচ্চার থেকেছে, তেমনি পাকিস্তানী স্বৈরশাসক-শোষকদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধেও নির্ভীকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন বাঙালির হার না মানা আন্দোলন আর সংগ্রামেরই ফসল। আর এরূপ আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরেই ধীরে ধীরে স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে এই জাতি এগিয়ে গেছে দৃপ্ত পদক্ষেপে।
পাকিস্তানী শাসকদের নানান অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর কর্তৃক উত্থাপিত ছয় দফা দাবির মধ্য দিয়ে বাংলার মাটিকে স্বাধীন করার বীজ রোপিত হয়। তাই ’ছয় দফা’ বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিস্বরূপ। দীর্ঘকাল ধরে শাসকগোষ্ঠীর সীমাহীন নিগ্রহ, অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনার শিকার বাঙালি মুক্তির নতুন দিকনির্দেশনা পেয়েছিল ’ছয় দফা’ দাবির মধ্য দিয়ে । ’ছয় দফা’ দাবি তাই বাঙালির মুক্তির সনদ।
’ছয় দফা’র মূল বক্তব্য ছিল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে অর্পণ করা। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করা, সরকারের কর, শুল্ক আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যাস্ত করা, দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পৃথক হিসাব রাখা এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে এখানে আধা-সামরিক বাহিনী গঠনসহ নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ’ছয় দফা’ দাবি পূর্ব বাংলায় এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে ’ছয় দফা’র পক্ষে গণজোয়ার দেখে তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন,’ছয় দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়া হবে।’
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল বিরোধী দল নিয়ে একটি জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির কাছে ’ছয় দফা’ উত্থাপন করেন এবং সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন যাতে পরের দিনের আলোচ্যসূচিতে এটি স্থান পায়। কিস্তু সম্মেলনে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁরা তা আমলে না নিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। এতে বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ হয়ে সম্মেলনে যোগদান থেকে বিরত থাকেন এবং ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ফিরে এসে বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘ছয় দফা’ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
উল্লিখিত বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নবাদী নেতা হিসাবে অভিহিত করা হয়। পরে ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামীলীগের কার্যনির্বাহী সংসদে দলের সকলকে ’ছয় দফা’ সম্পর্কে অবহিত করেন এবং এ ব্যাপারে দলের অনান্য বিস্তারিত কর্মসূচি পাস করিয়ে নেন।
বাংলার মানুষের মুক্তিসনদ ’ছয় দফা’ ঘোষণার পর এর পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে এবং এর যৌক্তিকতা তুলে ধরতে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে নোয়াখালীর মাইজদি, বেগমগঞ্জ, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ সদর এবং সিলেটে জনসভা করে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ’ছয় দফা’র পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে এবং এর যৌতিকতা তুলে ধরে আরোও ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি ’উপকমিটি’ গঠন করা হয় এবং তাঁরই নামে ’ আমাদের বাঁচার দাবি: ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। ওই বছরের মার্চ মাসের ১৮, ১৯ এবং ২০ তারিখে অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে পুস্তিকাটি উপস্থিত সকল কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
বাঙালির মুক্তি সনদ ’ছয় দফা’কে উপলক্ষ করে ১৯৬৬ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত হওয়া আওয়ামী লীগের তিনদিনব্যাপী এই কাউন্সিল অধিবেশন বাঙালির জাতীয় জীবনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই কাউন্সিল অধিবেশনেই ’ছয় দফা’র ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্রের সংশোধিত একটি খসড়া অনুমোদিত হয়। ’ছয় দফা’ কর্মসূচিী প্রদানের পাশাপাশি দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধন ও নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তাতে পরবর্তী সময়ে ’ছয় দফা’র চুড়ান্ত পরিণতি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের একটি সুুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। কারণ আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল অধিবেশনই ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচন এবং ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল।
’ছয় দফা’ কর্মসূচি সর্বস্তরের দলীয় কর্মীদের মধ্যে যেমন ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে, তেমনি গণমানুষের বিপুল সমর্থন লক্ষ্য করা গেছে। ’ছয় দফা’ দেওয়াকে দেশবিরোধী অপরাধ গণ্য করে তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ’বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসাবে চিহ্নিত করে এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর গ্রেফতার-নির্যাতন-জুলুম চালাতে থাকে। ’ছয় দফা’ প্রচারকালে বঙ্গবন্ধুকে মোট আটবার গ্রেফতার করা হয়। নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০ মে আওয়ামী লীগৈর কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় ৭ জুন দেশব্যাপী হরতালের আহ্বান করা হয়। ৭ জুনের হরতালে পুরো বাংলার মানুষ জ¦লে ওঠে, পুরো বাংলা হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। সারা বাংলার বিক্ষুব্ধ মানুষ বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়নগঞ্জে পুলিশ আর ইপিআর-এর গুলিতে মনু মিয়া, শামসুল হক, শফিকসহ ১১ জন বাঙালি শহীদ হন।
এই আন্দোলনের পথ ধরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন নেতৃত্বে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের দিকে পরাধীন বাঙালি জাতি এগিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ঐতিহাসিক ’ছয় দফা’ভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণতি লাভ করে।
১৯৬৬ সালের ৭ জুন যে সমস্ত আত্মত্যাগী ভাইয়েরা তাঁদের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে জীবন উৎসর্গ করে বাংলার মানুষের মুক্তির পথ সুগম করেছেন এবং যাঁদের সীমাহীন আত্মত্যাগের পথ ধরেই এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি মানচিত্র পেয়েছি, তাঁদের প্রত্যেককেই আমি অবনত মস্তকে শ্রদ্ধা জানাই।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে জাতীয় চার নেতাকে। একুশটি বছর পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা পাকিস্তানি ভাবধারায় বাংলাদেশকে পরিচালনা করেছে উল্টোপথে। এমনই নানান কঠিন ষড়যস্ত্র, বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করে দেশ আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে পরিচালিত হচ্ছে; তাঁর দূরদর্শী ও দক্ষ নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে।
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এরই মধ্যে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্য-বেকারত্ব, শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, কৃষি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং রফতানি আয় বেড়েছে, যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নত হয়েছে, নারী ক্ষমতায়ন বিস্ময়করভাবে সফল হয়েছে, গ্রাম কিংবা শহরে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, পঙ্গু ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বয়স্ক ভাতা এবং স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষা উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন, পদ্মা সেতু নির্মাণসহ একাধিক মেগা প্রকল্প আজ সমাপ্তির পথে।
উন্নয়নের সমস্ত সূচক আজ উর্ধ্বমুখী । স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ সমস্ত হত্যাকান্ডের বিচার করা হয়েছে। বিচারপ্রার্থীরা আজ বিচার পাচ্ছেন। সবশেষে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট অর্থনীতিসহ বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাবও তিনি অত্যন্ত শক্তহাতে সাহস ও বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করে যাচ্ছেন।
আমার বিশ্বাস, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাস্তবায়িত হবে ১৯৬৬ সালের ’ছয় দফা’র মৌলিক চেতনা, বাঙালি জাতির মুক্তির চেতনা, বঙ্গবন্ধুর দেখা ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত-স্বাধীন-সার্বভৌম অসাম্প্রদায়িক উন্নত বাংলাদেশ।
রেমন্ড আরেং: সদস্য, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ
রেমন্ড আরেং এর আরো লেখা পড়ুন: