ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৮ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

জীবনের গল্প

0
1052

মনিকা চম্পা গমেজ

দিনের আলোটা নিভে আসছিলো। আলো-আঁধারীর খেলায় চিরচেনা রাস্তাটা ধূসর হয়ে আসছে। অনেকদিন পর হঠাৎ করেই ভাবীর সাথে দেখা। কেমন আছেন জানতে চাইলেই কেমন যেন বিবর্ণ লাগছিলো তাকে। স্তিমিত মুখে বললেন,

–              “আছি, বেঁচে আছি, মানুষের জীবনতো সবসময় এক রকম চলে না”।

আমার মনের মধ্যে খটকা লাগলো। জানতে চাইলাম,

–              কোন সমস্যা হয়েছে?

ভাবী যা বললেন শুনে মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। খুব কান্না পাচ্ছিলো। অফিস শেষ করে ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফেরার পথে দেখা হয়েছিলো তার সাথে। নিজের মধ্যে কেমন যেন একটা তিক্ততা তৈরী হলো। এক কাপ কফি নিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। রেলিং ধরে বেড়ে ওঠা দোলনচাপাটা হালকা বাতাসে দোল খাচ্ছে।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে সাজানো এই বাসাটি। আটটি বছর পাড় হয়ে গেল এখানে। দেয়ালের প্রতিটা কোণে আমার অনুভূতিগুলো ঘুড়ে বেড়ায়। আমার ছেলের যখন দুই বছর বয়স তখন আমি এই বাসাতে আসি। এখন আমার ছেলের বয়স এগারো পাড় হলো। ছাদের উপরে থাকাতে আশে পাশে সবার সাথেই একটু ভাব হয়ে গেল।

পাশের বিল্ডিংয়েই থাকতেন সেই ভাবী। ভাবীর জানালা আর আমার ছাদ। অনেক গল্প হতো আমাদের, খাবার-দাবার আদান প্রদান করতাম। নিজেদের অনুভূতিগুলোও থেমে থাকেনি। আমার ছোট ছেলেটা প্রায়ই তার কাছে রুটি চাইতো, ভাবী হাসতেন আর লাঠির আগায় রুটি ঝুলিয়ে দিতেন। আজ সন্ধ্যার ভাবীর মুখখানী খুব মনে পড়ছে। মায়াময় মুখটা কেমন যেন মলিনতার ছাপে ছেয়ে আছে।

ভাবীর স্বামী ব্যবসায়ী মানুষ, প্রচুর টাকার মালিক। গাড়ি, ফ্ল্যাট সবই আছে । সুখের সংসার ভাবীর। স্বামী খুবই ভাল মানুষ, শ্বাশুড়ী, ননদ সবাইকে নিয়ে ভালই কাটত ভাবীর দিন। সবকিছু ঠিক চললেও, একটা না একটা অপূর্ণতা থেকেই যায়। তাই-ই হলো ভাবীর জীবনে। তাদের শুধু একটি সন্তান ছিল না। ভাবীর বাসায় যাতায়াতের কারনে তার স্বামীর সাথে পরিচয় হয়। তাদের সাথে একটি সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো আমাদের।

সন্তান নেই বলে ভাবী যেমন কষ্টের শেষ ছিলো না, তেমনি সবার মন জয় করার জন্য বাসার সব কাজ ভাবীই করতেন। ভাবী অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন একটা বাচ্চার জন্য। আমি নিজেও তাকে নিয়ে গিয়েছি ডাক্তারের কাছে। তিনি সব সময় প্রার্থনা করতে বলতেন, যেন একটি সন্তান হয়। পরিবার যেন পূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক দানশীল ছিলেন ভাবী, যদিও তিনি মুসলমান, কিন্তু যখনই কোন গরীব মানুষের গল্প বলতাম উনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন, তার কোন ধর্মের হিসেব ছিলো না।

হঠাৎ করেই ভাবীরা বাসা বদলে অন্য বাসায় চলে যান। মাঝে মাঝে দেখা হত রাস্তায়। আজো দেখা হল, ছেলেকে আদর করল। শেষে শুধু দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, আপনার ভাই আরেকটা বিয়ে করেছে। হয়তো তার চোখে তখন জল জমেছিলো, আমি দেখতে পারিনি। কিন্তু আমার মনের মধ্যে যে ধাক্কাটা লেগেছে, তার রেশ এখনো কাটেনি। ভাবী বিষন্ন মনে আরো বললেন, আমি সন্তান দিতে পারিনি, তাই হয়তো সন্তানের আশায় বিয়ে করেছে। কাকে দোষ দিবো বলেন? জীবনের অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়, তাই নিজের নিয়তিকে আর এড়াতে পারিনি। তবে আমি ভাবতেই পারিনি সে এমনটা করবে আমার সাথে। যত শক্ত মনেরই হোক না কেন তিনি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি, কেঁদে ফেললেন।ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। ১৮ বছরের সংসার, এক মুহূর্তে ভেঙ্গেচুড়ে মিলিয়ে গেল মাটির সাথে।

আমি কিছুই বলতে পারিনি তাকে। নিজের মধ্যে বোবা কান্নাটাকে চেপে যেতে হয়েছে। মুখ ফুটে একবারও তাকে সান্ত¦নার ভাষাটা বেড়িয়ে আসতে পারলো না। ভাবীর চোখের জলগুলোর সাথে আমার মনের কষ্টগুলো মিলিয়ে যাচ্ছিলো। অনেক কষ্টে নিজেকে চেপে রেখে চলে আসি বাসায়। এখনো নিজের মাঝে ধাতস্ত করতে পারছি না, কেন এমনটা হয় মানুষের জীবনে!

আমি জানিনা তার স্বামী কখনো ডাক্তার দেখিয়েছেন কিনা। তবে ভাবীর কোন সমস্যাই ডাক্তার ধরতে পরেনি। হয়তো তার স্বামীরই কোন সমস্যা ছিলো! তারপরও তাঁকেই ত্যাগস্বীকার করতে হল। যে মানুষটার পাশে থাকতেন ভাবী, আজ সেখানে অন্য কেউ। যে গাড়িতে ভাবী চড়তেন আজ সেখানে অন্য কেউ। ভাবীর সাজানো সোনার সংসার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল শুধুমাএ একটি সন্তানের জন্য। যে সময়টা ভাবীর ছিলো, তা আজ অন্যকারো অনুকূলে! এটাই কি জীবন, এটাই কি জীবনের মানে!