ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ঢাকা ক্রেডিট টিনের ঘর থেকে অট্টালিকা

টিনের ঘর থেকে অট্টালিকা

0
1339
টিনের ঘর থেকে অট্টালিকা হিমেল রোজারিও

 

হিমেল রোজারিও:

ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানার আওলাতুলি গ্রামের গারো আদিবাসী বালক মার্ক ঘাগ্রা। ছাত্রজীবনে স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি বাবাকে গরু পালনসহ কৃষিকাজে এবং সাহায্যে করতেন। মাধ্যমিক পাস করেন গ্রামের স্কুল থেকে। ধোবাউড়ায় তেমন ভাল কলেজ না থাকায় ময়মনসিংহ শহরে চলে আসেন কলেজ পড়ার জন্য।
ময়মনসিংহ মিন্টু কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন ১৯৮৬ সালে। পরে তার মনের মধ্যে ইচ্ছা জাগে পুরোহিত হওয়ার। তাই ধর্মপ্রদেশীয় ফাদারদের সাথে যোগাযোগ করে ‘সাধু যোসেফের সেমিনারী’ রমনাতে যোগ দেন। সেখান থেকে ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তারপর বনানীতে পবিত্র আত্মা উচ্চ সেমিনারী দর্শনশাস্ত্র পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু ভাল না লাগায় মেজর সেমিনারী ত্যাগ করেন। এরপর চাকরি পেলেন গ্রীন হ্যারাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে।
গ্রীন হ্যারাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতার স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র ছয় মাস। শিক্ষকতার চাকরি বাদ দিয়ে যোগ দেন ইটালীয়ান অ্যাম্বাসীতে। সেখানে চাকরি করেন একটানা প্রায় ১৪ বছর। তখন মার্ক থাকতেন ভাড়া বাসায়। বাসা ভাড়ার জন্য প্রতিমাসে বেতনের একটি বড় অংশ প্রদান করতে হয় বাড়ির মালিককে। কীভাবে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তার একটি উপায় বের করলেন। পরিকল্পনা মোতাবেক বর্তমান ঢাকার ফিউচার পার্কের উত্তর পাশে সাড়ে চার কাঠা জমি ক্রয় করে সেখানে একটি টিনের ছাপরা ঘর তৈরি করে ভাড়া দেন।

আরো পড়ুন: স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার!

১৯৯৭ সালে স্বামী-স্ত্রী দুইজনই ডিভি ভিসা পান আমেরিকা যাবার জন্য। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়ে দুইজনই চলে যান আমেরিকায়। সেখানে মার্ক ঘাগ্রার ভাল না লাগায় কিছু দিন পরে আবার বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন। কিন্তু স্ত্রী রোজ মূর্মু থেকে যান আমেরিকাতে। দুই বছর পর স্ত্রীও বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে আসার পর মার্ক ঘাগ্রা পুনরায় ইটালীয়ান অ্যাম্ব^াসীতে আরো সাত বছর চাকরি করেন।
কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল শিক্ষকতা দিয়ে। স্কুলের চাকরি কারার সময়ই একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার চিন্তা করছিলেন মার্ক। ১৯৯৯ সালে মার্ক একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। স্কুলের নাম দিলেন ‘লাইট দ্যা ওয়ার্ল্ড’। স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার জীবনের একটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন। স্কুলটি প্লে- থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রথম দিকে ভালই চলছিল স্কুলটি।
পরবর্তীতে কালাচাঁদপুর সরকারি বিদ্যালয় হওয়াতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কমে যায়। স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কমে যাওয়ায় আর্থিক সমস্যায় পড়তে হয়। স্কুলের জন্য মাস শেষে মোট অংকের টাকা দিতে হতো বাড়িওয়ালাকে। তখনই চিন্তা করলেন নিজের ক্রয়কৃত সাড়ে চার কাঠা জমিতে টিনশেড ঘর আছে সেখানে একটি বাড়ি তৈরি করলে স্কুলের ভাড়া দিতে হবে না। সাথে নিজের পরিবারের জন্যও কোনো বাসা ভাড়া দিতে হবে না। মনের চাপ ছাড়া স্বাধীনভাবে চলতে পারবেন।
বাড়ি তৈরি ঋণের জন্য প্রথমে কয়েকটি ব্যাংকের স্মরণাপন্ন হন। কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করলে প্রথমে ১০ বছরের সুদ পরিশোধ করার পরে ঋণের অর্থ ফেরৎ দিতে হবে। মার্ক ঘাগ্রার এক বন্ধু ব্যাংক থেকে ২০ লক্ষ টাকার ঋণ গ্রহণ করে। কিন্তু পুরো ২০ লক্ষ টাকার মধ্যে হাতে পেয়েছে ১৭ লক্ষ টাকা। তিন লক্ষ টাকা ব্যাংক ম্যানেজারকে ঘুষ প্রদান করতে হয়েছে। তাই মার্ক বাড়ি নির্মাণের জন্য ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করাটা সুবিধা মনে করেননি।
পরের তিনি ঢাকা ক্রেডিটের নদ্দা সেবাকেন্দ্রের ম্যানেজার সুবাস রোজারিও এবং তৎকালীন বোর্ড অব ডিরেক্টর এলিয়াস পিন্টু কস্তার সাথে বাড়ি নির্মাণ ঋণের বিষয়ে আলোচনা করেন। ম্যানেজার সুবাস রোজারিও এবং ডিরেক্টর এলিয়াস পিন্টু বর্তমান সেক্রেটারি পংকজ গিলবার্ট কস্তার সাথে আলোচনা সাপেক্ষে এবং সঠিক তদন্ত করে দশ বছরের জন্য এক কোটি টাকার ‘বাড়ি নির্মাণ ঋণ’ প্রদান করেন।
মার্ক ঘাগ্রা বলেন, সঠিক সময়ে কিস্তি পরিশোধ ও কখনো ঋণ খেলাপি না হওয়ার কারণে ঢাকা ক্রেডিট থেকে নিজস্ব জমিতে বাড়ি নির্মাণের জন্য ঋণ পেয়েছি। ঢাকা ক্রেডিটের বাইরে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে গেলে ঘুষ প্রদান ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা করতে হয়। ঢাকা ক্রেডিটে কোনো ঘুষের কারবার নেই। দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতার কোনো বেদনা নেই। ঢাকা ক্রেডিটে বাড়ি নির্মাণ ঋণের সুদের হার ব্যাংকের তুলনায় কম।
ঘাগ্রা বলেন, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ইত্যাদি নামের এনজিও থেকে অনেক খ্রিষ্টান মানুষ ঋণ গ্রহণ করে। সেই ঋণের সুদের পরিমাণ অনেক বেশি। এনজিও থেকে যেকোনো মেয়াদে ঋণ গ্রহণ করলে তার সুদ ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত সুদ মোট ঋণের ওপর সমান্তরাল পরিমাণ থাকে। ধীরে ধীরে সুদের পরিমাণ কমে না, কিন্তু ঢাকা ক্রেডিট থেকে যারা ঋণ গ্রহণ করেন, তারা কিস্তি প্রদান করার পর থেকেই ক্রমান্বয়ে সুদের পরিমাণ কমতে থাকে। তাই মার্ক বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ গ্রহণ না করে স্থানীয় ক্রেডিট ইউনিয়ন থেকে ঋণ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন।
নিজের এবং স্ত্রীর জমানো কিছু অর্থ দিয়ে বাড়ি নির্মাণ কাজ শুরু করেন মার্ক। এরপর ঢাকা ক্রেডিট থেকে ঋণ গ্রহণ করার পরে সেগুলো একসাথে যুক্ত করে একটি পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। নীচতলা এবং প্রথম তলা তার নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘লাইট দ্যা ওয়ার্ল্ড’ স্কুলের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাবার কারণে নীচতলা স্কুলের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চতুর্থ তলায় এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে থাকছেন মার্ক পরিবার। অন্য তলাগুলো ভাড়া দিয়েছেন। প্রতি মাসে তিনি নিয়মিত ভাড়া পাচ্ছেন এবং ঋণের টাকা পরিশোধ করছেন। ইতিমধ্যে তিনি প্রায় ১৮ লক্ষ টাকার বেশি ঋণ ফেরত দিয়েছেন অনায়াসে। ব্যাংকের মতো ঋণ গ্রহণের পর থেকে শুধু সুদ প্রদান করতে হয়নি। সুদ এবং ঋণ নিয়মিত ফেরত দিয়ে যাচ্ছেন। আর্থিক বিষয়টি তার নিজের আয়ত্তে।
প্রতিটি কাজে সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও রয়েছে। তেমনি বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে মার্ক কিছু সমস্যার সম্মুখীন হন। স্থানীয় কিছু নেতা নির্মাণ কাজে বাধা দেয়, চাঁদা দাবি করে। মার্ক ঘাগ্রা অনেক দিন যাবৎ বসুন্ধারা এলাকায় বসবাস করেন বিধায় স্কুল পরিচালনার জন্য স্থানীয় কিছু ব্যক্তি সাহায্য করেছেন, যেন তাকে চাঁদা দিতে না হয়। তার বাড়ি নির্মাণের শুরুতে এই সমস্যা দেখা দিলেও পরবর্তীতে আর কোনো নির্মাণ সংক্রন্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। কিন্তু বাড়ি নির্মাণের পরে বাসাভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে মার্ক ঘাগ্রাকে। অনেক সময় ভাড়াটিয়া চাকরি না থাকার কারণে ভাড়া পেতে দেরি হয়। তবে এটা বিরাট কোনো সমস্যা নয়।
ঢাকা শহরে যারা বাড়ি বা এপার্টমেন্টের মালিক হতে চান তাদের উদ্দেশ্যে মার্ক বলেন, যারা বাড়ি নির্মাণ করতে চান, তারা পূর্ব পরিকল্পনা এবং হিসাব করে নিবেন বাড়ি নির্মাণে কেমন খরচ হবে, নির্মাণের পরে যে পরিমাণ ভাড়া পাবেন, সেই টাকা দিয়ে ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে পারবেন কিনা। যারা এপার্টমেন্টের মালিক হতে চান, তারাও চাইলে ঢাকা ক্রেডিট থেকে ঋণ গ্রহণ করে এপাটর্মেন্টের মালিক হতে পারেন। প্রতি মাসে বাড়িওয়ালাকে ভাড়া দিতে হবে না, নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারবেন।
‘ঢাকা ক্রেডিটের সদস্য পদ গ্রহণ করার পরে যখনই সেবাকেন্দ্রে বা প্রধান কার্যালয়ে গিয়েছি, তখনই কর্মীদের কাছ থেকে ভাল মানের সেবা পেয়েছি। কখনও কোনো ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয়নি। কর্র্মীরা আমাকে যথেষ্ঠ সম্মান করেন এবং আমিও তাদের সম্মান করি’, বলেন মার্ক ঘাগ্রা।
এখন প্রতিবার মাসের শেষে মার্ক ঘাগ্রাকে বাসা ভাড়া দিতে হয় না। থাকতে হয় না অন্যোর বাসায়। বাসায় দেরিতে ফিরলে শুনতে হয় না কটু কথা। স্ত্রী স্কুলের দায়িত্বে আছেন। মেয়ে ও ছেলে পর্যায়ক্রমে ইন্টারমিডিয়েট ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিনি দেখাশোনা করেন বাড়ির। চাকরি থেকে নিয়েছেন অবসর। একসময় ছিল টিনের ঘর। আজ সেটি পরিণত হয়েছে পাঁচতলা অট্টালিকায়। সবই হয়েছে নিজ পরিশ্রম, মেধা ও সততার গুনে।

আরো পড়ুন

শেরপুরে খ্রিষ্টান কিশোরীর ধর্ষণের মামলা তুলে নিতে জীবননাশের হুমকি

বিশ্বে যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভাল ইংরেজি জানা

ঢাকার ক্রেডিটে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি

খ্রিষ্টান সমাজের ৯ জনকে সম্মাননা দিল ঢাকা ক্রেডিট

আফ্রিকার উগান্ডায় ব্রাদার নিহত