ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ফিচার নিঃস্ব হালিমা এখন আর ফেলে যাওয়া করুন অতীত নিয়ে ভাবে না

নিঃস্ব হালিমা এখন আর ফেলে যাওয়া করুন অতীত নিয়ে ভাবে না

0
582

“নিজের দোকানে কাজ করি। যা আয় হয় তা দিয়ে আমাদের ছোট সংসার চলে। ক্রেডিট ইউনিয়নের কিস্তি আর শেয়ার-সঞ্চয়ের টাকা জমা দেই, নানীর চিকিৎসা করাই আবার ছোট ভাইটির পড়াশুনার খরচও চলে। এক সময় মাতৃস্নেহের অভাব, সংসারের অভাব-অনটন আর দুশ্চিন্তায় যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের দুর্দিন এখন অনেকটা কেটে গেছে।” এক নিঃশ্বাসে বলছিলেন ২১ বছরের হালিমা।

কারিতাস আইসিডিপি ঋষি প্রকল্পের সহায়তায় গড়ে ওঠা একতা ক্রেডিট ইউনিয়নের সদস্য হালিমা খাতুনের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনী উপজেলার খাজরা গ্রামে। নদীর পাড়ে ওয়াপদার রাস্তার সাথে খাস জমিতে মাটির দেওয়াল এবং খড়ের চালের ছোট্ট একটি কুড়ে ঘরে নানী, খালা ও ছোট ভাইকে নিয়ে সংসার।

হালিমার বয়স যখন মাত্র এক বছর দুই মাস, তখন বাবা হার্ট এ্যাটাকে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর মা ভেবে পান না ‘ছোট্ট বাচ্চাটিকে নিয়ে কিভাবে সংসার চালাবেন’। অল্পদিনের মধ্যে হালিমার নানা তাদের আশ্রয় দিলে মায়ের দুশ্চিন্তা দূর হয়।

কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম! হালিমার বয়স যখন দু’বছর তখন তার মায়ের বিয়ে হয়ে যায় আবার। ছোট্ট হালিমাকে রেখে মা চলে যায় বাগেরহাটে নতুন স্বামীর ঘরে, নতুন জীবনের টানে। আর হতভাগ্য হালিমা মা থাকতেও হয়ে যায় মাতৃহারা।

হালিমা মায়ের আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে নানা বাড়িতে বড় হতে থাকে। পাঁচ বছর বয়সে নানা তাকে পার্শ্ববর্তী পিরোজপুর গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। হালিমা পড়াশুনায় বেশ মনোযোগী। পরীক্ষায় বরাবর ভাল রেজাল্ট করে তাই শিক্ষকগণ তাকে ভালবাসতেন। দেখতে দেখতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হয় হালিমা।

02কিন্তু ভাগ্য এখানেও বাধ সাধে। সে আর বেশি দূর এগুতে পারে না আর হালিমা। যখন সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তখন তার নানা মারা যান। এবার শুরু হয় জীবনের আরো একটি চরম দুর্দশা! নানী দিশেহারা হয়ে পড়েন, ‘কিভাবে সংসার চলবে আর হালিমার পড়ার খরচ যোগাড় হবে’। শেষে পর্যন্ত অভাব-অনটনের কারণে তার পড়া বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম। অন্যের বাড়িতে, ফসলের জমিতে, চিংড়ির ঘেরে কাজ করে এমনকি নদীতে চিংড়ির পোনা ধরে কোনোভাবে তাদের সংসার চলতে থাকে।

ইতোমধ্যে খাজরা গ্রামে কারিতাস আইসিডিপি ঋষি প্রকল্পের সহায়তায় ‘একতা ক্রেডিট ইউনিয়ন’ নামে একটি সমিতি গঠন করা হয়েছে। গ্রামের অন্যান্যদের উৎসাহে ৬ মার্চ, ২০১২ খ্রীষ্টাব্দে হালিমা এর সদস্য পদ গ্রহণ করে। ক্রেডিট ইউনিয়নে নিয়মিত শেয়ার-সঞ্চয় জমা দেওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য তহবিল সৃষ্টি করা যায় এবং নিজেদের তহবিল থেকে কম সুদে (বার্ষিক ১২%) ঋণ নিয়ে আয়ের পথ করা যায়’ ক্রেডিট ইউনিয়নের এ শিক্ষা তাকে উন্নয়ন প্রচেষ্টায় উদ্যোগী করে তোলে।

৬ জুলাই, ২০১৩ সালে সে ক্রেডিট ইউনিয়ন থেকে ৬,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে রাস্তা সংলগ্ন তাদের ঘরের সাথে একটি ছোট্ট চায়ের দোকান করে। সকাল ৮টা থেকে শুরু করে রাত নয়-দশটা পর্যন্ত দোকান চলে। তার দোকানে সাধারণত চা তৈরীর পাশাপাশি পান, বিস্কুট, লজেন্স, কলা ইত্যাদি বিক্রি করা হয়।

প্রথম দিকে বিক্রয় একটু কম হলেও ধীরে ধীরে খরিদ্দার বাড়তে থাকে। খরিদ্দারের সাথে তার আয়ও বাড়ে। আয়ের সাথে সংগতি রেখে হালিমা প্রথমবারের ঋণ দ্রুত পরিশোধ করে ৬ জানুয়ারি, ২০১৬ সালে পুনরায় ২০,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে দোকানের পরিসর কিছুটা বৃদ্ধি করে।

এখন অন্যান্য বিক্রয় সামগ্রীর পাশাপাশি খরিদ্দার আকৃষ্ট করার জন্য তার দোকানে একটি টেলিভিশনও রাখা হয়েছে। দোকানে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে সাত-আটশত টাকা বিক্রয় হয় এবং সেখানে আড়াই-তিনশো টাকা আয় থাকে। দোকানের আয় দিয়ে হালিমা এখন নানীর চিকিৎসা, খালাতো ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া, সংসারের অন্যান্য খরচ মেটানোসহ সমিতির কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে। একটি দুঃস্থ-অসহায় পরিবারকে ক্রমান্বয়ে স্বচ্ছলতার পথে এগিতে নিতে হালিমার প্রচেষ্টাকে গ্রামের লোকজন সম্মান আর ভালবাসার দৃষ্টিতে দেখেন যা তার উন্নয়ন প্রচেষ্টায় প্রেরণা যোগাচ্ছে।

তার সাহসী-সফল উদ্যোগকে প্রশংসা করে ক্রেডিট ইউনিয়নের সভাপতি সানি দাস বলেন, “ইচ্ছা শক্তি, সাহস এবং একাগ্রতা মানুষকে যে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে হালিমা তা প্রমাণ করেছে। ছোট বয়স থেকে সে অনেক কষ্ট করেছে। ক্রেডিট ইউনিয়নের সহায়তা আর তার নিরলস চেষ্টার ফলে আজ তাদেরকে স্বাবলম্বীতার দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। মানুষ চেষ্টা করলে যে সংসারের অভাব-অনটন দূর করে সুখের মুখ দেখতে পারে হালিমা তার বাস্তব দৃষ্টান্ত।”

অন্যদিকে নিজের উন্নয়ন সম্পর্কে হালিমা বলেন, “আমাদের ক্রেডিট ইউনিয়ন আমার মতো দরিদ্রকে ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছে আর ‘ক্রেডিট ইউনিয়ন যে দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের পথ’ তা আমরা জেনেছি। ক্রেডিট ইউনিয়নের শিক্ষাই আমাকে চায়ের দোকান করতে (আয় মুখী কাজ) উৎসাহ ও সাহস দিয়েছে এবং কাজে লেগে থেকে দুঃখ-কষ্ট-দারিদ্রতা দূর করতে সহায়তা করেছে।”
এখন আর হালিমা আকাশের দিকে উদাস হয়ে ভাবে না পিছনের কথা। নিজের নির্মমতার করুন অতীত তাকে আর আচ্ছন্ন করে না।

আরবি/আরপি/২৪ এপ্রিল, ২০১৭