শিরোনাম :
নিজ ভূমিতেই অভিবাসী গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালরা
ইতিহাস বলে সাঁওতালরা এই বঙ্গের ইতিহাসের প্রথম মানব জাতি, বাংলার মানুষের মধ্যে এখনো সাঁওতালদের রক্ত মিশে আছে। জাতিসংঘের ঘোষণা পত্রের দিকে তাকালে আদিবাসীদের কোন নির্দিষ্ট সংঙ্গা না থাকলেও যাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, পোষাক, রাজনৈতিক সংগঠন যেমন সাঁওতালদের ক্ষেত্রে পারগাণা- মাঝি আছে এমন জাতি গোষ্ঠীকে আদিবাসী বলা যায়।
বাংলাদেশে ইতিহাসকে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই স্বাধীনতার পরে সবচেয়ে নির্যাতিত ও বঞ্চিত জাতি গোষ্ঠী হলো আদিবাসীরা এবং এর পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। আদিবাসী শব্দটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আমি আদিবাসীই বলবো। যাই হউক, আদিবাসীদের সাংবিধানীক স্বীকৃতির জন্য তারা অনেক আগে থেকেই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে সংগত কারণেই। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে নারাজ। এর কারণ হিসেবে আদিবাসী ফোরাম এর সেক্রেটারী সঞ্জিব দ্রং এর মতে, “রাষ্ট্র মনে করে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিলে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী তাদের ভুমির অধিকার দিতে হবে, তাদের সকল দ্বায়দায়িত্ব সরকারকে বহন করতে হবে, এমনও হতে পারে তারা স্বাধীন ভুখন্ড দাবি করতে পারে।” কিন্তু আমার কথা হলো মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে যেখানে আদিবাসীদের কথা বাদই দিলাম সমস্ত সংখ্যালঘুদের সংখ্যাই যেখানে মাত্র মোট জনসংখ্যায় মাত্র ১১-৯% সেখানে আদিবাসীরা কিভাবে এবং কোন বলে একটি স্বাধীন ভূখন্ড দাবি করতে পারে? তবে সেক্রেটারি দ্রং বলেন, “আমরা বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে যুক্ত হতে চাই, আমরা সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই।”
দিনাজপুরের চিরাকুটা গ্রামের সেই সাঁওতাল আদিবাসী পল্লীর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা আমরা জানি, আলব্রেড সরেন হত্যাকান্ড, সহকারী ভুমি কমিশনার অভিদিও মারান্ডী হত্যাকান্ডের কথা আমাদের অজানা নয়। সর্বশেষ গত ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ বাগদা ইক্ষু খামারে সাঁওতাল আদিবসীদের উপর ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনার কথাও আমরা জানি।
কাঁটাতারের বেড়ার কথা শুনলেই আমাদের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে ভারত বাংলাদেশে সীমান্তের কাঁটা তার সেই সাথে কাঁটা তারে ঝুলে থাকা ফেলানীর নিথর দেহ। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, আজ গোবিন্দগঞ্জের সেই সাঁওতাল আদিবাসীদেরকে কাঁটা তারের বেড়াতেই আবদ্ধ করা হয়েছে যেন তারা ফার্মের ভেতর প্রবেশ করতে না পারে। পুরে খামারে কাঁটা তার দেয়া হয় নি শুধু আদিবাসীরা যে এলাকায় বাস করে সেই সীমানায়ই কাঁটা তার দেয়া হয়েছে। আধুনিক যুগে এসে আমরা সেই আগের যুগে চলে গিয়েছি যেখানে বেড়া দেয়া হত বণ্যপ্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পেতে। “ কাঁটা তারের বেড়া দেয়া হয়েছে সাঁওতাল আদিবাসীদের হাত থেকে ইক্ষু খামারকে রক্ষা করতে”বলেন রংপুর সুগার মিল লি: এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আওয়াল। “মাদার পুর ও জয়পুরে ৩১টি পরিবার ভুমিহীন রয়েছে,আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার তাদের পুনর্বাসন করবে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে, তাদের মধ্যে চাল, টাকা এবং কম্বল সরকার বিতরণ করেছে।” বলেন গাইবান্ধার জেলা প্রসাশক। কিন্তু এখন কথা হলো এই সাঁওতাল আদিবাসীদেরকে ভুমিহীন কারা করিয়েছে? জমি অধিগ্রহণ করে তাদের ভুমিহীন তো তৎকালীন সরকারই করেছে। ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের সাথে সুগার মিল কর্তৃপক্ষের যে চুক্তি হয়েছিল সেখানে বলা আছে, আখ চাষের জন্য এই জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। যদি ভবিষ্যতে কখনও আখ চাষ না হয় অথবা আখ ব্যতীত অন্য কিছু হয়, তবে এই জমি উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে অর্থাৎ জমি পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। এই চুক্তি ৫ ধারার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছিঃ
Point 5.
The Provincial Government will examine the question of the acquisition of the land for the aforesaid purpose and proceed with the acquisition thereof if there is no objection but as a result of the examination if it is decided that the land shall not be acquired for the aforesaid purpose, the said corporation shall surrender the land to the Provincial Government for its release and restoration under section 8 of the aforesaid Act and the corporation shall bear all costs and compensation in connection with the release and restoration of the land.
এই চুক্তির ধারা ৩ এ বলা আছে, চুক্তির সময় এই সব জমির যে অবস্থা বা জমির যে বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র, তার কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। অর্থাৎ জমির আইল পর্যন্ত পরিবর্তন করা যাবে না। অথচ সুগার মিল কর্তৃপক্ষ এই জমি নানা কাজে লীজ দিয়েছে। দরপত্রের এই বিজ্ঞাপন রংপুর সুগার মিলস্ লিমিটেড দৈনিক করতোয়ার ছাপিয়েছে ১লা এপ্রিল ২০১৫। এই দরপত্রে ১১ টি পুকুর ও ১২টি প্লটের জন্য দরপত্র চাওয়া হয়েছে। এটি পুরোপুরি চুক্তির লংঘন। জেলা প্রশাসক নিজেই বলছেন জমি “অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত” রয়ে গেছে এবং সেখানে ইকোনোকিক্স জোন বানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাবও পাঠিয়েছিল। কাজেই চুক্তি অনুযায়ী জমির দাবিদার এখন সাঁওতাল আদিবাসীরাই। দাবিদার বললে ভুল হবে জমির মালিক এখ তারাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারাকাত গোবিন্দগঞ্জের সেই ঘটনাস্থল ঘুরে এসে দৈনিকপ্রথামআলোর সাথে বলেছে, জমি যে সাঁওতালদের, কোন সন্দেহ নেই।” জমি অধিগ্রহণের সময় এই আদিবাসীদের কোন ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছিল এমন তথ্য তিনি কোন কাগজ পত্রে পান নি।
তাহলে এই তিনজন আদিবাসী মারা যাওয়া পরে এখন সেখানকার সাঁওতাল আদিবাসীরা কি করবে? আদিবাসীদের একটাই দাবি, তারা তাদের বাপ-দাদার জমি ফেরত চান। তাদের দাবি, স্থানীয় এমপি এবং ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এর আশ্বাসেই তারা এই জায়গায় নিজেদের দাবি নিয়ে এসেছিল এবং নেতাদের তারা অর্থদিয়ে-ভোট দিয়ে নির্বাচনে ক্ষমতায় এনেছে। কারো কারো দাবি, সরকার যদি তাদের জমি না দেয় তাহলে সরকারের কাছ থেকে লিখিত চান যে তারা এই দেশের নাগরিক না। তাহলে তারা ভারতে চলে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা বলেন, লড়াই করবো, প্রয়োজনে আরো মরবো তার পরেও বাবা-দাদার জমি ছেড়ে যাবো না।
কোন কোন আদিবাসী নেতা রাষ্ট্রের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে, রাষ্ট্রকে আরো আন্তরিক হতে হবে। তারা বলে, রাষ্ট্র বা সরকার চাইলে পারে না এমন কোন কাজ নেই।
আবার আদিবাসীরা নেতারা আশার আলো দেখছে, দেশের প্রগতিশীল যে গোষ্ঠী আছে, বিভিন্ন বাম নেতারা, বুদ্ধিজীবি, মিডিয়া আদিবাসীদের পক্ষে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে বলে। তারা আশাবাদি সরকারের মনে একসময় আদিবাসীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসবে।
একজন আদিবাসী নেতা ধর্মের যারা গুরু দায়িত্বে আছে তাদেরও দোষারোপ করেছে। আদিবাসীরা বিভিন্ন ধর্মের দীক্ষা নেয়। কিন্তু তাদের এই পরিস্থিতিতে সেই ধর্মীয় নেতারা তাদের পাশে নাই। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, শুধু কাপড় আর খাবার দিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় নাকি? কেন আমরা তোমার ধর্ম পালন করবো, আমাদের দুঃখের সময় যদি তোমাদের না পাই?
এখন গোবিন্দগঞ্জের এই সাঁওতাল আদিবাসীরা নিজ দেশে অভিবাস। তাদের দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন সংগঠন দেখতে যাচ্ছে, পশেই কাঁটা তারের বেড়া অনেকটা চিড়িয়াখানার জন্তু দেখার মতই। হাতে করে অনেক সংগঠন খাবার, কাপড় নিয়ে যাচ্ছে। আজকে আমাদের রাষ্ট্র যদি আদিবাসীদেকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না করতো তাহলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। নিজ দেশে নিজেদের ভুমিতেই তারা আজ অভিবাসী হয়ে থাকতো না। তারা আজ কলা পাতার ঘর বানিয়ে, স্কুলের মাঠে বসবাস করতো না। চিড়িয়াখানার জস্তুদের মত মানুষ তাদের আজ দেখতে যেত না। তারা নিজেরা আজ দেশের ১৬ কোটি মানুষের মত বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াত। শেষে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আবুল কাশেম ফজলুল হক এর কথাই বলতে চাই, “আমি কোন বিচার চাই না, আমি চাই শুভ বুদ্ধির উদয় হউক”।
স্টেফান উত্তম, UCANEWS
আরবি/আরপি/আরএসআর
২৪ নভেম্বর, ২০১৬