শিরোনাম :
পথশিশুদের সাথে ঈদের আনন্দ কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও’র
|| সুমন কোড়াইয়া ||
১৬ আগস্ট। দিনটি ছিল শুক্রবার। ছুটির দিন থাকায় ঘুম থেকে উঠতে দেরি। মাথায় একটা বিষয় ঘুরছে ‘পথশিশুদের ঈদ উৎসব’। বাসায় নাস্তা সেরে বেড়িয়ে পড়লাম ঢাকার নটর ডেম কলেজের উদ্দেশে। সেখানেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে পথশিশুদের ঈদ উৎস।
কলেজের ভেতরে মার্টিন হলের সামনে গিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল। সেখানে দেখা গেল পথশিশুদের চুল কাটছেন পিমে মিশনারী ব্রাদার লুসিও বেনিনাতি পরিচালিত পথশিশু সেবা সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা। তাদের সাথে আছেন হলিক্রশ সেমিনারীয়ানরা। ব্রাদার লুসিও সব কাজের তদারকি করছেন।
জানা গেল, সারা ঢাকা শহর থেকে যারা প্রকৃত পথশিশু, বাবা-মা নাই, বাবা-মা থেকেও নাই, অন্য সবার মতো ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি যেতে পারেনি এমন অন্তত ৫০ জন শিশুকে নিয়ে ঈদ উৎসব পালন করছে পথশিশু সেবা সংগঠন। দিনের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে শিশুদের ফুটবল ও ভলিবল খেলা, ডাক্তারের নিকট স্বাস্থ্য পরীক্ষা, চুল কাটা, গোসল করা, চলচ্চিত্র দেখা, শিশুদের মধ্যে নতুন কাপড় বিতরণ, ঈদের আনন্দ ভোজ, যাদু প্রদর্শন ও শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
কাওরান বাজার, কমলাপুর রেলস্টেশন, বাবুবাজার, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে র্পূবপরিকল্পনা অনুসারে পথশিশুদের সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। বলা বাহুল্য, পথ শিশু সেবা সংগঠনের রয়েছে বেশ কিছু সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবক যারা পালাক্রমে বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে শিশুদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। ব্রাদার লুসিও শিশুদের স্বাস্থ্য পারীক্ষা করেন। শিশুদের নৈতিক শিক্ষা দেন যেন তারা সৎপথে জীবন-যাপন করেন। এই শিশুদেরই ব্রাদার লুসিও পরিবারে ফিরিয়ে দেন বা কোনো শিশু হোমে পাঠিয়ে দেন বিভিন্ন নেটওয়াকিং করে। ব্রাদার লুসিও’র মতে, যে সমাজে পরিবারে যত বেশি ক্ষত, সে সমাজে পথশিশুদের সংখ্যা তত বেশি। পরিবারে দম্পতিদের মধ্যে সমস্যা কমলে, নদী ভাঙন রোধ হলে কমে আসবে পথশিশুদের সংখ্যা।
যেসব শিশু সকালে এসেছিল অপরিষ্কার কাপড় পরে, গায়ে ছিল দুর্গন্ধ, দুপুরে গোসল করার পর তাদের দেখে কেউ বুঝতেই পারবেন না তারা পথশিশু। সাবান, সেম্পু দিয়ে গোসল করানো হয়েছে শিশুরদের। মেয়ে শিশুরদের যত্ন নেওয়ার জন্য আছেন নারী স্বেচ্ছাসেবক।
১১ বছর ধরে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দিয়ে ইটালিয়ান ব্রাদার লুসিও ইতিমধ্যে পরিচিত একজন নাম। তাঁর নিমন্ত্রণে পথশিশুদের উৎসবে যোগ দিয়েছেন ইটালির বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত হিয়াসিপি সেমেনজা, ঢাকার আর্চবিশপ কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠিাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
তারা সকলে দুপুরের খাবারের আগে এক সাথে চার্লি চ্যাপ্লিনের একটি ছবি দেখলেন। চার্লির দুষ্টুমি দেখে রীতিমতো শিশুরা আনন্দে গড়িয়ে পড়েছে। একটু পর পরই শোনা গেছে হাসি, আনন্দের রোল।
গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে উৎসাহিত হয়েছে পথ শিশুরা। এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তারা কার্ডিনাল প্যাট্রিকের দিকে, ইটালির রাষ্ট্রদূত হিয়াসিপি সেমেনজা দিকে। তাঁরাও জড়িয়ে ধরেছেন পথশিশুদের। আপন করে নিয়েছেন সবাইকে।
চলচ্চিত্র দেখার পর খাবার খাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো। শৃঙ্খলা অনুসারে হাত ধুলো শিশুরা। তারপর খাবার ঘরে গিয়ে পথশিশুদের সাথে ঈদের বিশেষ খাবার সেমাই, গরুর মাংস, মুরগীর মাংস, পোলাও খেলো শিশুরা পরম আনন্দে। তাদের সাথে বসে প্লাষ্টিকের সাধারণ প্লেটে খাবার খেলেন আমন্ত্রিত অতিথি কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, ইটালির রাষ্ট্রদূতসহ অন্যান্যরা।
কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিওকে দেখা গেছে, পথ শিশুদের প্লেটে খাবার পরিবেশন করতে। আন্তরিক মুহূর্তে কার্ডিনাল মহোদয়ের প্লেটেও খাবার তুলে দিয়েছে শিশুরা। এ যেন ভালবাসা অনবদ্য আদান-প্রদান।
সবার প্লেটে খাবার দেওয়া হলে, ব্রাদার লুসিও বললেন, হ্যালো!
শিশুরা সমস্বরে উচ্চারণ করলো, হাই!
আবার ব্রাদার লুসিও বললেন, হ্যালো!
শিশুদের প্রতি উত্তর, হাই!
ব্রাদার ঘোষণা দিলেন, আমরা এখন সবাই খাবার খাবো। এর আগে আমাদের আজকের একজন বিশেষ অতিথি কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট ধন্যবাদ দিবেন।
কার্ডিনাল মহোদয় প্রার্থনা করলেন। সকলেই মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত প্রসারিত করলেন। প্রার্থনা শেষে সবাই মন ভরে উপভোগ করলেন খাবার।
আমি সুযোগ বুঝে কথা বললাম কার্ডিনাল মহোদয়ের সাথে। তিনি বললেন, ‘ব্রাদার লুসিও পথ শিশুদের সেবা করার জন্য ঈশ^রের বিশেষ আহ্বান পেয়েছেন। তিনি এই কাজে আরো অনেককে সম্পৃক্ত করেছে। এটা সেবার একটা আহ্বান।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি একটি চিকিৎসক পরিবারের সাথে আজ কথা বললাম, যারা স্বামী-স্ত্রী চিকিৎসক, তারা তাদের মেয়েসহ আজ পথশিশুদের সেবা করতে এসেছেন। যিশু বলেছেন, মানুষকে ভালবাসতে না পারলে আমাকে ভালবাসতে পার না। পথশিশুদের সেবা দিয়ে ব্রাদার সম্মিলিতভাবে ঈশ্বরেরই সেবা করছেন।’
কার্ডিনাল প্যাট্রিক পথশিশুদের সাথে খাওয়ার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি সাধারণত, খাবার টেবিলে অন্যদের খাবার দিয়ে দেই। আজও দিয়েছি এবং নিজের পাতেও নিয়েছি। তখন একজন পথশিশু বার বার বলেছে, ‘একটা পিস মাংস নেন না।’ আমি নিতে না চাইলে শিশুটি বললো, তাহলে মনে করবো আপনি আমাকে ভালবাসেন না! তখন আমি তার দেওয়া মাংস নিই। আমি দেখলাম ওদের মধ্যে তৈরি হয়েছে মানবতা বোধ। হয়ত কিছুটা গঠন পেয়েছে ব্রাদার লুসিও’র নিকট হতে।’
ইটালির রাষ্ট্রদূত হিয়াসিপি সেমেনজা বলেন, ‘আমি গর্বিত ব্রাদার লুসির জন্য। তিনি আমাদের দেশ থেকে এদেশে এসে খুবই ভাল মিশনারী কাজ করছেন। তার কাজ সবাই পছন্দ করেন।’
পথশিশুদের চিকিৎসা দিতে আসা চারজন চিকিৎসকের সাথে আলাপ হয়। তারা বলেন, ব্রাদার ডাকলেই তারা সাড়া দেন।
কী ধরনের অসুখ বেশি হয় জানতে চাইলে একজন ডাক্তার বলেন, ওদের বেশির ভাগই খোস-পাচড়ায় ভোগে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে। এ ছাড়াও প্রায় সময়ই ওরা পায়ে বা দেহের অন্যান্য স্থানে ছোট বড় ইনজুরি নিয়ে আসে ।
ঈদের নতুন কাপড় পেয়ে খুব খুশি হামিদ (১০)। তার পরনে ছিল একটি টি-শার্ট আর একটি হাফ প্যান্ট। আজ নতুন একটি টি-শার্ট এবং একটি ফুল প্যান্ট পেয়েছে ব্রাদার লুসিওর সংগঠন থেকে। সে বলে, ‘আমি কমলাপুর রেল ইস্টিশনে থাহি। আমার বাবা-মা নাই। এই নতুন কাপড় নিয়া আমি আমার সাথে সাথেই রাহুম। লুসিও ভাই অনেক বালা।” প্রসঙ্গত, ব্রাদার লুসিওকে পথশিশুরা লুসিও ভাই বলে ডাকে।
২০০৭ সাল থেকে ব্রাদার লুসিও এখন পথ শিশুদের জন্য কাজ করছেন ঢাকার পাশাপাশি সিলেট ও চট্টগ্রামেও।
শুভ কামনা রইলো ব্রাদার লুসিও ও তার টিমের জন্য।