ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৮ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ফিচার ফাদার ইয়াং : সমবায়ের অগ্রদূত

ফাদার ইয়াং : সমবায়ের অগ্রদূত

0
960

স্বপন রোজারিও || ঢাকা

১। ভূমিকা
ফাদার চার্লস ইয়াং, সিএসসি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে তারিখে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক রাজ্যের অবার্ণ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ডানিয়েল ইয়াং এবং মায়ের নাম মেরী জেনিংস। দুইজনই ছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভূত। চার্লস ছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। ছোট বেলায় তাঁর মা মারা যান বলে তাঁকে এতিমখানায় এবং পরে একটি পরিবারে থেকে পড়াশুনা করেন ও বড় হন। পবিত্র ক্রুশ সংঘের সেমিনারীতে প্রবেশ করেন ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯২৪ খিস্টাব্দের ২১ জুন তারিখে তিনি নভিশিয়েটে প্রবেশ করেন ও পরবর্তী বছর, অর্থাৎ ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই তারিখে তিনি পবিত্র ক্রুশ সংঘের সদস্য হিসেবে প্রথম ব্রত এবং তিন বছর পর ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই তিনি চিরব্রত গ্রহণ করেন। এসময় তিনি পড়াশুনা চালিয়ে যান ও ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি, এ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ওয়াশিংটনে অবস্থিত ফরেইন মিশন সেমিনারীতে ঐশতত্ত্ব অধ্যয়ন করার পর ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুন তারিখে ইন্ডিয়ানার নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যাপেলে যাজকপদে অভিষিক্ত হন এবং একই বছরেরই অক্টোবর মাসে মিশনারী কাজের জন্য তৎকালীন পূর্ববঙ্গে আগমন করেন।

সমবায়ের অগ্রপথিক ফাদার চার্লস জে. ইয়াং ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু!

২। ফাদার চার্লস ইয়াং-এর পুরো নাম

ফাদার ইয়াং-এর নাম আমরা চার্লস জে, ইয়াং বলে জানি। “জে” কথাটি দ্বারা তাঁর কী নাম ছিল তা জানা ছিল না। কিন্তু ফাদার ইয়াং-এর ফাইল ঘেটে ফাদারেরই নিজের হাতে লেখা কাগজ থেকে জানা যায় তাঁর ঐ মাঝের নামটি হচ্ছে ‘যোসেফ’। কাজেই তাঁর পুরো নামটি হচ্ছে ফাদার চার্লস যোসেফ ইয়াং, সিএসসি।

৩। ফাদার ইয়াং-এর কর্মস্থলসমূহ

এদেশে এসে ফাদার চার্লস যোসেফ ইয়াং প্রথমে বাংলা শিখেন। এজন্য তাঁর প্রথম কর্মস্থল হয় হাসনাবাদ ধর্মপল্লী। এখানে এক বছর অবস্থান করার পর ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ফাদার চার্লস-এর নতুন কর্মস্থল হয় রাণীখং মিশন। পরবর্তী ১২ বছরের অধিক সময় তিনি ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন ধর্মপল্লীতে কাজ করেন। এর পর তিনি বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ সহ আমাদের দেশে নানা রকম সমাজকর্মে ব্যাপৃত ছিলেন। তিনি একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন বলে আমাদের অনেকের হয়ত জানতে ইচ্ছা করতে পারে কোথায় কোথায় তিনি কাজ করেছেন। তাই সংক্ষিপ্তভাবে ফাদার ইয়াং-এর কর্মস্থলের নামগুলো নিুে উল্লেখ করছি।

১৯৩৩ …. …. তৎকালীন পূর্ববঙ্গে আগমন
১৯৩৩ – ৩৪ …. …. হাসনাবাদ (বাংলা শেখা ও ধর্মপল্লীর কাজ)
১৯৩৪ – ৩৯ …. …. রাণীখং
১৯৩৯ – ৪৩ …. …. মরিয়মনগর
১৯৪৩ – ৪৬ …. …. বিড়ইডাকুনী
১৯৪৭ – ৪৯ …. …. আগরতলা
১৯৪৯ – ৫৩ …. …. মরিয়মনগর
১৯৫৪ – ৫৫ …. …. রমনা
১৯৫৫ – ৫৬ …. …. বিড়ইডাকুনী
১৯৫৬ – ৫৭ …. …. রমনা
১৯৫৭ – ৫৮ …. …. তেজগাঁও
১৯৫৮ – ৭৩ …. …. ৬১/১ সুবাস বোস এভেন্যু (সমাজ কর্ম, কারিতাস)
১৯৭৩ – ১৯৮৮-র ১৪ নভেম্বর মরো হাউস — জিন্দাবাহার

ফাদার ইয়াং কারিতাস-এর কর্মী হিসেবে এডুকেশন অফিস, এনএফপি, ক্রেডিট ইউনিয়ন ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন কারিতাস প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত। এরপর তিনি অবসর গ্রহণ করেন। কারিতাস সেন্ট্রাল অফিস থেকে ফাদারকে বিদায় জানানো হয়েছিল ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে। কারিতাস ফাদার ইয়াং-কে বিদায় জানালেও মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি এসব কর্মকান্ডের সাথে সরাসরি ও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।

৪। সমবায় ভাবনা
রেভা. ফাদার চার্লস জোসেফ ইয়াং সি.এস.সি. সমবায়ের ক্ষেত্রে একটি একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, সমবায় আন্দোলনের একজন পথিকৃৎ। ৫০-এর দশকে সারা দেশের তথা খ্রীষ্টানদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তখন তারা চড়া সুদে কাবুলিওয়ালাদের অথবা সুদখোর মহাজনদের নিকট থেকে টাকা এনে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে চাইলেও পক্ষন্তরে তাদের চড়া সুদের টাকা গুনতে গুনতে শেষ সম্বল ভিটে-মাটি পর্যন্ত হারাতে হয়েছে। খ্রীষ্টনদের এই অবস্থা ফাদার ইয়াংকে অসম্ভব পীড়া দিয়েছে। শুধু তাঁকে নয়, তৎকালীন খ্রীষ্টান ধর্মগুরু আর্চ বিশপ লরেন্স এল. গ্রেনার সি.এস.সি.-কে ও মর্মাহত করেছে। তিনি ভাবতে থাকেন কিভাবে এ দরিদ্র খ্রীষ্টান জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো যায়। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে ফাদার ইয়াংকে সমবায়ের উপর প্রশিক্ষণের জন্য কানাডার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার ইউনিভার্সিটির কোডি ইন্সটিটিউটে পাঠান। সেখানে তিনি একাডেমিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিভিন্ন সমিতি পরিদর্শন ও নের্তৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সমবায়ের উপর সম্যক ধারণা লাভ করেন। সেখান থেকে তিনি আবার ঢাকায় এসে সমবায় গঠন করার চিন্তা-ভাবনা করেন। এরপর তিনি ৩ জুলাই, ১৯৫৫ খ্রীষ্টাব্দে লক্ষ্মীবাজারে একটি সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। সেটাই এখন “দি খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিঃ,ঢাকা” যা ঢাকা ক্রেডিট নামে সমধিক পরিচিত। আজ থেকে ৫০ বৎসরের ও বেশী সময় পূর্বে যে সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা এখন বিরাট আকার ধারণ করেছে। ইহা এশিয়ার মধ্যে বৃহৎ সমিতি হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছে। শুধু ঢাকা ক্রেডিট নয় ধর্মপল্লী পর্যায়ে যত ক্রেডিট আছে সেগুলি প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিরাট অবদান রয়েছে।
৫। কিছু কথাঃ
একজন বিদেশী ধর্মযাজক হয়েও তিনি আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি আমাদের মাঝে স্বশরীরে নেই। কিন্তু তার অবদান আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। তিনি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছেন। আমরা তাঁকে কিছুই দিতে পারিনি। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালনের কথা অনেক সময় আমরা ভূলে যাই। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে আমরা অনেক কিছূ করতে পারি। প্রার্থনার মাধ্যমে তাঁর কাছে কিছু চাওয়া হলে তা তিনি প্রদান করেন। তাঁেক ঈশ্বরের সেবক হিসেবে ঘোষণা দেবার প্রত্রিয়া হাতে নেয়া যেতে পারে। অনেক খ্রীষ্টান সমবায় সমিতিতে তার ছবি পর্যন্ত নেই, যা রীতিমত দুঃখজনক। সব সমবায় সমিতিতে তাঁর একটা ছবি থাকা আবশ্যক। ফাদার ইয়াং ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আদর্শ সমবায়ীদের ‘ইয়াং’ খেতাব দেয়া যেতে পারে। কেন্দ্রীয়ভাবে ফাদার ইয়াং লাইব্রেরী করা যেতে পারে। সেখানে ফাদার ইয়াং সম্পর্কে এবং সমবায় সম্পর্কে পুস্তক থাকবে যা অধ্যয়ন করে সমবায় জ্ঞান ভান্ডার পূর্ণ করা যাবে। আমরা ফাদার ইয়াং-এর নামে স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারি। তাঁর নামে বৃত্তি প্রদান করতে পারি। ফাদার ইয়াং-এর কোন প্রচার নাই। আজকে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ডঃ ইউনূস নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেছেন, এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। অর্ধশত বছরে সমবায় যে সাফল্য আনতে পারেনি, গ্রামীণ ব্যাংক মাত্র ৩০ বছরে সে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদ বিহীন ভিক্ষুক ঋণ, নিত্য নতুন চিন্তাধারা, পরিকল্পনা , গবেষণা, জমানতবিহীন ঋণ, নারীর শক্তি, সৃজনশীলতা ও ক্ষমতায়ণ এবং সর্বোপরি সদস্য-সদস্যাদের মধ্যে সহমর্মিতা এবং তাদের প্রতিভা বিকাশে বিরাট অবদান রাখার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক আজ সাফল্যের শীর্ষে অবস্থান করছে।
আমরা আশা করি, আমাদের ফাদার ইয়াং-এর সমবায় দুঃখ ভারাক্রান্ত সদস্য-সদস্যাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে কোন এক দিন নোবেল পুরস্কার পাবে। তার জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে যা দরকার তা আমাদের অবশ্যই করতে হবে।
৬। মৃত্যুঃ
১৯৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ নভেম্বর সড়ক দূর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে তেজগাঁও কবরস্থানে অন্তিম শয়ানে শায়িত করা হয়।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ফাদার আদম এস, পেরেরা, সিএসসি

গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ ফাদার চার্লস জে ইয়াংকে