শিরোনাম :
বর্তমান বাস্তবতায় একটি খ্রিষ্টান হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা
|| সুনীল পেরেরা ||
পবিত্র বাইবেল গ্রন্থে লেখা রয়েছে, “মানবপুত্র সেবা পেতে আসেনি, সেবা দিতে এসেছেন।” অন্যত্র যীশু বলেছেন, “যারা সুস্থ তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন নেই, যারা পীড়িত তাদেরই প্রয়োজন। আমি ধার্মিকদের ডাকতে আসিনি, এসেছি পাপীকে আহ্বান করতে। আরও বলা হয়েছে, “ঈশ্বরকে ভালবাসো, মানুষকে সেবা কর। ভালোবাসার অর্থই হচ্ছে সেবা, আত্মোৎস্বর্গ। মানব সেবাইতো ঈশ্বর সেবা।”
যিশু খ্রিষ্ট এই জগতে এসেছিলেন মঙ্গলবার্তার দূত এবং মানবজাতির সামগ্রিক মুক্তির প্রবক্তা হিসেবে। তাঁর আগমনের উদ্দেশ্যই ছিল বিশ্বজনীন কল্যাণ সাধন। সেবার প্রতিক হিসেবে মৃত্যুর শেষ রাতে যীশু তাঁর শিষ্যদের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমি যা করেছি তোমরাও পরস্পরের প্রতি তাই করবে।
সাধু পাস্কাল বলেছেন, “ঈশ্বরের প্রতি তোমার হৃদয়টা হতে হবে শিশুর হৃদয়ের মত, প্রতিবেশীর প্রতি তোমার হৃদয়টা হতে হবে মায়ের হৃদয়ের মতো, আর তোমার নিজের প্রতি তোমার হৃদয়টা হতে হবে বিচারকের হৃদয়ের মতো।”
বর্তমান যুগে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় দান বা সেবার প্রকৃষ্ঠ পন্থা হল ত্রাণ বা সমাজকল্যাণ মূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাহায্য করা। শুধু নিজের জন্য নয় অপরের জন্যও আমাদের সেবার হাত প্রসারিত করতে হবে। আশেপাশে মানুষের কথা ভাবতে হবে। কত ভাবেইতো সেবা করা যায়। নিঃসঙ্গ লোকের কাছে গিয়ে সঙ্গ দান, ব্যস্ত প্রতিবেশীর কাজে সহায়তা করা,পারিশ্রমিক না নিয়ে অন্যের কাজ করে দেয়। সর্বপরি অসুস্থ অবস্থায় অন্যের সেবা করা, মৃত্যু পথযাত্রীকে জীবনে ফিরিয়ে আনা। দয়ালু সমরীয় তার নিজের সময়, সহায়তা, সেবা ও অর্থ দিয়ে আহত মানুষটিকে সুস্থ করে তুলেছিলেন।
আমাদের আশেপাশে যারা দারিদ্রে, ব্যাধিতে, জড়তায়, অবজ্ঞায় অর্ধমৃত হয়ে আছে তাদের সেবার জন্যও আমরা আহুত। সদানুভূতিই যেন হয় আমাদের সেবা দানের মূলসুর। যিশু নিজেই সেবাকে পরম সৌন্দর্য ও পরম শর্ত বলে জেনে নিয়েছিলেন। খ্রিষ্টবার্তা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে, ঘৃণা নয়, প্রেমই আমাদের জীবন ও কর্মে পরিত্রাণ আর এই প্রেমের পরিধি থেকে কাউকে বাদ দেয় যায় না। কোন মানুষই অবহেলা বা ঘৃণার পাত্র নহে।
এদেশে খ্রিষ্টমন্ডলীর বয়স প্রায় পাঁচশত বছর। এরই মধ্যে মন্ডলী নির্ভর হয়েছে।
সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতার বিবর্তন ঘটেছে মিডিয়া দ্রুত উন্নয়নের ফলে। বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। ঘরে বসে বোতাম টিপলেই সব কিছুই হাতের নাগালে চলে আসে। কিন্তু গোড়ার দিকে তেমনটা ছিল না। কুসংস্কারাচ্ছন্ন-অজ্ঞ-অশিক্ষিত জনগণের ছিল না কোন স্বাস্থ্যবিধি সম্বন্ধে জ্ঞান। ছিল না কোন উপায়। স্বাস্থ্য সেবা বলতে স্বঘোষিত কবিরাজ। ঝাড়ফুক-জলপড়া আর মন্ত্রতন্ত্রই ছিল চিকিৎসার মাধ্যম। বিদেশী মিশনারিদের চেষ্টায় প্রথমেই গড়ে তোলা হয় কিছু স্বাস্থ্য কর্মী। কিছু সংখ্যক সিস্টারদের নার্সিং ট্রেনিং দিয়ে মিশন ভিত্তিক ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়। সঙ্গে থাকেন কিছু হোমিও চিকিৎসক। তাদের মাধ্যমেই মান্ডলীক সেবা কাজের সূত্রপাত। এভাবেই তারা এদেশে খ্রিষ্টকে প্রকাশ করেছেন, প্রচার করেছেন তাঁর সেবার আদর্শকে। এর পাশাপাশি শিক্ষকতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
সময়ের আবর্তে বিদেশী মিশনারিগণ এদেশে কয়েকটি স্থানে হাসপাতাল নির্মাণ করেন। ঢাকার মগবাজারে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘হলি ফ্যামেলী হাসপাতাল’। বিদেশী মিশনারি সিস্টারদের দ্বারা পরিচালিত এই হাসপাতালের সেবার মধ্যদিয়ে ঢাকা শহরে খ্রিষ্টীয় সেবার ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সাথে সাথে এখান থেকে গড়ে তোলা হয় অনেক অনেক নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘কারিতাস’ এর মাধ্যমে সেবা কাজের ধারা সারা বাংলাদেশে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে হলি ফ্যামেলী হাসপাতালটি আমরা ধরে রাখতে পারিনি, আমাদের ব্যর্থতার কারণে। অবশ্য সে সামর্থ্যও আমাদের ছিল না তখন।
সেই ব্যর্থতার গ্লানি ঘুচাতেই সমাজ আবার উপলব্ধি করেছে, এমনি একটি সেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের। আমাদের রয়েছে প্রচুর লোকবল, রয়েছে বহু ডাক্তার, অসংখ্য সেবাকর্মী। এমনি একটি প্রতিষ্ঠান থাকলে এখানে পড়াশোনা করেই গড়ে উঠবে ডাক্তার, নার্সসহ অনান্য সেবাকর্মী। তারা এখানেই চাকরির সুযোগ পাবে। জনগণের প্রতি সেবার পরিধি বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রত্যন্ত গ্রাম থেমে একটা রোগী নিয়ে আসতে যানজটের কারণে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অর্থের হয় অপচয়। সেবার চেয়ে অর্থের পাল্লাই বেশি। গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষে এ বোঝা বহন করা সম্ভব হয় না। জীবন বাঁচানোর তাগিদে ধার-দেনা করে চিকিৎসা করতে কত কষ্টই না হয়। এখন ঢাকা ক্রেডিট এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস শুরু করেছে। এর সাথে অন্যান্য সমিতিগুলোও চালু করেছে এই স্বাস্থ্যসেবা। ঢাকা ক্রেডিট তার ৪৩ হাজার সদস্যসহ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে পরিকল্পনা করেছে একটা খ্রিষ্টান হাসপাতাল প্রতীক্ষার। খুব সহজে এর বাস্তবায়ন করা যায় নি। বহু বাধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে, বহু মানুষের দ্বীমত থাকা স্বত্বেও তারা সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছে। সঙ্গে পরামর্শ ও নৈতিক সাহস যুগিয়েছেন মন্ডলীর প্রধানগণ। বিশেষভাবে মহামান্য কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি. রোজারিও সিএসসি সর্বদাই তাঁর সুচিন্তিত পরামর্শ দিয়েছেন, পাশে থেকেছেন। বহুমানুষের চিন্তার ফসল, পরিশ্রমের ফসল ঢাকার অদূরে মঠবাড়ী ধর্মপল্লীর পাশে নির্মিত হচ্ছে স্বপ্নের ‘ডিভাইন মার্সি জেনারেল হাসপাতাল’।
আমরা খ্রিষ্টভক্তগণ প্রত্যেকেই মঙ্গলবাণী প্রচারে আহুত। এবার শুরু হচ্ছে ‘গণমঙ্গল কর্মসূচী গণ মানুষের কল্যাণে’। আমরা এবার সম্মিলিতভাবে খ্রিষ্টীয় সেবা কাজের সুযোগ পাবো। খ্রিষ্ট তো তাই বলেছিলেন, “তোমরা পরস্পরের প্রতি তাই করো, আমি যেমনটি তোমাদের করেছি।” সত্যিকার অর্থে এই প্রতিষ্ঠানটি হতে পারে খ্রিষ্টীয় সেবার প্রাণ কেন্দ্র। তুমিলিয়া ধর্মপল্লীতে রয়েছে একটি ছোট হাসপাতাল। তবে সেই গোড়ার দিকে এখানে ছিল একটি ক্লিনিক এবং ডেলিভারী কেন্দ্র। একবার একজন অখ্রিষ্টীয়ান মহিলাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনি কতবার এখানে এসেছেন?” উত্তরে তিনি বলেন, “অনেকবার আইছি, আমার আত্মীয় স্বজনদেরও আনছি। আমার বাড়ি এখান থেকে আট মাইল উত্তরে।” তখনকার দিনে পায়ে হেঁটে আসতেন, জিজ্ঞেস করেছিলাম “এখানে কেন এত কষ্ট করে?” তিনি বলেন, মেমেগো (সিস্টারদের) ঔষধ একবার খেলেই ভাল হয়ে যায়। হেরা মিছা কতা কয় না, কম দামে ঔষধ পাওয়া যায়।”
এর চাইতে খ্রিষ্টসাক্ষী আর কি হতে পারে? এখন ওখানকার সেবার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। শুনেছি এসএমআরএ সিস্টার সম্প্রদায় তুমিলিয়াতে জমি কিনেছেন নাসিং কলেজ করার জন্য। খুবই সময়োপযুগী এবং মানবিক সেবার উদ্যোগ। আগে মানুষ শহরে যেতো, এখন শহর মানুষের দোরগোড়ায় এগিয়ে আসছে। পূর্বাচলের পরিধি ক্রমেই পূর্বদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা ভাওয়াল এলাকাটা শহরে পরিণত হয়ে যাবে হয়তো। পূর্বাচলের দ্বারপ্রান্তেই হাসপাতালটির নির্মাণ কাজ চলছে। নার্সেস স্কুল থাকলে অতি অল্প খরচে আমাদের যুবক-যুবতীরা ট্রেনিং নেবার সুযোগ পাবে। যে কোন হাসপাতালে গেলেই নার্সদের সেবার ধরন দেখেই বোঝা যায় তিনি একজন খ্রিষ্টান। কুমুদিনী হাসপাতালের সিস্টারগণ কত দক্ষ এবং মানবিক করে গড়ে তোলেন এসব নার্সদের।
ঢাকায় খ্রিষ্টান মালিকানায় স্কয়ার হাসপাতাল রয়েছে। অনেকে বলেন, এটা বিত্তবানদের হাসপাতাল। কিন্তু এর সেবার মান দেখে বাধ্য হন স্বীকার করতে ‘যেমন সেবা, তেমন খরচ’। সেবা পেতে হলে টাকা তো লাগবেই। মেডিকেল হাসপাতালে টাকা লাগেনা, কাজেই তাদের সেবার মান উন্নত রাখা সম্ভব নয়।
ঢাকা ক্রেডিটসহ সকল ক্রেডিট ইউনিয়নই ‘মুষ্ঠির চাল’ দিয়ে গঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ যৎসামান্য অর্থ দিয়ে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে। ফাদার ইয়াং স্বপ্ন দেখিয়েছেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে আমাদেরই। সময় এসেছে এগিয়ে যাবার। অতি দ্রæতলয়ে এগুচ্ছে পৃথিবী। পিছনে ফিরে তাকাবার সময় কোথায়। এতবড় উদ্যোগটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। একেরপর এক প্রকল্প হাতে নিয়ে শেষ পর্যন্ত যেন বড় প্রকল্পটি মার না খায়। একটা গ্রামীণ প্রবচন আছে ‘দশের মার গঙ্গা পায় না’। কথাটা ঠিক। দশজন একত্রে হওয়া, একমত হওয়া অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। যার ফলে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না।
ইদানিং হাওয়া ¯্রােতে মানুষের জীবন জীবিকার যেমন বদল হয়েছে তেমনি মানুষের স্বভাবের বিস্তর পরিবর্তন হয়েছে। অতীতে একজন মি. গুড অথবা একজন ভিনসেন্ট রড্রিক্স যা বলতেন, সর্ব সম্মতিক্রমে নির্দিধায় তা গৃহীত হতো। আজকাল শত মত, শত পথ, শত ধারা, শত দল। এখন চাটুকরে ভরা সমাজজীবন। এরা সবসময়ই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। বিশেষভাবে কোন নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন আয়োজন কালে এরা সর্বদা সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে। কথায় ফুলঝুড়ি তোলে সবাইকে বিমোহিত করে ক্ষমতায় যাবার জন্য। এধরনের লোকদের সম্বন্ধে যিশু বলেছেন, যখন তিনি জেরুসালেম মন্দিরে আসেন তাঁকে দেখে ইহুদিরা সেকি উল্লাস। “আজকে যারা হোসান্না বলে জয়ধ্বনি দিচ্ছে, তারাই একদিন চিৎকার করে বলবে, ‘একে ক্রুশে দাও বলে। এখন তাদের হাতে তালপাতা রয়েছে তখন এর বদলে থাকবে শাণিত ছুরি অথবা তীক্ষè বর্শা।”
আরেকটা ব্যাপারে তখন থেকেই সাবধান হতে হবে। যে জাতি বা সমাজের মাঝে অবাধ দুর্নীতি, যৌনাচার বিস্তার লাভ করে, সে জাতি বা সমাজের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ সে জাতি বা সমাজ হয় ঈশ্বরের আশীর্বাদ এবং করুণা বঞ্চিত। ঈশ্বরের আশীর্বাদ এবং করুণা বঞ্চিত কোনকিছুই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে না। অতএব সাধু সাবধান!
অতি সম্প্রতি তেজগাঁতে সাধু জন মেরী ভিয়ান্নী হাসপাতাল চালু করেছেন ক্যাথলিক মন্ডলীর পরিচালনায়। সময়োচিত সঠিক পদক্ষেপ। এবার করোনা মহামারি চলাকালে খ্রিষ্টানগণ হাসপাতালটির উপকারিতা বুঝতে পেরেছেন। কত সহজে, স্বল্প সময়ে, অল্প খরচে সেবা পেয়েছেন। সেদিন একজন বলল, ‘ভাই কত হাসপাতাল ঘুরলাম কিন্তু এই হাসপাতালেই দেখলাম কোনো দালাল নাই।” কথাটা শুনে ভাল লাগলো। এই তো খ্রিষ্ট সাক্ষ্য। সেবাই ধর্ম, সেবাই কর্ম, সেবাই পরপারে যাবার অতি সহজ পথ। বর্তমান সমাজ কাঠামোতে যে বাস্তবতা লক্ষ্য করছি, মানুষ কোভিড-১৯ মহামারির ফলে অনেকাংশে স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবনতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বোপরি মৃত্যু সম্বন্ধে ধারণা হয়েছে যে, মহামারি এলে আর রক্ষা নাই। এও বুঝতে পেরেছে, সামনে ভয়ংকর দিন আসছে। এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে। এমনই দুঃসময়ে আমাদের একটা হাসপাতাল হচ্ছে যা প্রতিটি সদস্যই গঠিত করছে। সেই সাথে আশাবাদিও হচ্ছে এই ভেবে যে, নিজেদের হাসপাতালেই মরতে পারবে। অন্তত বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা যাবে না। পথের পাশ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মাদার তেরেজার রোগীদের জিজ্ঞাসা করে জানা গিয়েছিল তাদের অনুভূতির কথা । তারা বলেছে, ‘মৃত্যুর পূর্বে অন্তত একটি ¯েœহের পরশ পেয়ে মরতে পারছি এটাই পরম সুখ।’
আশা করি ডিভাইন মার্সি জেনারেল হাসপাতাল প্রতিটি সদস্যদের অন্তত এ আশাটুকু দেবেন তাদের সেবার মাধ্যমে। আমার বিশ্বাস কয়েকজন নিবেদিত প্রাণ সিস্টার থাকলে জনগণের এ প্রত্যাশা পূরণ হবে। নিজেও এখন জীবনের শেষ প্রান্তে। তাই একজন বাবা হিসেবে কর্তৃপক্ষের কাছে একটা নিবেদন রেখে যেতে চাই, বর্তমান বাস্তবতায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কিন্তু প্রায় অপান্তেয় হয়ে যাচ্ছে। পরিবারগুলো ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ছোট হয়ে যাচ্ছে যার যার মত। ফলে শেষ বয়সে বাবা-মাকে দেখার কেউ থাকে না। এ বাস্তবতায় বলতে চাই, ডিভাইন মার্সি হাসপাতালে অন্তত একটি ওয়ার্ড যেন বরদ্দ রাখা হয় ‘প্রবীণদের’ জন্য। যেন শেষ বয়সে তারাও একটু স্নেহের পরশ পেয়ে হাসি মুখে পবিত্রভাবে মরতে পারে। এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান স্পন্সর হতে পারেন। ডিভাইন মার্সির রোগীরা যেন সেবা পেয়ে শান্তিতে মৃত্যুবরণ করতে পারে সেই প্রত্যাশা রাখি। স্বহৃদয় বিত্তবান ব্যক্তিদের অনুরোধ রাখি, তারা যেন ‘প্রবীন ওয়ার্ড’ এর স্পন্সার হয়ে আর্ত সেবায় নিজেদের গৌরবান্বিত করেন।
সেবা-ইতিহাসে অমর বাণী- ‘একা গড়ে না কেউ, গড়ে অনেকে মিলে’। এ সত্য যদি উপলব্ধি হয় তাহলে বুঝতে হবে দ্বীমত পোষণকারীদের দূরে সরিয়ে রেখে বাহবা পাওয়ার মধ্যে আত্মতৃপ্তি নেই। বরং সমবায়ী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরস্পরের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে মুক্তি ও মৈত্রের সুদৃঢ় বন্ধন। এ পথ যত দীর্ঘ ও ভঙ্গুরই হোক না কেন তা আমাদের পাড়ি দিতেই হবে। পবিত্র বাইবেল বলে, “আমরা যেন এক হই।” সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যে দিন এই হাসপাতালে সেবা পাবে শত শত মুমূর্ষ রোগী, এখান থেকে গড়ে উঠবে অনেক অনেক ডাক্তার, নার্স ও সেবাকর্মী। আমাদের প্রত্যাশা, তারা নিখাদ সরলতাভরা শিশু মন নিয়ে সেবা কাজে আত্মনিয়োগ করবে। জীবনের স্পন্দনে নিত্য আলোড়িত হবে হাসপাতালটি। ঈশ্বরের ¯েœহার্দ্র করপুটে আত্মসমর্পিত হয়ে ঐশ্ব করুণায় সিক্ত হবে এর নিবেদিত প্রাণের সেবক- সেবিকারা। ‘একে অপরের তরে’ এই আপ্তবাক্যে আমরা বিশ্বাসী। তাই আমরা করব জয় একদিন। সেদিনই মিথ্যার সমাধি পরে প্রতিষ্ঠিত হবে সত্যের মিনার।
সত্যময় ঈশ্বরকে যদি হৃদয়ে স্থান না দেই তাহলে প্রতিবেশীর প্রতি বিশুদ্ধ ভালবাসা থাকা সম্ভব নয়। তাই বলছি যাকে আমরা দেখতে পাই, সেই ভাইকে যদি ভালবাসতে না পারি, তখন যে ঈশ্বরকে দেখতে পাই না তাকে ভালবাসবো কেমন করে। সেবাই ভালবাসার পূর্বশর্ত। দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ সমবায় সমিতি দি খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড ঢাকা। তদানীন্তন আর্চ বিশপ লরেন্স গ্রেণার সিএসসি মহোদয়ের স্বপ্ন এবং ফাদার চার্ল যোসেফ ইয়াং সিএসসি এর প্রাণান্ত চেষ্টায় সমিতিটি গঠিত হয়েছিল ঢাকা শহরের অল্প সংখ্যক সদস্যদের নিয়ে। সেই সমিতি এখন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সমবায় সমিতি হিসেবে স্বীকৃত। এখান থেকেই পরবর্তীতে বিভিন্ন মিশনে, এমনকি এলাকা ভিত্তিক সমবায় সমিতি গড়ে ওঠেছে। সমিতির পরিসর বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়েছে। কর্মের পরিধিও বৃদ্ধি পেয়েছে নতুন নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে। অনেক প্রত্যাশা, অনেক দিনের হারানো স্বপ্ন, অনেক চিন্তা আলোচনার পর জনগণের আকাঙ্খার প্রকল্প ‘ডিভাইন মার্সি জেনারেল হাসপাতাল’ ঢাকা ক্রেডিটের একটি অন্যতম প্রকল্প। আন্তর্জাতিক মানের গুণগত সেবাদান নিশ্চিত করাই এই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য। ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত মঠবাড়ী ধর্মপল্লীর কুচিলাবাড়িতে ২৭ বিঘা জমিতে ৩০০ শয্যার হাসপাতালটি নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল হাসপাতালের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। উক্ত উনুষ্ঠানের গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভাতিকানের রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ জর্জ কোচেরী এবং কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও সিএসসি। একই বছর ৭ ডিসেম্বর হাসপাতালের নির্মাণ কাজের শুভ উদ্বোধন করা হয়। সমিতির কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা, ২০২২ সালেই হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হবে। অত্যন্ত খুশির বিষয় হলো হাসপাতালটির এই চমৎকার ও অর্থপূর্ণ নামটি প্রস্তাব করেছেন স্বয়ং কার্ডিনাল মহোদয়।
একটা সমবায় সমিতি, যার মালিক এর সদস্যগণ, তাদের নিজস্ব জমিতে নিজেদের অর্থায়নে এত বৃহৎ একটি প্রকল্প গড়ে তোলা কম গৌরবের ব্যাপার নয়। এর পরিচালনাও সহজ ব্যাপার নয়। তবুও এই সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলেই প্রশংসার দাবিদার। সময়োচিৎ সঠিক পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপে ভয়ও আছে, যেহেতু জনগণ এর মালিক তাদের কাছে জবাবদিহিতার প্রশ্নও রয়েছে। সব কিছুর মূলে রয়েছে সততা, সদিচ্ছা আর সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ। সততাই হোক মূলচালিকা শক্তি। ‘আমরা করব জয়’ সমবায়ের এই উদ্দিপনাই ব্যর্থতাকে জয় করার অমোঘ কৌশল। সেই অমিত সাহস নিয়েই ঢাকা ক্রেডিট এগিয়ে যাচ্ছে বলে বিশ্বাস করি। আশান্বিত এই কারণে যে, পুরোকর্মযজ্ঞটির সাথে চার্চ কর্তৃপক্ষের সহায়তা, পরামর্শ এবং প্রস্তাবনাও রয়েছে। সঙ্গে আরো রয়েছে পরামর্শক হিসেবে ভারতের ফাদার মুলার চ্যারিটেবল ইনস্টিটিউশন ও ভারতের এ্যাথেনা হাসপাতাল। ফাদার মুলার চ্যারিটেবল ইনস্টিটিউশন এর সাথে ঢাকা ক্রেডিটের চুক্তিনামা অনুসারে ডিভাইন মার্সি জেনারেল হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে নির্মাণ কাজের টেকনিক্যাল পরামর্শ, মানব-সম্পদ উন্নয়ন, কর্মীদের অর্গানোগ্রাম তৈরিসহ যাবতীয় সহযোগিতা করবে। এই হাসপাতালের সেবা নিতে পারবেন দেশের সকল ধরনের সমবায় প্রতিষ্ঠানের সদস্যসহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণ। এ প্রচেষ্টা সমবায়ী আন্দোলনেই কেবল নয় সেবা খাতেও একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে।
বর্তমান করোনা ভাইরাসের আগ্রাসী আক্রমনে বিশ্বব্যাপি জনগণের উপলব্ধি হয়েছে স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি জীবন বাঁচানোর এই পদক্ষেপ অতিদ্রæত সমাপ্ত হোক। জনগণ এর সেবা গ্রহণ করে সুস্থ দেহে বেঁচে থাকুন, গড়ে উঠুক আগামীর সুস্থ-সবল নতুন প্রজন্ম। স্বপ্ন পূরণের এই মহতী প্রচেষ্টায় যারা চিন্তা-মেধ-শ্রম-পরামর্শ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের জানাই শতকোটি প্রনাম। জয় হোক সদা প্রভুর, জয় হোক সমবায়ী জনগণের।
ডিভাইন মার্সি জেনারেল হাসপাতাল সংক্রান্ত ভিডিও