ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৮ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় বিউটিশিয়ানদের প্রতি দৃষ্টি দিবেন কি?

বিউটিশিয়ানদের প্রতি দৃষ্টি দিবেন কি?

0
3337

রেমন্ড আরেং || কেন্দ্রিয় সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ||
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আতংকের নাম করোনাভাইরাস। দিন যত যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা তত বাড়ছে, বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। ফলে মানুষের দুশ্চিন্তার কোনো অন্ত নেই। আর দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ হলো এই ভাইরাস প্রতিরোধে এখনো পর্যন্ত কোনো প্রকার প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরার্মশানুযায়ী এই ভাইরাসে কাছ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। আর এড়িয়ে চলতে গেলে সামাজিক ও শারীরিক দুরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে । সবচেয়ে নিরাপদ হলো গৃহে অন্তরীন থাকা; এই অবস্থায় থাকতে হবে ততদিন, যতদিন করোনাভাইরাসের প্রকোপ না কমে। এইভাবে চললে হয়তো কিছুদিনের জন্য সংক্রমণের হাত থেকে জীবনটা বাঁচানো যাবে। কিন্তু জীবিকা না থাকলে কি জীবন আদৌ রক্ষা করা যাবে!
এই পরিস্থিতিতে যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন সেলুন এবং বিউটি পার্লারের মালিক ও কর্মচারীরা। তেজকুনীপাড়াতে অবস্থিত একটি বিউটি পার্লারের একজন বিউটিশিয়ান এবং মালিক সম্প্রতি আমাকে জানালেন, তাদের বিউটি পার্লার বিগত মার্চ মাস থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে লকডাউনের কারণে। এই বিউটি পার্লারই ছিলো তাদের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ।
বিউটি পার্লার বন্ধ হয়ে যাওয়াতে মালিক তার কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছেন না, দিতে পারছেন না তার প্রতিষ্ঠান আর তার নিজের থাকার বাসার ভাড়া দু-মাস ধরে। পার্লারসংশ্লিষ্টএকটি সূত্র জানিয়েছে, গারো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীভুক্ত নারীদের দ্বারা পরিচালিত এরূপ বিউটি পার্লারের মালিক প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন ঢাকায় আছেন যারা ভাড়া বাসায় নিজেদের পার্লারে কর্মচারী রেখে কাজ করেন এবং তাদের সকলের অবস্থায়ই এখন একই রকম।
প্রতাপ রেমা, ‘নকমান্দি’ নামে (ঢাকায় বসবাসকারী গারো সম্প্রদায়ের) একটি কমিউনিটি সেন্টারের কো-অর্ডিনেটরের কাছ থেকে জানা গেল, ঢাকা শহরে গারো সম্প্রদায়ের প্রায় চার সহস্রাধিক বিউটিশিয়ান বিভিন্ন পার্লারে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এর মধ্যে ‘পার্সোনা’ বিউটি পার্লারেই কাজ করেন ২,৫০০ জনের মতো। লকডাউনের কারণে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মালিক তাদেরকে মার্চ মাসের বেতন দিয়ে বিদায় দিয়ে দিয়েছেন। কর্মচারীদের বলে দেওয়া হয়েছে অবস্থার পরিবর্তন হলে প্রতিষ্ঠান খোলার এক মাস পূর্বেই তাদের কাজে যোগদানের বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে।
উক্ত বিউটি পার্লারে কর্মরত এসব বিউটিশিয়ানদের অধিকাংশই ঢাকায় নিজেরা চলার পাশাপাশি বাড়িতে থাকা মা-বাবা আর ভাই-বোনদেরও খাওয়া আর লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য কেউ কেউ নিয়মিতভাবে টাকা পাঠাতেন। তিনি আরো জানান, এসব বিউটিশিয়ানদের বেশির ভাগ মোহাম্মদপুর, মিরপুর, জিগাতলা, শংকর, কালাচাঁদপুর, বাড্ডা, নদ্দা প্রভৃতি অঞ্চলে ভাড়া বাসাতে বসবাস করে থাকেন। তিনি বলেন, পার্লার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে কিছু সংখ্যক বিউটিশিয়ান বাড়ি চলে গেলেও ঢাকায় পরিবার থাকার কারণে অধিকাংশ বিউটিশিয়ানই বাড়ি যেতে পারছেন না।
এমতাবস্থায়, আমিসহ বেশ ক’জন মিলে ‘ কোভিড-১৯ রেস্পন্স টীম’ নামে একটি টীম গঠন করে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, বিত্তবান লোক এবং বন্ধুদের সহায়তায় খাদ্য ও অর্থ সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। পাশাপাশি স্থানীয় কাউন্সিলরসহ সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট জোনাল কর্মকর্তাদের অবহিত করে খাদ্য সহায়তা প্রদানের জন্য ব্যবস্থাসহ সরকারি সুবিধা গ্রহণের লক্ষ্যে তালিকাভুক্ত করিয়েছি। এ ব্যাপারে আমি নিজে একাধিক ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জোনাল কর্মকর্তাদের টেলিফোনে অনুরোধ জানিয়েছি এবং বিস্ময়কর রকমভাবে সাড়াও পেয়েছি তাঁদের কাছ থেকে। তাঁরা মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।
শুধু খাদ্য সমস্যা নয়, এখন খাদ্যের সাথে বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিলসহ পরিবারের আরো আনুসঙ্গিক খরচাদি এখন মেটাতে গিয়ে তাদের হাত শুন্য হয়ে গেছে। আবার অনেকেরই বাসাভাড়াসহ অন্যান্য বিলগুলো বকেয়া পড়ে গেছে। কারো কারো স্বামী-সন্তান দারোয়ান, রাজমিস্ত্রী, গার্মেন্টকর্মী, সেলুনকর্মীর মতো ছোটখাটো কাজ বা চাকরি-বাকরি করলেও ঢাকায় থেকে সেই টাকা দিয়ে অন্যান্য খরচ চালিয়ে যাবার জন্য পর্যাপ্ত নয়।
অন্যদিকে তাদের এই দুরবস্থার প্রভাব তাদের ওপর নির্র্ভরশীল গ্রামে থাকা তাদের মা-বাবা আর ভাই-বোনদের জীবনেও পড়েছে। অনেকের ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করার কারণে হুট করে বাড়ি ফিরে যাবার সিদ্ধান্তও নেওয়া যাচ্ছে না। আর বাড়ি ফিরে যাওয়াও বিদ্যমান সমস্যার কোনো সমাধান নয়। গ্রামের বাড়িতে কর্মহীনতার কারণেই তারা কর্মের খোঁজে ঢাকায় এসেছিলো, আর ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে এটারই বা কী নিশ্চয়তা !
উল্লিখিত অবস্থার প্রেক্ষিতে ঢাকায় কর্মরত এই শ্রেণির লোকজনদের দুশ্চিন্তা আর দুর্ভোগের অন্ত নেই। তারা দিশেহারা, অসহায়। ঢাকায় থাকা যেমন তাদের জন্য কঠিন, তেমনি বাড়ি ফিরে যাওয়াও তাদের জন্য সহজ নয়। ফলে তারা না পারছেন ঢাকায় থাকতে, না পারছেন বাড়ি ফিরে যেতে। এখানে শুধুমাত্র গারো সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেছি বলে এই সমস্যা মাত্র তাদেরই মধ্যেই সীমাবদ্ধ কিন্তু নয়; একাধিক বিউটিশিয়ান আমাকে জানিয়েছেন, যারা যেখানেই এই শিল্পের সাথে জড়িত,তারা সবাই এই করোনাকালে এমন অভিন্ন কঠিন এবং নির্দয় বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
এই বিউটিফিকেশন শিল্পের সাথে জরিত সবারই স্বামী-সন্তান-পরিবারের ভবিষ্যত ভেবে কোনো কূলকিনা পাচ্ছেন না। দুচোখে তারা শুধুই অন্ধকার দেখছেন। এহেন রূঢ় পরিস্থিতিতে তাদের সহায়তায় সরকার এগিয়ে না আসলে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যেই পড়ে যাবে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ঢাকায় আসা গ্রামের সাধারণ ঘরের এই বিউটিশিয়ানরা।