শিরোনাম :
ভাওয়াল থেকে উত্তরবঙ্গে খ্রিষ্টভক্তদের অভিবাসনের শতবর্ষের জুবিলি উদযাপন
রবীন ভাবুক ॥ মথুরাপুর
গাজীপুরের ভাওয়াল থেকে উত্তরবঙ্গে খ্রিষ্টভক্তদের অভিবাসনের শতবর্ষের জুবিলি উদযাপন করা হলো পাবনার মথুরাপুর ধর্মপল্লীতে। প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল: শতবর্ষের অনুগ্রহ (১৯২০-২০২০)।
২৭-২৮ মে, ২০২১ মথুরাপুর ধর্মপল্লীর উদ্যোগে এই জুবিলি উদযাপন করা হয়। দুইদিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল রাজশাহীতে ভাওয়াল থেকে আগত খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের আনন্দের মুহূর্ত। ১৯২০ সালে প্রথম রাজশাহীর মথুরাপুরে পল গমেজ (পলু শিকারী) নামে একজন খ্রিষ্টবিশ্বাসী এসে বসবাস শুরু করেন। এরপর থেকেই রাজশাহীর দক্ষিণ ভিকারিয়ায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বাঙালি খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের বসবাস।
জুবিলি অনুষ্ঠান উপলক্ষে ২৭ মে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় আরাধনা অনুষ্ঠান। জুবিলির মূল আনুষ্ঠানিকতা হয় ২৮ মে সারাদিন ব্যাপী। ২৮ মে মথুরাপুর মিশনের প্রতিপালিকা সাধ্বী রিতার পর্বদিনে এই জুবিলি অনুষ্ঠান করা হয়। জুবিলি অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহীর বিশপ জেভার্স রোজারিও ডিডি। জুবিলি অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন মথুরাপুর মিশনের পাল-পুরোহিত দিলীপ এস. কস্তা। অনুষ্ঠানের সার্বিক আয়োজনে ছিলেন ধর্মপল্লীল সহকারী পাল-পুরোহিত সাগর কোড়াইয়াসহ স্থানীয় খ্রিষ্টভক্তগণ।
এ ছাড়াও এদিন উপস্থিত ছিলেন কারিতাস বাংলাদেশের নবঘোষিত নির্বাহী পরিচালক সেবাষ্টিয়ান রোজারিও, মটস-এর পরিচালক ডমিনিক দিলু পিরিচ, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ফাদার, সিস্টার, ব্রাদারসহ বিভিন্ন ধর্মপল্লীর খ্রিষ্টভক্তরা।
সকাল ৯টায় শোভাযাত্রার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় মহাখ্রিষ্টযাগ। এরপর জুবিলি অনুষ্ঠানের ছিল বর্ণিল আয়োজন। বক্তব্য অনুষ্ঠান, কেককেটে শতবর্ষের আনন্দ সহভাগিতা, জুবিলির স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন, স্মৃতিচারণ, লটারি ড্রসহ আরো আয়োজন। অনুষ্ঠানের শুরু অতিথিরা পায়ড়া উড়িয়ে জুবিলি অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন। এরপর প্রধান অতিথি, সভাপতিসহ অন্যান্যরা শতবর্ষের ১শ টি প্রদীপ প্রজ্বল্লন করেন।
এ দিন সাধ্বী রিতার গ্রোটো উন্মোচন করেন প্রধান অতিথি ও অন্যান্যরা।
জুবিলি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বিশপ জেভার্স বলেন, ‘আজ আমাদের জন্য আনন্দের দিন। আজ থেকে শতবর্ষ আগে ভাওয়াল থেকে পলু শিকারী নামে একজন মথুরাপুরের উথুলীতে এসে বসবাস শুরু করেন। এরপর রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলেই ভাওয়াল থেকে খ্রিষ্টানরা এসে বসতি গড়ে তোলে। গত শতাব্দীর ৭০ দশক পর্যন্ত এই অভিবাসন যাত্রা অব্যাহত থাকে। আজ আমাদের সেই সব পূর্বপুরুষদের স্মরণ করছি। আজ মথুরাপুর মিশনের উদ্যোগে অভিবাসনের শতবর্ষ পালন করতে পারছি, তাই সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই।’
সভাপতি ফাদার দিলীপ এস. কস্তা বলেন, ‘উত্তবঙ্গে ভাওয়াল খ্রিষ্টান অভিবাসনের পূর্তি উৎসবটি সত্যিই আমাদের জন্য আনন্দময় অনুভূতি ও ঐতিহাসিক ঘটনা। শতবর্ষের পথ যাত্রায় শতরকমের অভিজ্ঞতা-অনুভূতির মিশ্র অভিজ্ঞতাই উৎসব। নতুন অভিযান, আবিষ্কারের নেশা ও সুখ-সমৃদ্ধির যাত্রাই হলো অভিবাসন। সভ্যতার ক্রমবিকাশের মধ্যে অভিবাসন একটি বাস্তবতা। এই দিনটির জন্য মহান ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এ উৎসব যেন ‘শতবর্ষের অনুগ্রহ স্মারক উৎসব।’
জুবিলি অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের জন্য একটি আনন্দময় মুহূর্ত। স্থানী মিশনসহ ঢাকা ও বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সমাগমে জুবিলি অনুষ্ঠানটি হয়ে ওঠে শতবর্ষের সার্থক সম্মিলন।
ভাওয়াল থেকে উত্তরবঙ্গে খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের অভিবাসনের ইতিহাস
উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইলা খ্রিষ্টান জনপদের পূর্বপুরুষ ছিলেন পলু শিকারী (পল গমেজ)। যিনি প্রধানত শিকারের উদ্দেশ্যে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে গাজীপুরের ভাওয়াল এলাকার নাগরী মিশনের বাগদী গ্রাম থেকে পাবনা জেলার মথুরাপুর গ্রামে আসেন। কথিত আছে, তিনি শুকর শিকারের জন্য পাবনা জেলার চাটমোহর থানার মথুরাপুর এসেছিলেন নিকটবর্তী উথুলী গ্রামের এক ব্যাপ্টিষ্ট পালকের নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে। তখন ছিল জমিদারী প্রথা। সেই সময়ের হিন্দু জমিদার বাবু আদেশ জারি করেছিলেন কেউ যদি শুকর মেরে সেই শুকরের লেজ তাঁকে দেখাতে পারে, তবে সেই শিকারীকে জমি পত্তন দেওয়া হবে। কেননা শুকরের পাল তখন ফসলি জমি, বিশেষ করে ধানের ক্ষেত নষ্ট করে ফেলত। পলু শিকারী জমিদার বাবুকে শুকরের লেজ দেখিয়ে মথুরাপুরের লাউতিয়া গ্রামে জমি পেয়েছিলেন। পরে সেখানেই তিনি সপরিবারে বসতি গড়ে তোলেন। এই পলু শিকারীর হাত ধরেই উত্তরবঙ্গে অর্থাৎ রাজশাহীর মথুরাপুরে খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় মথুরাপুরের নিকটবর্তী ফৈলজানা, বোর্ণী, বনপাড়া, ভবানীপুর গ্রামে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। যতদূর জানা যায়, মথুরাপুরের নিকটবর্তী ফৈলজানা গ্রামে প্রথম আগমন করেন রাঙ্গামাটিয়া মিশনের বিছু কস্তার পুত্র পলু কস্তা (পল কস্তা) ও তাঁর পরিবার। অভিবাসী খ্রিষ্টানদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে মথুরাপুর মিশন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বলা বাহুল্য, এই মথুরাপুর মিশন থেকেই উত্তরবঙ্গে ভাওয়াল খ্রিষ্টান জনপদের যাত্রা শুরু।
১৯৯০ সনের আগে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ ছিল দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের অধিনে। ভাওয়াল থেকে আসা এক পলু শিকারীর মধ্য দিয়ে বর্তমানে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের মথুরাপুর, বনপাড়া, বোর্নী, ফৈলজনা, গোপালপুর ও ভবানীপুর নামে ছয়টি ধর্মপল্লীর বিস্তার লাভ করেছে, যেখানে প্রায় ১৫ হাজার বাঙালি খ্রিষ্টভক্ত বসবাস করছেন।
(ইতিহাসের তথ্য: নয়ন যোসেফ গমেজ, সিএসসি)