ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা দেশ মাদকাসক্তি নিরাময়ের পথিকৃৎ রোনাল্ড

মাদকাসক্তি নিরাময়ের পথিকৃৎ রোনাল্ড

0
476

এস এম আজাদ || ঢাকা
মাত্র ২৫ বছর বয়সে মানবসেবার ব্রত নিয়ে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আসেন ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল। বেছে নেন শিক্ষকতা। এই পেশায় থাকার সময়েই তিনি লক্ষ করেন চারপাশে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার। আর এর শিকার হচ্ছে তরুণসমাজ। তারা মাদকে আসক্ত হয়ে অসুস্থ হচ্ছে, প্রাণ হারাচ্ছে। অথচ ওদের যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
উদ্যোগী হন ব্রাদার রোনাল্ড। প্রতিষ্ঠা করেন দেশের প্রথম মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান ‘আপন’। গড়ে তোলেন মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মডেল। আর এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবা দিতে গিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সবার আপনজন।
বাংলাদেশে মাদকাসক্তি নিরাময়ের এই পথিকৃৎ আর ফিরে যাননি নিজ দেশে। বরং সেখানকার সব সম্পদ বিক্রি করে ‘আপনের’ জন্য মানিকগঞ্জের সিংগাইরে গড়ে তোলেন বিশাল কমপ্লেক্স। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি একটি আদর্শ মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসনে কাজ করে গেছেন।
ব্রাদার রোনাল্ড ২০১৮ সালের এপ্রিলে অসুস্থ হয়ে পড়লে উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে ওই বছরের ১৫ অক্টোবর তিনি মারা যান। তবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আপন’ নিজ গতিতে কাজ করে চলেছে মানবতার সেবায়।
১৯৬৩ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন রোনাল্ড। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। এরপর সেন্ট নিকোলাস স্কুল ও সেন্ট যোসেফ স্কুলে। গাজীপুরের নাগরী হাই স্কুলেও কাজ করেছেন। প্রথম থেকেই তিনি থাকতেন রাজধানীর আসাদ গেটে সেন্ট জোসেফ স্কুলে।
‘আপন’-এর বর্তমান নির্বাহী পরিচালক হলেন সেন্ট জোসেফ স্কুলের অধ্যক্ষ রবি পিউরিফিকেশন। তিনি বলেন, “নিজ দেশ ছেড়ে, স্বজনদের দূরে রেখে মানবতার কল্যাণে ‘আপন’ নিয়ে কাজ করে গেছেন ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল। আমরা তাঁর আদর্শ ধরে রাখার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।”
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক স্টিফেন কোরাইয়া বলেন, ‘মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োগ করা ব্রাদার রোনাল্ড ছিলেন চিরকুমার। বাংলাদেশের মানুষকে মাদকাসক্তি থেকে রক্ষা করতে এই দেশেই থেকে গেছেন। একজন বিদেশি হয়েও তাঁর এই অনন্য অবদান ভোলার নয়। আমরা এখন তাঁর প্রতিষ্ঠানটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। এখন পর্যন্ত আপনে প্রায় পাঁচ হাজার মাদকাসক্ত রোগীর চিকিৎসা হয়েছে। একই সঙ্গে রোনাল্ড অন্য নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসকদেরও প্রশিক্ষণসহ সব ধরনের সহায়তা দিয়েছেন।
রোনাল্ডের মৃত্যুর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দাতা সংস্থা আপনে অর্থ সহায়তা করে এসেছে। আপনগাঁওয়ে তৃতীয় ভবনটিতে মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের জন্য একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র করার স্বপ্ন ছিল তাঁর। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চিন্তা করছেন সহকর্মীরা।
আপন সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর ফ্র্যাক-মেরি দম্পতির ঘরে ১৯৩৭ সালের ১ নভেম্বর জন্ম নেন রোনাল্ড ড্রাহোজাল। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁদের বাড়ির পাশেই বাস করত মাদকাসক্ত দরিদ্র এক লোক। একবার বড়দিনের সময় চারদিকে উৎসবের আয়োজন চলছে। কিন্তু মাদকাসক্ত ওই ব্যক্তির ঘরে উৎসবের লেশমাত্র নেই। ছোট্ট শিশুপুত্র রোনাল্ডকে সঙ্গে নিয়ে মা মেরি গেলেন ওই ব্যক্তির ঘরে। উপহার দিলেন নতুন কাপড়। উপহার পেয়ে লোকটির মুখে হাসি ফোটে। এই ঘটনা রোনাল্ডকে মানবসেবায় অনুপ্রাণিত করে।
ব্রাদার রোনাল্ড ২০১৬ সালে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, একদিন মোহাম্মদপুর টাউন হলে কিছু ছেলেকে মাদক নিতে দেখেন তিনি। এর মধ্যে শুনলেন, তেজগাঁও এলাকায়ও দেদার মাদক নিচ্ছে তরুণরা। খোঁজ নিয়ে জানলেন, তাদের চিকিৎসা করে ভালো করার ব্যবস্থা ঢাকা শহরে, বা দেশের কোথাও নেই। বিষয়টি তাঁকে নাড়া দেয়। তাদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন।
ওদিকে শিক্ষকতা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রোনাল্ড। সময়টা ১৯৮৮ সাল। ওই সময় মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে তাঁর এক মাদকাসক্ত প্রতিবেশীর অকাল মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুই পাল্টে দেয় ব্রাদার রোনাল্ডের গন্তব্য। ছোট পরিসরে ভাড়া বাড়িতে গড়ে তোলেন ‘আপন—আসক্তি পুনর্বাসন নিবাস’। এটি একটু বড় পরিসরে শুরু হয় ১৯৯৪ সালে। মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অভিজ্ঞতা নিতে ভারত ও নেপালের বিভিন্ন মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রও সফর করেন তিনি।
১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার জাইল্লা গ্রামে ‘আপন’-এর জন্য জমি কেনেন রোনাল্ড। ২০০৭ সালে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় তাঁর স্বপ্ন। ‘আপন’-এর নতুন ঠিকানাকে ভালোবেসে সবাই নামকরণ করেন ‘আপনগাঁও’।
দারুণ সুন্দর পরিবেশে গড়ে উঠেছে এই আপনগাঁও। বিশাল খোলা প্রান্তর, চারদিকে শুধু অবারিত সবুজ আর সবুজ, আছে আদিগন্ত ধানক্ষেত। তার মাঝখানে তিনটি দালান। দুটি নির্মাণে সহায়তা দিয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ও সামিট গ্রুপ। বর্তমানে একসঙ্গে ২০৬ জন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে পুনর্বাসন সহায়তা দিতে পারে ‘আপন’। প্রতিটি মাদকাসক্ত ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার পরও দুই বছর ‘আপন’-এর তত্ত্বাবধানে থাকে।
আপন নিরাময় কেন্দ্রের কাউন্সিলর জুয়েল জানান, ১৯৯৪ সালের ১ অক্টোবর ৩ দশমিক ১৬ একর জায়গা নিয়ে আপনগাঁও নিরাময় কেন্দ্রটি গড়ে তোলেন ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি অসুস্থ, সে পাগল বা খারাপ নয়’—এই স্লোগানকে হৃদয়ে ধারণ করে ‘আপন’।

সৌজন্য: কালের কণ্ঠ