শিরোনাম :
মানুষ ও পরিবেশ বন্ধু হওয়া উচিত
স্টেফান উত্তম, ঢাকা:
চলতি মাসেই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেল সাইক্লোন আম্ফান। এতে মৃতের সংখ্যা প্রায় ১৬ জন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রথমিতভাবে সরকার জানিয়েছে ১১ শ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে সেই ক্ষতি আসলে কত কোটি টাকা তা নিরুপন করা আদৌ সম্ভব কি না তা আসলেই প্রশ্নাতীত। যে ১৬ জন মারা গেছে তাদের জীবনের দাম আসলে কত টাকা ধরা হয়েছে? টাকা দিয়ে কি জীবনের দাম ধরা যায়?
মানুষ যে টাকারই সম্পদ হারাক না কেন, সেই টাকা কি তারা আদৌ পাবে? সরকার কি দিতে পারবে সেই ক্ষতিপূরণ?
শুধু আম্ফান নয়, বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন নামে যে ঘুর্ণিঝড় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তান্ডব চালিয়ে গেছে, তাতে প্রাণ নিয়ে গেছে হাজার হাজর, ক্ষতিগ্রস্ত করেছে লাখো মানুষের। কেই কি তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছেন?
বাংলাদেশেল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে পাওয়া যায় ১৯৮৮ সালের নভেম্বরের ঘুর্নিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকুলীয় এলাকা। বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৬২ কিলোমিটার। এই ঘুর্ণিঝড়ে ৫ হাজার ৭০৮ জনের প্রাণহানি হয়।
১৯৯১ সালে ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি হওয়া প্রবল ঘুর্ণিঝড়ের গতি ছিল ঘন্টায় ২২৫ কিলোমিটার। এটি মূলত চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূলে আঘাত হানে। ২৯-৩০ এপ্রিলের এই ঘুর্ণিঝড়কে আখ্যা দেওয়া হয় ‘শতাব্দীর প্রচন্ডতম ঘুর্ণিঝড়’ হিসেবে। এতে প্রায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় এক কোটির ওপরে মানুষ।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের ঘুর্ণিঝড় আমাদের সবার জানার কথা। এই ঘুর্ণিঝড় সরকারি হিসেবে প্রাণ কেড়ে নেয় প্রায় ছয় হাজার মানুষের। কিন্তু রেড ক্রিসেন্টের হিসেবে প্রাণহানি হয় প্রায় ১০ হাজার মানুষের। সিডর খুলনা ও বরিশাল বিভাগে তার তাণ্ডবের চিহ্ন রেখে যায়। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১৫ থেকে ২০ ফুট।
পরেই ২০১৩ সালে ঘুর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে। এতে কেড়ে নেয় ১৭ প্রাণ। ঘুর্ণিঝড় ‘কোমেন’ ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আঘাত হানে। ২০১৯ সালে ৩ মে ঘুর্ণিঝড় ‘ফনী’ অন্তত নয় জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। সরকারি হিসেবে এতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লক্ষ ২০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। একই বছর ঘুর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ কেড়ে নেয় বাংলাদেশের ২৪ জনের প্রাণ। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিগ্রস্তের পরিমাণ ২৬৫ কোটি টাকার ওপরে।
এছাড়াও প্রত্যেক বছরেই কমবেশি ছোটখাট ঘুর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূল দিয়ে যাওয়ার সময় দেশের সম্পদের ও মানুষের ক্ষতি করে যায়।
প্রত্যেক বছরই বন্যায় ক্ষতি করে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। অতি খরায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ না হলেও সংবাদকর্মী হিসেবে পেশাগত কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সুযোগ হয়েছিল খরা, বন্যা বা ঘুর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানুষের কথা সরাসরি শোনার। তাদের কথা তো একটাই, ‘আপনার মতো অনেক সাংবাদিক অনেক মানুষ এসে আমাদের কথা শুনেছে কিন্তু কাজের কাজটি কেউ করতে পারেনি। কেউ আমাদের এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে পারেনি। সবাই আমাদের আশার বাণী শুনিয়েছে।’ তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হলেও সাংবাদিকের মনতো একটু পাষাণই হয়, ভেতরে কান্না আসলেও বাইরে এর ছিটেফোটাও প্রকাশ পায় না। এভাবেই তাদের কাছ থেকে বিদায় নেই, অনেকের কথা মনে থাকে, আবার অনেককেই ভুলে যাই।
আমরা প্রতিবছরই এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হই কিন্তু এর কোনো স্থায়ী সমাধান এখনো আমরা দেখতে পাইনি। উপকূলীয় মানুষের অভিযোগ একটাই, তারা টেকসই বাঁধ চায়। এ বছরও করোনাকালে ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মুখের কথ আমরা গণমাধ্যমের বদৌলতে শুনেছি, তারা ত্রাণ নয়, টেকসই বাঁধ চায়।
আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি খুলনার কয়রা উপজেলার ঈদের দিনের ছবি। পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে মুসলমান ভাইয়েরা নামায আদায় করছেন। তাও আবার ঈদের দিনের বিশেষ নামায। অনেকেই ছবি রাজনৈতিক ইন্ধনের কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও আমি মনে করি ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতি হয়েছে এটা যেমন সত্য, তারা ঘুর্ণিঝড়ে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ফলে যে পানি ঢুকেছে সেই পানিতে দাঁড়িয়েছিল সেটাও সত্য। কাজেই রাজনৈতিকভাবে দেখার সুযোগ নেই, প্রয়োজন টেকসই বাঁধ।
প্রতিবারই গণমাধ্যম আমাদের জানান দেয়, সুন্দরবন আমাদের বাংলাদেশের জন্য ঢাল হিসেবে কাজ করে, বুক চিতিয়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে। কিন্তু আমরা কি সুন্দরবনের মর্ম এখনোও বুঝতে পেরেছি? বেশ কয়েকবার সুন্দরবন এলাকায় গিয়েছিলাম, দেখেছি যারা সেখানে বেড়াতে যান, তারা খাবারের পরে প্লাষ্টিকে প্লেট, বিভিন্ন পানীয় খেয়ে তার বোতল ফেলে রেখে আসে বনের ভিতরে। দেখেছি কিছু অসাধু মাছ চাষি যারা বাঁধগুলোকে দুর্বল করে মাছের ঘেরে পানি সরবরাহ করে। সেই স্থানগুলোই পরবর্তীতে ভেঙে যায়। বাঁধ নির্মাণের সাথে যুক্ত নেতা বা সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফলে সরকারি বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও যেনতেনভাবে বাঁধ মেরামতের ফলে বাঁধগুলো টেকসই হয় না।
বিভিন্ন পরিবেশ সচেতন সংগঠন বা ব্যক্তি বারবার সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করে আসছে। এর মধ্যে উল্লেখ করার মতো রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, বন ধ্বংস করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ অন্যতম। সরকার কোনো সিদ্ধান্ত অবশ্যই ভেবে চিন্তে নিয়ে থাকে, সেখানে দেশের উন্নয়ন যেমন থাকে, তেমনি বিষয়টির অগ্রপ্রশ্চাত ভেবে পরিবেশবিদদের প্রতিবাদও থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে, এমনকি ভারতও। সেখানে আমরা ভারতের অর্থায়নেই সুন্দরবনের পাশে স্থাপন করছি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
ভারতের অর্থ দিয়ে কেন ভারত নিজের দেশে এটা করছে না। বরং ভারতে কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কেন বাংলাদেশে এটা নির্মাণ করা হচ্ছে, কেন পরিবেশ সচেতন মানুষেরা এটা নিয়ে এতো সমালোচনা করছে দেশে এবং দেশের বাইরেও? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো পরিষ্কারভাবে সরকার আমাদের আমজনতার কাছে পরিষ্কার করে দিচ্ছে না। বলা হচ্ছে, রাশিয়া রূপপুরে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে, তার বর্জ্য নিজের দেশের নিয়ে যাবে এবং পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। এই ধারণা আসলে কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
এই যে উন্নয়ন এর সবই কিন্তু ভোগবিলাসিতার জন্যই। কিন্তু পরিবেশ বিপন্ন করে বর্তমানের ভোগবিলাসিতা পরবর্তী প্রজন্মের ওপর কী প্রভাব ফেলবে তা কি আমরা চিন্তা করেছি বা আমাদের যারা বিভিন্ন দায়িত্বে থেকে এগুলো করছে তারা কি চিন্তা করছে?
পোপ মহোদয় ২০১৫ সালে পৃথিবীর যত্ন ও পরিবেশের ওপর ‘লাউদাতো সি’ বা ‘তোমার প্রসংশা হোক’ নামের একটি সর্বজনীনপত্র দিয়েছেন। সেখানে তিনি বিশ্বের সকল মানুষের প্রতি প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিস স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন- মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশীদের প্রতি অনেক ক্ষতি করে চলেছে। পোপ মহোদয় আরও বলেছেন, ‘পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে মনপরিবর্তন’ অপরিহার্য, যাতে চতুর্দিকের জগতের সাথে মানষের সম্পর্ক সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমাদের কাথলিক মন্ডলী পোপ মহোদয়ের আহ্বানের সাড়া দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বিশেষ করে ‘লাউদাতো সি’ এর বাংলা করা হয়েছে সেটা সবার পড়া উচিত। বাংলাদেশ বিশপ সম্মিলনীর ন্যায় ও শান্তি কমিশন-এর জলবায়ূুপরিবর্তন ডেস্ক থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে- সবাইকে নিজ নিজ জায়গায় থেকে পরিবেশের যত্ন নেওয়ার জন্য, বিশেষভাবে গাছ লাগানো, নিজের বাড়ির আশেপাশে এবং পাশের জলাশয় পরিষ্কার রাখা। প্লাষ্টিকের জিনিসপত্র নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা, শিশুদের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করা বিভিন্ন কার্যক্রম হতে নিয়েছে পরিবেশ ডেস্ক এবং একই সাথে আমাদের সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশ সুরক্ষার জন্য।
আমাদের কাথলিক মন্ডলীর পক্ষ থেকে লাউদাতো সি-কে সামনে রেখে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে যা কাথলিক মন্ডলীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে কাথলিক মন্ডলী দেশের জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে ব্যাপক অবদান রেখেছে। তাই সময় এসেছে পরিবেশের ওপর কাজ করার। কারিতাস বাংলাদেশ চার্চের একটি চ্যারিটি এবং কারিতাস পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন কাজ করলেও চার্চের বা মন্ডলীর সময় এসেছে জাতির সামনে পরিবেশ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার। এর জন্য লাউদাতো সি হতে পারে একটি কার্যক্রম উপলক্ষ। পোপ মহোদয়ের বাণীকে সামনে এনে চার্চ রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাতে পারে- বিভিন্ন পরিবেশ ধ্বংস করে এমন প্রকল্প থেকে বেরিয়ে এসে বিকল্প চিন্তা করার।
স্টেফান উত্তম, সংবাদকর্মী