শিরোনাম :
যীশুর পুনরুত্থান: নতুন জীবনের আহ্বান
ফাদার দিলীপ এস. কস্তা
খ্রিষ্ট মন্ডলীর উপাসনায় যীশুর পুনরুত্থান পর্বটি খ্রিষ্টানদের নিকট প্রধান উৎসব।
যীশুর জীবনের শিক্ষা, জীবনাদর্শ, পালকীয় কাজ, নিরাময়সহ যাবতীয় কাজের পূর্ণতা লাভ করেছে যীশুর পুনরুত্থান পর্বের মাধ্যমে। খ্রিষ্টিয় উপাসনাকাল প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমত: আগমনকাল; দ্বিতীয়ত: তপস্যাকাল; তৃতীয়ত: পুনরুত্থানকাল এবং চতুর্থত: সাধারণকাল। খ্রিষ্টিয় উপাসনার মাধ্যমে খ্রিষ্টের শিক্ষা নিয়ে ধ্যান-প্রার্থনা করা হয় কাল অনুসারে। তপস্যাকাল খ্রিষ্টিয় উপাসনার অন্যতম একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা যেখানে ৪০ দিন ব্যাপি উপবাস, প্রার্থনা ও দানের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক অনুশীলন করা হয়। ৪০ দিনের আধ্যাত্মিক যাত্রা বা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ভক্ত বিশ্বাসী হৃদয়-মন-আত্মায় শুদ্ধ-সুন্দর ও মন পরিবর্তনের চেষ্টা করে। ৪০ দিনের যাত্রার মধ্যে প্রতি শুক্রবার ক্রুশের পথ করা এবং উপবাস রাখা হয়। যীশুর পুনরুত্থান উৎসব উদ্যাপনের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি হলো তপস্যা বা প্রায়শ্চিত্তকাল। প্রবক্তা যোয়েল শুদ্ধ-সুন্দর ও মন-পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “ তোমাদের পোষাক নয় কিন্তু তোমাদের হৃদয়টি ছিড়ে ফেল”। পুনরুত্থান পর্ব উদ্যাপনের আহ্বান নিয়ে তপস্যাকাল আসে প্রতিবছর প্রার্থনা, উপবাস, মাংসাহার ত্যাগ, ভিক্ষাদান ও পাপস্বীকার সংস্কার গ্রহণের তাগিদ নিয়ে। আর যীশুর পুনরুত্থানের মাধ্যমে ভক্ত বিশ্বাসী খ্রীষ্টভক্তগণ পুরাতন জীবনের জরা জীর্ণতা ও পাপ-কালিমা পরিহার করে প্রেরণা লাভ করে।
পুনরুত্থান শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো পুনরায় উপস্থিত হওয়া বা উঠা। পুনরুত্থানের সমার্থক অর্থ হলো জেগে উঠা, সজীব হওয়া, পরিবর্তন হওয়া, রূপান্তরিত হওয়া, নতুনভাবে শুরু করা, পুনরায় আরম্ভ করা। পুনরুত্থানের মাধ্যমে খ্রীষ্ট যীশু মুত্যুকে জয় করেছেন, পুনরুত্থিত হয়েছেন মৃত্যুলোক থেকে অন্ধকার-পাপ-তমসাকে জয় করে পুনরুত্থিত হয়েছেন। যীশু নিজেও তাঁর পরিচয়ে বলেন, “ আমিই পুনরুত্থান, আমিই জীবন। কেউ যদি আমার ওপর বিশ্বাস রাখে, তবে সে মারা গেলেও জীবিতই থাকবে, আর জীবিত যে কেউ আমার উপর বিশ্বাস রাখে, তাঁর মৃত্য হতেই পরে না- কোন কালেই না” (যো ১১: ২৫-২৬)। তাই পুনরুত্থান পর্ব বিশ্বাসী ভক্ত মানুষকে স্মরণ করিয়ে যীশুর সাথে পথ চলতে এবং নতুন প্রেরণা নিয়ে বেঁচে থাকতে, পুরুত্থান পর্ব পুনরায় নতুন চেতনা ও বিশ্বাসী নিয়ে খ্রিষ্টিয় জীবন পথে অগ্রসর হবার নিমন্ত্রণ জানায়। পুনরুত্থান পর্ব উদ্যাপনের কাল হলো ‘বসন্তকাল’। বসন্তকালে বিশ^ প্রকৃতির গাছ-পালা, বৃক্ষ তৃণলতা জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে থাকে এবং নতুন কচি পাতা গজিওে উঠার মাধ্যমে নতুনত্বের ভূষণে সুশোভিত হয়। বিশ^-প্রকৃতি যেন জেগে উঠে নতুনের সাথে বেঁচে থাকার আনন্দ রবে।
হিব্রু ক্যালেন্ডারের নিশান মাসের ১৫ তারিখ ইহুদীগণ নিস্তার পর্ব বা পাস্কা পর্বটি পালন করে। ইহুদী জাতির মুক্তির ইতিহাসের স্মরণ উৎসবই নিস্তার পর্ব। ইস্রায়েল জাতি ৪০০ বৎসরের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে প্রতিশ্রুত কানান দেশে এসেছিল। পবিত্র বাইবেলের পুরাতন নিয়মের যাত্রাপুস্তকের ১২ অধ্যায়ে সেই বর্ণনা পাওয়া যায়। তাই নিস্তার পর্ব হলো মুক্তি লাভ করার পর্ব, নিস্তার বা রেহাই পাবার স্মরণে উৎসব। দাসত্ব বা মুক্তি লাভের স্মরণ উৎসব। অন্য দিকে নতুন নিয়মে যীশু খ্রিষ্ট পাপ থেকে মুক্তি দেবার লক্ষ্য নিয়ে জীবন উৎসর্গ করেন। নতুন নিয়মে তাই পাস্কা বা নিস্তার পর্ব হলো পাপ থেকে মুক্তি লাভের পথ। অন্ধকার ও পাপের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের উপায়। পুরাতন নিয়মে মুক্তির প্রধান দিক ছিল ভৌগলিক সীমা রেখা তথা স্বাধীন দেশে প্রবেশ করার তথা সামগ্রিক জীবনের স্বাধীনতা উপভোগ করা। আর পবিত্র নতুন নিয়মে প্রধানত পাপ, মন্দতা ও তমস্যার দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করা তথা সামগ্রিক খ্রিষ্টিয় জীবনকে শুদ্ধ-সুন্দর করে গড়ে তোলা।
খ্রিষ্টিয় উপাসনায় পর্বগুলির মধ্যে পাস্কা পর্ব উদযাপন করার প্রচলন আদি মন্ডলীর যুগ থেকেই। পুনরুত্থান পর্ব উদযাপন করার জন্য আদিমন্ডলীতে ৪০ দিনের তপস্যাকাল, পুণ্য সপ্তাহ, যীশুর শেষ ভোজের স্মরণ অনুষ্ঠান, যীশুর ক্রুশীয় মৃত্যু, পুণ্য শনিবারের নিস্তার জাগরণী উৎসব উদ্যাপন করার মধ্যদিয়ে আনন্দময় পরিবেশে পুনরুত্থান মহোৎসব উদ্যাপন করতো। খ্রিষ্টিয় উপাসনার মূল রহস্য বা শিরোমনি হচ্ছে পুনরুত্থান পর্ব।
গ্রীক, লাতিন ও আরামিক ভাষায় Pascha শব্দ থেকে ইংরেজীতে Passover শব্দটি ব্যবহার করা হয়। আক্ষরিক অর্থ হলো: পার হওয়া, অতিক্রম করা, পেরিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। ইংরেজীতে Easter বা Resurrection Sunday বলা হয়।
আরা বাংলা ‘পুনরুত্থান’ শব্দটি খুবই অর্থপূর্ণ, কেননা ‘পাস্কা পর্ব’ উদ্যাপনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকভাবে পুনরায় আমরা উত্থিত হই ও পাপ স্বভাব থেকে জেগে উঠি এবং আলোকময় জীবনের দিকে যাত্রা করি। খ্রিষ্টধর্মীয় শব্দার্থ ২৪৫ শব্দ টীকায় নিস্তার পর্ব বা পাস্কা পর্ব যা পুনরুত্থান পর্ব নামে পরিচিত তা হলো “ইহুদীদের একটি মহাপর্ব; প্রতি বছর “নিশান” মাসের ১৫ তারিখে পর্বটি উদ্যাপিত হয়। (নিশান হলো নির্বাসনোত্তর হিব্রু ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস আর্থাৎ আমাদের মার্চ ও এপ্রিল মাস। ইস্রায়েলীদের উদ্ধারের ঘটনাকে স্মরণ করা হয় (দ্র: যাত্রা পুস্তক ১২ অধ্যায়)। পাঠটির বিশেষ দিক হলো যজ্ঞ ভোজ আর অনুষ্ঠানটি শেষ হয় বলির মেষ ভোজনের মধ্য দিয়েই। পরবর্তী দিনগুলোতে খামিরবিহীন রুটির পর্বের সাথে সমম্বয় রেখে পর্বটি সপ্তাহব্যাপি পালিত হয়। খ্রিষ্টীয় নিস্তার উৎসব হল ঈশ্বরের মেষশাবক যীশুখ্রিষ্টের বলি উৎসর্গ যার দ্বারা মানব জাতি পাপের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ঈশ্বরের স্বাধীন পুত্র-কন্যা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে”। পাস্কা পর্বের যাবতীয় ঘটনাকে নিস্তার রহস্য হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। পুনরুত্থান উৎসব বা নিস্তার রহস্য হলো “ঈশ্বরের মেষশাবক হিসেবে যীশুর যন্ত্রণাভোগ, মৃত্যু বা পুনরুত্থানকে বুঝানো হয়ে থাকে, কারণ এই পথ দিয়েই তিনি ঈশ্বরের পরিকল্পনা অনুসারে গোটা মানব জাতির জন্য মুক্তি সাধন করেছেন। নিস্তার রহস্যের আরো একটি অর্থ হলো- যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানে আমাদের অংশগ্রণের পথ ও উপায় (দ্র: ২য় করি ৪: ১০-১২)। নিস্তার রহস্য হলো যীশুর জীবনের মূল রহস্য এবং খ্রিষ্টমÐলীর গোটা জীবনের চালিকা শক্তি” (খ্রিষ্টধর্মীয় শব্দার্থ, শব্দটীকা ২৪৬)।
পুনরুত্থান উৎসব ব্যক্তি জীবনকে নবায়িত করতে ও পরিশুদ্ধ হতে আহ্বান জানায়। খ্রিষ্টিয় উপাসনার গুরুত্বপূর্ণ এই পুনরুত্থান পর্ব ভক্ত বিশ্বাসীর কালিমাযুক্ত মন-অন্তরকে পরিশুদ্ধ হতে সুযোগ করে দেয়। সেই জন্যই তপস্যাকালের আধ্যাত্মিক অনুশীলন উপবাস, দান, প্রার্থনা, ক্রুশের পথ ও পাপস্বীকার সংস্কার গ্রহণসহ যাবতীয় সাধনার আনন্দময় উৎসব হলো পুনরুত্থান পর্ব। ‘পুনরুত্থান পর্ব’ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন নবায়িত হোক এবং পুনরুত্থিত খ্রিষ্টের চেতনায় আমাদের পথ চলার আহ্বান হোক অনন্ত জীবনের দিকে। পুনরুত্থান আমাদের বিশ্বাস, ভালবাসা-ক্ষমায় মহিয়ান ও পুনর্জীবিত করুক।