শিরোনাম :
শিক্ষাবিদ ফাদার বেঞ্জামিন আর নেই!
চলে গেলেন একজন শিক্ষাবিদ, একজন শিক্ষাগুরু, একজন শিক্ষা প্রেমিক। তাঁকে দেখেছি শিক্ষাগুরু হিসেবে, চিনেছি একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে। শত শত প্রদীপের মাঝে তিনি আলো দিয়েছেন অকাতরে। সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং অবসরপ্রাপ্ত ভাইস-চ্যাঞ্চেলর ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা সিএসসি।
গত শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) রাজধানীর সিটি হাসপাতালে বেলা ৪ টা ৪৫ মিনিটের সবাইকে কাঁদিয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে নেমে আসে শোকে ছাঁয়া। সরকারী, বেসরকারি স্থান এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা হারানোর ব্যথা বিরাজ করে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
হলিক্রস সংঘের কাছ থেকে জানা যায়, শনিবার বিভিন্ন স্থানে ফাদার বেঞ্জামিনের মরদেহ রাখা হবে সকল স্থরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। একই দিন বিকাল সাড়ে ৪ টায় তাঁকে হলিক্রস সম্প্রদায়ের নিজস্ব সমাধীস্থান ভাদুনে সমাধিস্ত করা হবে।
আজ শনিবার (১৪ অক্টোবার) সকাল ১০ টায় ঢাকার কাকরাইলের, সেন্ট মেরী ক্যথিড্রালে ফাদার বেঞ্জামিনের শেষ কৃত্যের প্রথম পর্বের খ্রীষ্টযাগ অনুষ্ঠাতি হয়। খ্রীষ্টযাগ উৎসর্গ করেন কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও সিএসসি।
খ্রীষ্টযাগে কার্ডিনাল প্যাট্রিক বলেন, ফাদার বেঞ্জামিন একজন সেবক ছিলেন। ঈশ্বরের দয়ার ফলে তিনি এসে ছিলেন এই ধরনীর বুকে। সেমিনারী থেকেই তাঁর সাথে আমার পরিচয়। বন্ধুতের পথ চলা সেখান থেকেই শুরু।
কার্ডিনাল বলেন, সমাজের পিছিয়ে পরা মানুষদের শিক্ষা প্রদানে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন শিক্ষার কারিগর। তিনি ভবিষৎ যাজকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যও কাজ করেছেন। ফাদার বেঞ্জামিন শিক্ষাক্ষেত্রকে উন্নত করতে চেয়েছেন। উদ্যোগতা ছিল তাঁর অন্যতম যোগ্যতা।
‘তাঁর একটি বড় গুন ছিল দরিদ্র মানুষদের তিনি ভালবাসতেন। পিছিয়ে পরা মানুষদের শিক্ষা দিয়ে উন্নত করতে চেয়েছেন। তার জীবন যাপন ছিল সহজ সরল। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সংগ্রাম করেছেন। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তিনি রেখেছেন অসাধারন ভূমিকা’ বলেন কার্ডিনাল প্যাট্রিক।
শ্রদ্ধা জানাতে এসে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা ছিলেন আমাদের দেশের শিক্ষা পরিবারে অভিভাবকের মতো। দেশ একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষককে হারালো। তাঁর অভাব সহজে পূরণ হবার নয়। তিনি একজন সেরা মানুষ ছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। নতুন প্রজন্মকে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলায় তাঁর অবদান রয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, তাঁর মৃত্যুতে শিক্ষা পরিবার গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত। তিনি পথ দেখিয়েছেন। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করেই আমরা শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাব।
এ দিন ফাদার বেঞ্জামিনকে শ্রদ্ধা জানান, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও সিএসসি, সংসদ সদস্য জুয়েল আরেং এমপি, ভাতিকান বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ জর্জ কোচ্যারী, ঢাকার সহকারী বিশপ ফ্রান্সিস শরৎ গমেজ, ঢাকার অবসরপ্রাপ্ত সহকারী বিশপ থিয়োটনিয়াস গমেজ সিএসসি, সিলেটের বিশপ বিজয় এন. ডি’ক্রুশ ওএমআই, হলিক্রস সংঘরে প্রভেনশিয়াল ফাদার জেমস ক্রুশ সিএসসি, ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট বাবু মার্কুস গমেজ, সেক্রেটারি পঙ্কজ গিলবার্ট কস্তা, বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও, মহাসচিব হেমন্ত আই. কোড়াইয়া, ঢাকা ক্রেডিটের কর্মকর্তাসহ সর্বস্তরের মানুষ এবং ফাদার, ব্রাদার, সিষ্টাররা।
দুপুর ১ টায় ফাদার বেঞ্জামিনের ২য় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খ্রিষ্টযাগ অর্পন করা হয় তেজগাঁও চার্চে। চট্টগ্রামের আর্চবিশপ মজেস কস্তা সিএসসি খ্রিষ্টযাগ উৎসর্গ করেন। সহযোগিতা করেন বরিশালের বিশপ সুব্রত হাওলাদার সিএসসি এবং অন্যান্য ফাদারগণ। খ্রিষ্টযাগ শেষে ফাদারের মরদেহ ভাদুনে হলিক্রস সংঘের নিজস্ব সমাধীস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
ফাদার বেঞ্জামিন দীর্ঘদিন ধরে লিভার সংক্রমণে ভুগছিলেন। এ ছাড়াও তিনি চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে প্রথমে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ডাক্তাররা বলেন, ফাদার বেঞ্জামিন চিকুনগুনিয়া এবং নিমোনিয়ায় আক্রান্ত, তাই তাঁর তিনি আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন। পরে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে পাঠানো হয়। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে শুক্রবার তাঁকে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর সিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবশেষে তিনি সেখানেই সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন।
কালিগঞ্জের দড়িপাড়া গ্রামে ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২ সালে ফাদার বেঞ্জামিন জন্ম গ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর পরিবার পাবনা জেলার মথুরাপুর মিশনে চলে যান। বাবা ম্যাথিও কস্তা এবং মা এলিজাবেথ পালমার ১১ সন্তানের মধ্যে ফাদার বেঞ্জামিন মেজ সন্তান।
উল্লেখ্য, ফাদার বেঞ্জামিন ছিলেন, একজন হলিক্রস সংঘের সন্ন্যাসব্রতী যাজক। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরণের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, তিনি বনানী সেমিনারীর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালন করেন নার্সেস গিল্ডের চ্যাপলেইনের দায়িত্ব। ফাদার বেঞ্জামিন ১৯৯৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দেশসেরা নটর ডেম কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের স্বপ্ন দ্রষ্টা ছিলেন তিনি। ২০১২ সাল থেকে ২১ আগস্ট, ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভাইস-চ্যাঞ্চেলরের দায়িত্ব পালন করেন। ২১ আগস্ট তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন।
ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর মধ্যে ২০০০ সালে জনকল্যাণ, সুস্থ্য ও সুন্দর জীবন গঠনে সাহসী, প্রজ্ঞাবান ও প্রশংসনীয় ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের ১০৫তম জন্মোৎসব উপলক্ষে প্রণব মঠের পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ঢাকা আর্চডায়োসিসের শিক্ষা কমিশন ২০১৫ সালে তাঁকে গুণীজন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করে।
ফাদার বেঞ্জামিন শিক্ষাক্ষেত্র ছাড়াও বিভিন্নভাবে শিক্ষার জন্য কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন ভাল লেখক এবং পৃষ্ঠপোষক। তার লেখা বেশকিছু বই রয়েছে। এ ছাড়াও তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় অংখ্য প্রকাশনা রয়েছে।
আরবি/আরপি/১৪ অক্টোবর, ২০১৭