ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৮ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা প্রবন্ধ শিল্প-সাহিত্য ভূবনে আলোকচিত্রী ও আলোকচিত্রকলা

শিল্প-সাহিত্য ভূবনে আলোকচিত্রী ও আলোকচিত্রকলা

0
1517

যিশু খ্রিস্ট জন্মের ত্রিশ বছর আগে থেকেই আলোকচিত্রশিল্পের নিরব উপস্থিতির ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে যে, অন্ধকার গুহাকে ক্যানভাস করেই অনানুষ্ঠানিকভাবে এমন অভিনব এবং সৃজনশীল এক শিল্পকলা চর্চার পথ চলা আরম্ভ। আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের জীবিকা নির্বাহের পূর্বপরিকল্পনা ফুটিয়ে তুলত গুহার সেই সাধারণ মাটির দেয়ালে। তারা ব্যবহার করত না কোনো দামী ক্যামেরা অথবা ডিজিটাল এসএলআর। কিন্তু আজ সেই জীবিকার তাগিদে মানুষ এতটাই মশগুল যে, আলোকচিত্রকলা চর্চার অবসর পাওয়াই যেন দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই শিল্পকলার চর্চা এগিয়ে চলেছে তার আপন গতিতে। সভ্য জগতে সেই শিল্পকলারই অভ্যুত্থান হয়েছে ‘ফটোগ্রাফি’ হিসেবে। যা আমরা সাজিয়ে রাখি আমাদের ঘরের দেয়ালে, সুসজ্জিত ফ্রেমে এবং তা করি নানা কারণেই।

‘ফটোগ্রাফ’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘আলো দিয়ে আঁকা’। আধুনিক শিল্প জগতে আলো দিয়ে আঁকা ছবিকেই আলোকচিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। আলোকচিত্র সম্পূর্ণরূপে আলোকচিত্রীর সৃজনশীলতা, দক্ষতা, চর্চা এবং জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। একজন শিল্পীর শৈল্পিকতা, সাধনা এবং চর্চাই পারে অর্থপূর্ণ একটি শিল্পকর্ম দর্শকের সামনে তুলে ধরতে। ফটোগ্রাফির সফলতা আসে তখনই, যখন কোনো শিল্পী তার আলোকচিত্রের মাধ্যমে কোনো বাস্তবতা বা সত্যকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়। ফরাসি আলোকচিত্রী জ্যাকস-হেনরি লার্টিগ (১৮৯৪-১৯৮৬) বলেছেন, ‘ধাবমান ও সত্য মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরা বন্দি করাই ফটোগ্রাফি।’ একজন আলোকচিত্র শিল্পীর কাজই হল মানুষের জীবনের আবেগ-আনন্দ-বেদনার মুহূর্ত এবং সফলতার বাস্তব ও সত্য ঘটনার চিত্র তার ফ্রেমে আবদ্ধ করা।

একজন আলোকচিত্রীর সাথে তার ফটোগ্রাফের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একজন আলোকচিত্রীকে অব্যশই শিল্পবোধসম্পন্ন হতে হয় এবং দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গিতে আপন আলোকচিত্রকে উপলব্ধি করতে হয়। একজন শিল্পীর উচিত নিজের আলোকচিত্রকে দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করা। আলোকচিত্রীর ভালোবাসা দিয়ে তার কাঙ্খিত ছবিকে ফ্রেমে আবদ্ধ করা বঞ্জনীয়। সেই ফ্রেমে আবদ্ধ করা ছবিটি যেন হয় তার প্রেমের গভীরতারই প্রতিফলন। ক্যামেরার চোখ যেন হয় এক আয়না, আর সে আয়নায় যেন প্রতিফলিত হয় একজন আলোকচিত্রীরই অসামান্য ভাবনা। আলোকচিত্র বোঝার কোনো বিষয় নয়, বরং অনুভবের। স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছবি দেখে দর্শক উপলব্ধি করতে পারে দুর্ভিক্ষে অনাহারে থাকা মানুষের কষ্ট। তিনি তুলি আর রং দিয়ে তার সামান্য গভীর উপলব্ধিকে প্রকাশ করেছেন এবং প্রতিফলন ঘটিয়েছেন ছবির প্রতি তাঁর প্রবল একাগ্রতা ও প্রেম। তেমনি আলোকচিত্রের ক্ষেত্রেও ক্যামেরা বা ডিএসএলআর নিছক যন্ত্রাংশ মাত্র; আলোকচিত্রের সৌন্দর্য নির্ভর করে আলোকচিত্রীর প্রেমের ওপর। ফটোগ্রাফারের উচিত তার ছবির ফ্রেমকে আপন করে নেয়া এবং প্রাণে-প্রাণ মিলন ঘটানো। কারণ, ফ্রেমের প্রাণের সাথে শিল্পীর প্রাণের সম্মিলনেই সৃষ্টি হয় সফল এবং শৈল্পিক আলোকচিত্রকর্ম।

একটি আলোকচিত্র তুুলি দিয়ে সযত্নে আঁকা ছবির চেয়ে কম মূল্যবান নয়। একজন শিল্পী যেমন করে তুলি আর রং দিয়ে তার চিন্তার প্রতিফলন ঘটায়, তেমনি একজন আলোকচিত্রীও আলো-আঁধারের খেলা দিয়ে তার মনের মাধুরী মিশিয়ে একটি সফল আলোকচিত্র সৃষ্টি করে। কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারে, যে ছবি তোলে, সেইতো ফটোগ্রাফার। কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত পরিচিতি প্রদান করে। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললেই কেউ ফটোগ্রাফার হয়ে যায় না। কারণ, কেউ মাতৃগর্ভ থেকে ফটোগ্রাফি শিখে আসে না, সুতরাং ফটোগ্রাফি শিখে নিতে হয়। ফটোগ্রাফিকে আয়ত্ত করে নিতে হয় তার জ্ঞান, দক্ষতা, চর্চা এবং শৈল্পিক মনোভাব দ্বারা। ফটোগ্রাফির সাথে ফটোগ্রাফারের তীক্ষè চিন্তা এবং অবিরাম চর্চার সংমিশ্রণ থাকতে হয়। ফটোগ্রাফি হলো আলোকচিত্রীর কঠোর পরিশ্রমের ফসল। তাই বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকজনই মাত্র এই পেশায় সফলতার মুখ দেখতে পেয়েছে।

দামী ক্যামেরা দিয়ে ভালো ছবি হয় — এমন ভুল ধারনা অনেকেরই রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ভালো ছবির সাথে দামী ক্যামেরা বা ডিএসএলআর-এর কোনো সম্পর্ক নেই। ফটোগ্রাফির সাথে যান্ত্রিকতার নয়, বরং আত্মার সম্পর্ক থাকা উচিত। যারা ফটোগ্রাফির সাথে স্ব-আত্মার সম্পর্ক গড়তে পারে, তারাই এ ধরাতলে লুকিয়ে থাকা বিষ্ময় উন্মোচন করতে পারে । ক্যামেরার চোখকে আলোকচিত্রীর মনের জানালার সাথে তুলনা করা যায়। কারণ, ক্যামেরায় তোলা আলোকচিত্রের মধ্য দিয়ে আলোকচিত্রীর জীবনদর্শন এবং মনোবস্থাই ফুটে ওঠে। যদি সেই আলোকচিত্র আলোকচিত্রীর মনের প্রতিচ্ছবি না হয়, তবে তা কোনো আলোকচিত্রই নয়। যারা যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল এবং মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা করে না, তারা কখনো সৃজনশীল আলোকচিত্র সৃষ্টি করতে পারে না।

বর্তমানে আলোকচিত্র আলোকচিত্রীনির্ভর না হয়ে সাবজেক্টনির্ভর হয়ে পড়ছে। সাবজেক্টনির্ভর আলোকচিত্রে ফটোগ্রাফারের ব্যক্তিগত দর্শন, সৃজনশীলতা, ধ্যান-ধারণা, মনের ইশারা, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি উপেক্ষিত। ফলে ফটোগ্রাফারের পক্ষে সফল কোনো আলোকচিত্রকর্ম সৃষ্টি করা দুর্বোধ্য কাজ। প্রকৃতপক্ষে, আলোকচিত্রীর মনের প্রতিক্রিয়া বা শিক্ষা-সংস্কৃতি কিন্তু মোটেই অবহেলা করার বিষয় নয়। তাই ক্যামেরা বা যন্ত্রের চোখ দিয়ে না দেখে মনের চোখ দিয়ে ছবির বিষয়টি অবলোকন করা উচিত। তবেই বদলাবে আলোকচিত্রের মান এবং সৃষ্টি হবে মহান আলোকশিল্পকর্ম। যা প্রতিটি প্রজন্মের নবীন ফটোগ্রাফারদের ভালো ছবি তুলতে অনুপ্রাণিত এবং উৎসাহিত করবে । একজন ভালো ফটোগ্রাফার হতে হলে নিজের অজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে। নিজেকে আবিষ্কার করতে হলে, নিজের দুর্বলতা এবং অজ্ঞতা স্বীকার করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। একটা স্বপ্নকে লালন করার মতোই ফটোগ্রাফি করার আগ্রহকে জিইয়ে রাখতে হবে।

বাংলাদেশে আলোকচিত্রের অবস্থান খুবই দুর্বল। তার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় বাংলা সাহিত্যকে। যে স্বনামধন্য সাহিত্যে আলোকচিত্রের কোন ঠাঁই হয়নি। বাংলা সাহিত্যে অনেক বিষয় নিয়ে লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু ফটোগ্রাফি সম্পর্কে কোন লিখনি বা সমালোচনা আজও চোখে পড়েনি। বাংলা সাহিত্যের বিশাল ভূবনে যদি আলোকচিত্র সামান্যতম ঠাঁই পেত, তবে আজ হয়তো আলোকচিত্রকর্ম বাংলাদেশে বিশেষ এক অবস্থানে থাকত। প্রাশ্চাত্যে আলোকচিত্র এবং আলোকচিত্রীদের সার্বিক দিক সসম্মানে স¦ীকৃত এবং মহিমান্বিত। আমরা বাঙালিরা আলোকচিত্রকে নানান উদ্দেশে শুধু ব্যবহার করতে জানি, কিন্তু তার ¯্রষ্টাকে কখনো জানতে বা চিনতে চেষ্টা করি না। আমরা বিভিন্ন দৈনিককে, ম্যাগাজিন বা বইয়ে ইন্টারনেট থেকে ছবি ব্যবহার করে আমাদের কাজ সম্পন্ন করি বটে, কিন্তু ছবিটির ক্রেডিটটি কার তা উল্লেখ করার প্রয়োজনও বোধ করি না। এ ক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতাও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। লেখক সমাজেরও উচিত তাদের লেখনীর মাধ্যমে আলোকচিত্রীদের এই অসামান্য কাজকে আরো উৎসাহিত এবং সম্মানিত করা। যাতে আলোকচিত্রী এবং আলোকশিল্পকর্ম উভয়ই বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করতে পারে।

সুনাম বা খ্যাতি অর্জন করাই যেন না হয় আলোকচিত্রীর উদ্দেশ্য। একজন আলোকচিত্রী যদি শুধু নাম-যশের পেছনে ছুটে বেড়ায়, তবে সে কখনই সফল হতে পারে না। বরং তার শিল্পসাধনায় ক্ষয় ধরে। একজন আলোকচিত্রীর উচিত নিজেকে তার শিল্পকর্মের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়া। ডুবুরির মতো তার শিল্পকর্মের ভিতর ডুব দিয়ে ফটোগ্রাফিকে আয়ত্ত করা, তবেই না সফলতার দর্শন পাবে। মোহ নিয়ে আর যাই হোক, কোনোদিন সফল আলোকচিত্র শিল্পী হওয়া যায় না। একজন আলোকচিত্রীর আলোকচিত্রকলায় কাঙ্খিত কিছু না থাকাই শ্রেয়। কারণ আলোকাচিত্রকলায় একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘তুমি ফটোগ্রাফিকে তোমার সবকিছু দিতে পার, কিন্তু ফটোগ্রাফি তোমাকে আনন্দ ছাড়া আর কিছুই দেবে না।’ যারা কোনো কিছু পাওয়ার আশা ছাড়াই ফটোগ্রাফি চর্চা করে যেতে পারে, এক কথায় বলা যায় তারাই সম্ভাবনাময়।

আমাদের দেশে ফটোগ্রাফি পেশা হিসেবে খুব একটা খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি। যারা এ পেশায় জড়িত আছেন, তারা তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পাচ্ছেন কিনা তা নিয়েই আমি সন্দিহান। তাদের তোলা কোনো আলোকচিত্র প্রদর্শনীর জন্য বাছাই করা হলে উল্টো আলোকচিত্রীদের নিজের অর্থায়ন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, প্রদর্শনীর নামে চলছে দারুন বাণিজ্য এবং লাভবান হচ্ছেন আয়োজকরা। আজকাল ফটোগ্রাফি অনেকাংশেই বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। নামীদামী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোই এসব প্রদর্শনীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। তাই বর্তমানে আলোকচিত্রকলা এবং আলোকচিত্রীদের শিল্পকর্মের প্রতি উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো। এ সব কারণেই পিতামাতা তাদের সন্তানদের এ পেশায় পড়াশোনা করাতে দ্বিমত পোষণ করে থাকে। প্রতিনিয়ত তাদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে।

আলোকচিত্রী হতে গেলে জ্ঞান অর্জন এবং সে জ্ঞানের সঠিক চর্চা অত্যন্ত প্রয়োজন। জ্ঞান ছাড়া শিল্পের ধ্যান যেন সত্যিই কল্পনাতীত। একজন জ্ঞানীব্যক্তির নিকট শিল্পকলা হল মাথার ওপরের ছাদ। জ্ঞান ছাড়া শিল্পকলা মাথার বোঝা ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু ফটোগ্রাফিকে ভিজ্যুয়াল আর্ট হিসেবে শিক্ষা দেয়া হয় না। শেখানো হয় না নন্দনতত্ত¦ এবং শিল্পকলার ইতিহাস। যদি একজন আলোকচিত্রী শিল্পকলার ইতিহাস এবং নন্দনতত্ত¦ না জানে, তবে সে কীভাবে নিজের তোলা ছবিকে দর্শকের সামনে তুলে ধরবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাঠের জিনিস আর ফটোগ্রাফি শিক্ষার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। তাই বাংলাদেশ সরকার কর্তৃপক্ষের উচিত ফটোগ্রাফি শিক্ষার প্রসার করা এবং সম্ভাবনাময় আলোকচিত্রদের মেধা বিকাশে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দান করা।

শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে বাংলাদেশের আলোকচিত্র এবং আলোকচিত্রীর অবস্থান শোচনীয়। তাই আমাদেরকে আলোর মতো হতে হবে যেন সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে সক্ষমতা এবং সৃজনশীলতা অর্জন করতে পারি। বাংলাদেশে শিল্প-সাহিত্যের ভূবনে আলোকচিত্র এবং আলোকচিত্রীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। কারো কারো ফটোগ্রাফির শখকে পরিণত করতে হবে গভীর প্রণয়-সাধনায়। জ্ঞানচর্চা এবং প্রণয়-সাধনার মধ্য দিয়ে আয়ত্ত করতে হবে ফটোগ্রাফি নামক শিল্পটি। জ্ঞানের ও চিন্তার মাধুরীতে রাঙিয়ে আলো-আধারের খেলা দিয়ে সৃষ্টি করতে হবে আপন আলোকচিত্রকর্ম। এমন একদিন আসবে যেদিন প্রণয়-সাধনা এবং আবেগী-অববাহিকায় আলোচিত্রী এবং আলোকচিত্রকলা হয়ে উঠবে শিল্পসাহিত্যের আলোকিত এক ভূবন।

আরবি/আরপি/১১ মে, ২০১৭