শিরোনাম :
সঞ্চয় করুন, আর্থিক স্বচ্ছলতা আনুন
সুমন কোড়াইয়া ।। ঢাকা
প্রদীপ গমেজ একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বেতন পান ষাট হাজারের ওপরে। ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, সন্তানের স্কুলের খরচ, খাবার খরচ, সমবায় সমিতির কিস্তি, ক্রেডিট কার্ডের বিল বাদে মাস শেষে সঞ্চয় করা কঠিনই হয়ে দাঁড়ায়। অপর দিকে প্রদীপরে বন্ধু কিরণ কস্তা চাকরি করেন একটি পোশাক কারখানায়। বেতন পান ত্রিশ হাজারের একটু বেশি। তিনি সব খরচ বাদেও প্রতি মাসে সঞ্চয় করেন কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা।
কীভাবে সম্ভব? সম্ভব হয়েছে কিরণের দৃঢ়তার কারণে। তিনি বিয়ে করেছেন নিজের জমানো টাকায়। তাঁর বিয়েতে ছিল না এত বেশি খরচের বাহুল্য। নিকট আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু ও কয়কজন সহকর্মীরাই বিয়েতে তাঁর আনন্দের সহভাগী হয়েছিলেন। তিনি ঢাকা শহরে তুলনামূলক কম খরচ হয় এমন একটি এলাকায় থাকেন। মাসের শুরুতে তিনি তাঁর বেতনের টাকা দিয়ে দেন তাঁর স্ত্রীর নিকট। তাঁরা দুজনে মিলে মাসের শুরুতে মাসিক বাজার করেন। এর আগে করে নেন বাজেট। বাজেটের বাইরে সহজে কিছু করতে চান না। এছাড়া তাদের রয়েছে একটি জরুরি তহবিল। সেখানেও প্রতি মাসে কিছু টাকা সঞ্চয় করেন। কোনো অসুখ বিসুখ হলে সেখান থেকে টাকা নিয়ে খরচ করেন। জরুরি তহবিল থেকে তিনি বিভিন্ন দাওয়াতেও খরচ সারেন।
প্রদীপের বিষয়টা আলাদা। তিনি বিয়ের আগে ছয় লাখ টাকা ঋণ করেছেন। ঘর সাজাতে কিনেছেন নতুন কিছু ফার্নিচার। তাই তাঁকে আরো এক লাখ টাকা ঋণ করতে হয়েছে এক সমবায় সমিতি থেকে। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে সংসার বড় হয়েছে। তাঁর ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে মাসে একাধিকবার মার্কেটে যেতে হয়। এ ছাড়া মাঝে মাঝে যেতে হয় স্বজনদের বাসায় দাওয়াত খেতে। ফলে বেশি আয় করলেও তাঁকে মাস শেষে মাঝে মধ্যেই কারো না কারো কাছ থেকে ধার দেনা করতে হয়।
আমরা সবাই জানি সঞ্চয় সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। কিন্তু বাস্তবে সঞ্চয় করা কঠিন একটা কাজ। এ ছাড়া বর্তমানে জীবন যাত্রার ব্যয়ও অত্যাধিক। এই আয় ব্যয়ের হিসাব নিকাশ টানতে গিয়ে এর প্রভাব পড়ছে অনেক মানুষের জীবনের ওপর। সম্পর্কের ওপর। আপনি হয়ত ভাবছেন, আপনার বয়স এখনো বেশি না। পঁচিশ পার হয়নি কিন্তু আপনার জন্য সঞ্চয় করার সময় ঠিক এখনই। কোন বড় কিছু কেনার জন্য ঋণ করে অর্থ সংস্থানের চেয়ে আপনি যদি সঞ্চয় শুরু করেন, তবে আপনার ঋণ হয়ত কম করতে হবে। ওপরে উল্লিখিত সঞ্চয়ী মনোভাবাপন্ন কিরণ তাঁর অর্জিত অর্থ ব্যয় করেন খুব হিসেব করে। পরিবারের সদস্যদেরও বুঝান সঞ্চয়ের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুই খরচ করেন না।
নিচে কিছু সহজ কৌশল দেওয়া হলো সঞ্চয়ের:
মাসিক বাজেট তৈরি: পারিবারিক বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই সঞ্চয়ের উদ্দেশে বাজেট তৈরি করা যেতে পারে। যেমন: এক মাসে কতটুকু খরচ করবেন, তা নির্ধারণ করে রাখলেন। যে জিনিসটি চলতি মাসে না কিনলেও চলবে, তা পরের মাসের জন্য রেখে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে মাসিক একটা বাজেট তৈরি করে নিতে হবে। এই বাজেটটি তৈরি করবেন স্বামী-স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা মিলে যেন বাজেট অনুসারে চলতে কোনো সমস্যা না হয়।
জরুরি তহবিল গঠন করা: মনে রাখবেন, মানুষের জীবনে কারো বিপদ-আপদ বলে কয়ে আসে না। যেমনটি গত এক বছর আগে করোনাভাইরাস পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। এই মহামারিতে আর্থিকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন প্রায় প্রতিটি মানুষ। করোনার এই স্বাস্থ্য যুদ্ধে মানুষকে যেমন ঘরের ভেতরে থাকতে হয়েছে, খেতে হয়েছে বাড়তি পুষ্টিকর খাবার। যেকোনো অসুখ-বিসুখ বা দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে বা লড়াই করতে জরুরি তহবিলে টাকা সঞ্চয় করুন। দেখবেন, প্রিয়জনের যেকোনো অসুখের সময় বা দণর্হটনায় বুকে সাহস থাকবে। অসহায় মুহূর্তে হাত পাততে হবে না কারো কাছে।
সঞ্চয়ের লক্ষ্য স্থির: টাকা হলো পানির মতো। আপনি হয়ত পানির মতো টাকা কামাচ্ছেন। কিন্তু ধরে রাখতে পারছেন না। ছোট ছোপ খরচে আগুলের ফাক দিয়ে পড়ে পানির মতো পড়ে যাচ্ছে আপনার আয়। তাই টাকা ধরে রাখার জন্য সঞ্চয়ের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। এখন ঢাকা ক্রেডিটসহ বিভিন্ন সমবায় সমিতিতে শর্ট টার্ম ডিপোজিট, বিবাহ সঞ্চয় প্রকল্প, উৎসব সঞ্চয় প্রকল্প, বয়স্ক সঞ্চয় প্রকল্প, ত্রৈমাসিক সঞ্চয় প্রকল্প, মিলিওনিয়ার ডিপোজিট স্কীমসহ নানা ধরনের সঞ্চয় করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ডাক বিভাগে রয়েছে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ। আপনি যদি লক্ষ স্থির করেন যে দশ লাখ টাকার জন্য আপনি সঞ্চয় শুরু করবেন, তাহলে আজই তা নিকটস্ত কোনো সমবায় সমিতিতে গিয়ে মিলিওনিয়ার ডিপোজিট স্কীমের মাধ্যমে সঞ্চয় শুরু করতে পারেন। মনে রাখবেন, সঞ্চয় যত বাড়বে, আপনার মুনাফাও বাড়বে। সমৃদ্ধি ঘটবে আপনার জীবনে।
বিলাস দ্রব্য পরিহার: কেউ লেটেস্ট মডেলের একটি বাইক বা মোবাইল কিনেছে, আপনারও সেই মডেলের কিনতে হবে। বা কেউ মার্কেটে এত দামে একটি শাড়ি কিনেছে, আপনাকেও সেটা কিনতে হবে- এই ধরনের মানসিকতা পরিহার করতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া কোনো বিলাসী পণ্য না ক্রয় করে আপনি সে টাকা সঞ্চয় করতে পারেন। যা হবে আপনার বিপদের বন্ধু।
অপ্রয়োজনীয় বিল বন্ধ করা: ধরুন আপনি অফিসে থাকেন সারাদিন। বাসায় থাকেন মাত্র কয়েক ঘন্টা। তাই বেশি দামের ইন্টার নেটের সংযোগ না নিয়ে কম দামের ইন্টারনেট সংযোগ নিতে পারেন। এ ছাড়া বাসায় অপ্রয়োজনে ফ্যান, এসি, লাইট না অন করে বিদ্যুৎ খরচ কমাতে পারেন। এখন ইন্টারনেটেই খবর পড়া যায়। চাইলে আপনিও মোবাইলে খবর পড়ে পত্রিকা খরচ বাঁচাতে পারেন।
আর্থিক বিষয়ে সহভাগিতা: আপনি যদি বিবাহিত হয়ে থাকেন এবং পরিবারের উপার্জনকারী হন, তাহলে আপনার জীবন সাথির সাথে আপনার আর্থিক অবস্থা নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করতে হবে যেন আপনার আয় অনুসারে তাদের চাহিদা থাকে। এছাড়া আপনার সন্তান হয়ত চাইতে পারে দামি কোনো খেলনা কিন্তু আপনি যদি তাকে কম দামি খেলনা দিয়ে বুঝাতে পারেন যে আপনার এই মুহুর্তে দামি খেলনা দেওয়ার সামর্থ নাই, তাহলে আপনার শিশু সন্তান অবশ্যই বুঝবে। তাই পরিবারের সকলে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এভাবে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ব্যয় করার আগে সঞ্চয় করা: এক সময় বলা হতো ব্যয়ের বাড়তি বা উদ্বৃত অংশ সঞ্চয় করার কথা। এখন বলা হচ্ছে ব্যয় করার আগে সঞ্চয় করা। বিষয়টা কঠিন মনে হলেও অভ্যাস করলে তা ক্রমে সহজ হয়ে যাবে।
সপ্তাহে একদিন বাজার না করা: প্রতিদিনই যে বাজার করতে হয় তা না। সপ্তাহে একদিন মাংস বা মাছ না খেয়ে ডাল, ডিম ও শাক-সবজি দিয়ে খেতে পারেন। যে জিনিসটা এখন না কিনলেও চলবে তেমন দ্রব্য না কিনে সেটা সঞ্চয় করা।
বীমা করা: উন্নত বিশ্বে বীমা করা বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বীমার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি সব মানুষের যেন বাধ্যতামূলক বীমা থাকে তার জন্য আহ্বান নিয়েয়েছেন গত ১ মার্চ জাতীয় বীমা দিবসে। তিনি কোম্পানিগুলোর উদ্দেশে আরও বলেন, ‘জনগণ যাতে বীমার বিষয়ে উৎসাহিত হয়, সে লক্ষে তাদের সচেতন করতে আপনাদের আরও ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।’ ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, বীমা হোক সবার’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ১ মার্চ দেশজুড়ে যথাযথভাবে জাতীয় বীমা দিবস-২০২১ পালিত হয়েছে। ঢাকা ক্রেডিটের মতো স্বাস্থ্যনিরাপত্তা স্কীম সেবার মাধ্যমে সমবায় সমিতিগুলো তাঁদের সদস্যদের জন্য বীমার ব্যবস্তা করতে পারে। বীমার সদস্য হলে বছরে দশজনের মধ্যে দুইজন হয়ত অসুস্থ হয়, কিন্তু দুইজন খুবই উপকৃত হয়। এভাবে বীমার সব সদস্যই অসুস্থ হলে চিকিৎসা প্রিমিয়াম অনুসারে চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকেন। তাই সবাইকে বাধ্যতামূলক বীমা করতে হবে।
বাজে অভ্যাস পরিত্যাগ: জীবনে যোগ বিয়োগ করে চলতে হয়। আমাদের সকলেরই কিছু বাজে অভ্যাস থাকে যা সঞ্চয় করার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। কেউ হয়ত অতিরিক্ত মদ্য পান করেন, কেউ হয়ত মাত্রারিক্ত ধূমপান করেন, আবার কেউ খান ঘন ঘন ফাস্টফুড বা বিরিয়ানী। এইসব অভ্যাস ত্যগ করলে আপনি যেমন সঞ্চয় করতে পারবেন, থাকতে পারবেন সুস্থ।
নিজের জন্য বিনিয়োগ করুন: এখন অনলাইনে অনেক কোর্স-এর সুযোগ রয়েছে। কোনো বিষয়ে আপনি দক্ষ হয়ে একটি চাকরি বা ব্যবসার পাশাপাশি আপনি অন্য খন্ডকালীন চাকরি বা ব্যবসা করে বাড়তি আয় করতে পারবেন এবং সঞ্চয়ও বেশি করতে পারবেন।
অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ না করা: সত্যি কথা বলতে কী, কেউ কেউ আছেন যারা ঋণ পাওয়াটাকে গর্বের মনে করেন। হিসাব করে দেখুন, আপনি যদি তিনটি সমবায় সমিতি বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন, তাহলে মাস শেষে ঋণ ফেরত বাবাদ আপনি কতগুলো টাকা সুদ দিয়ে থাকেন। তাই ঋণ করবেন কেবর মাত্র উৎপাদনশীল খাতে, যেখান থেকে আপনি মুনাফা পাবেন। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে জন্মদিন, বিয়ে, বিবাহ বার্ষিকী, আসবাবপত্র, বেড়াতে যাওয়ার মতো অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ করবেন। আর ব্যবসায়, কৃষি কাজে, উচ্চশিক্ষা বা ফ্ল্যাট কেনার মতো উৎপাদনশীল খাতে ঋণ করতে পারেন। ফ্লাট কিনলে আপনার ভাড়া বাসায় থাকতে হবে না। ভাড়ার টাকার সাথে আরো কিছু টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনার ঋণের কিন্তি দিতে পারবেন। আর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলে একসময় ভালো চাকরি বা ব্যবসা করে জীবনে সমৃদ্ধি আসবে।
ব্যয়াম করুন: পরিশেষে বলব নিয়মিত হাটুন ও ব্যয়াম করুন। আপনি ওপরের সব কিছুই করলেন কিন্তু স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান না তা তাহলে আপনার সব কিছুই পানিতে গেল। স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে আপনাকে বেশি বেশি চিকিৎসকের নিকট যেতে হবে। আপনার সঞ্চিত অর্থ সবই চলে যাবে চিকিৎসার জন্য যদি আপনার স্বাস্থ্য ঠিক না থাকে।
শেষে বলা যায়, যৌবনের সঞ্চয় হবে আপনার বৃদ্ধ বয়সের বন্ধু। আপনার বিপদের বন্ধু।