শিরোনাম :
সমবায়ের অগ্রপথিক ফাদার চার্লস জে. ইয়াং ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু!
ডিসিনিউজ ॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ঢাকা
ঢাকা ক্রেডিটের ইতিহাসের সাথে সংযোজিত হলো আরেকটি নতুন অধ্যায়। সমবায়কে শক্তিশালী করার কারিগর ফাদার চার্লজ জে. ইয়াং-এর নামে প্রতিষ্ঠা করা হলো ফাদার চার্লস জে. ইয়াং ফাউন্ডেশন।
সমবায়ের ভিত্তিকে আরো মজবুত ও শক্তিশালী করতে ঢাকা ক্রেডিট তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে ১৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ফাদার চার্লস জে. ইয়াং ফাউন্ডেশনের শুভ উদ্বোধন করে।
ঢাকা ক্রেডিটের প্রধান কার্যালয়ের বিকে গুড কনফারেন্স হলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকা ক্রেডিটের পরিচালনা পর্ষদ, উপদেষ্টা, বিভিন্ন কমিটির সদস্য ও ঢাকা ক্রেডিটের সদস্যদের অংশগ্রহণে এই ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হয়।
ফাদার ইয়াং-এর প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্ববৃহৎ সমবায় প্রতিষ্ঠান ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট বাবু মার্কুজ গমেজের সভাপতিত্বে নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিচালক ফাদার ফ্রাঙ্ক কুইনলিভান সিএসসি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই ফাউন্ডেশনের উদ্বোধন করেন।
ফাদার ইয়াংকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যই ঢাকা ক্রেডিট প্রতিষ্ঠা করেছে ফাদার চার্লস জে ইয়াং ফাউন্ডেশন। ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, ট্রেজারারসহ সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি বোর্ড এই ফাউন্ডেশনটি পরিচালনা করবেন। এই অরাজনৈতিক ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম হবে মেধাবী গরিব শিক্ষার্থীদের সহায়তা, সমবায়ের ওপর বিশেষ গবেষণা কাজে উদ্যোগীদের উৎসাহিত করা, সমবায়ে বিশেষ অবদানের জন্য উৎসাহিত করা ও নানা সমাজহিতৈষী কাজে অবদানের জন্য নানাভাবে অবদান রাখা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতি বাবু মার্কুজ গমেজ বলেন, ‘সমবায় নিয়ে যারা গবেষণা করতে চায়, সমবায়কে উন্নত করতে যারা কাজ করতে চায় এবং মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ও নানাবিধ জনহিতৈষী কাজের জন্য ফাদার চার্লস জে. ইয়াং ফাউন্ডেশন কাজ করবে। আমরা আশা করি আপনারা ফাদার চার্লস জে. ইয়াং ফাউন্ডেশনের সদস্য হবেন এবং আর্থিক সহায়তা দিয়ে ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।’
‘ফাদার চার্লস জে. ইয়াং ফাউন্ডেশন আমাদের দীর্ঘদিনের চাহিদা ছিল, আজ তা শুরু হলো। এখানে আপনারা মাত্র ১ লক্ষ টাকা দিয়ে আজীবন সদস্য হতে পারবেন। প্রতি বছর মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়ে এই ফাউন্ডেশনের সদস্য হয়ে সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবেন। যারা ফাউন্ডেশনের সদস্য হবেন, তাদের মধ্য থেকে তিনজন প্রতিনিধি এই ফাউন্ডেশন কমিটির সদস্য হবেন’ বলেন প্রেসিডেন্ট বাবু মার্কুজ।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের আইনের শাসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তা আপনারা দেখেছেন। যারা এখানে নেতৃত্ব দিতে চায়, কাজ করতে চায় তাদের সমবায়ের সম্পর্কে জানতে হবে। এই জানার জন্যই ফাদার চার্লস জে. ইয়াং ফাউন্ডেশন সহায়তা করবে। আমাদের এখানে দেশি ও বিদেশী উভয় ক্ষেত্রের সহায়তা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ফাদার ফ্রাঙ্ক কুইনলিভান বলেন, ‘আমি খুবই কৃতজ্ঞ যে এই অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পেরেছি এবং ফাদার ইয়াং-এর বিষয়ে কয়েকটি কথা বলতে পারছি। তার শিক্ষা এখনো আমাদের মনে ও অন্তরে রয়েছে। এখনো তার শিক্ষা অনুসারে কাজ করি এবং অন্যকে সেই শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
‘আমরা এক সঙ্গে কাজ করি সকলের মঙ্গলের জন্য’ ফাদার ইয়াং-এর উদ্ধৃতি দিয়ে ফাদার ফ্রাঙ্ক বলেন, ‘পারস্পরিক মঙ্গলের জন্য কাজ করে আমরা অন্যের জীবনের উন্নতি করি। এটাই হলো ফাদার ইয়াং ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য। জীবন হলো প্রতিযোগিতা, আমরা সব সময়, সবক্ষেত্রে সকলের সাথে প্রতিযোগিতা করি। আমরা পৃথিবীর মানুষ হিসেবে এই প্রতিযোগিতা করি। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় যারা দুর্বল, যারা প্রতিবন্ধী, যারা দরিদ্র তারা বারবার আঘাত পায়’ বলেন ফাদার ফ্রাঙ্ক।
তিনি বলেন, ‘এই পৃথিবী সব সময় আত্মকেন্দ্রিক। তাই আপনাদের এই ফাউন্ডেশনের কাজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটা প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতার। আপনাদের অনেক বছরের অভিজ্ঞতা, অনেক ইতিহাস। আর এই ফাউন্ডেশন হলো একটি গাছ, যার শিকর হলো ফাদার চার্লস। আমরা তাকে সম্মান ও স্মরণ করি। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আমরা যেন তার শিক্ষা অনুসরণ করি।’
[wp1s id=”10380″]
ঢাকা ক্রেডিটের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও বলেন, ‘আমরা আর্থিক অনুদান দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে অনেক কাজ করে থাকি। কিন্তু ফাদার ইয়াং-এর নামে তাঁর ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। ফাদার ইয়াং ৮৪ বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু তিনি যে কাজ করেছেন তা ৮৪ হাজার বছরও থেকে যাবে। তাঁর কাজ জীবনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে।’
অন্যান্য বক্তারা বলেন, আমাদের মাইক্রো ক্রেডিটের ধারণা নিয়েই ড. মো. ইউনুস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ঢাকা ক্রেডিট সমাজে যে অবদান রাখছে, এতে করে ঢাকা ক্রেডিটের নোবেল পাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের প্রচার, প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা নেই, যে কারণে আমরা অনেক স্বীকৃতি থেকে দূরে থাকি। এই প্রতিষ্ঠান শুরু হয়েছিল গরিবদের দ্বারা, গরিবদের জন্য। আমাদের কার্যক্রমে তাদের মনে রাখতে হবে, তাদের উৎসাহিত করতে হবে। আমরা ক্রেডিট ইউনিয়ন এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, আমাদের গ্রামে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে লুকিয়ে থাকা মেধাবীদের খুঁজে বের করতে হবে এবং তাদের সহযোগিতা করতে হবে। আমাদের থাকতে হবে স্বচ্ছ, পবিত্র, জবাবদিহিতা এবং দায়িত্বশীল হওয়া।
ফাউন্ডেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকা ক্রেডিটের ভাইস-প্রেসিডেন্ট শীরেন সিলভেষ্টার গমেজ, সেক্রেটারি পংকজ গিলবার্ট কস্তা, ট্রেজারার বিপুল লরেন্স গমেজ, ঢাকা ক্রেডিটের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি হিউবার্ট গমেজ, আরএনডিএম সিস্টার সম্প্রদায়ের প্রভিন্সিয়াল সুপিরিয়র সিস্টার রেবা ভেরোনিকা কস্তা, ঢাকা ক্রেডিটের প্রধান নির্বাহী অফিসার লিটন টি. রোজারিও, বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশনের মহাসচিব হেমন্ত আই. কোড়াইয়া, ডিভাইন মার্সি জেনারেল হাসপাতালের সিইও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জন গমেজসহ আরো অনেকে।
অনুষ্ঠানে সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি এবং সদস্যরা মিলে ফিতা কেটে ফাদার চার্লস জে. ইয়াং ফাউন্ডেশনের শুভ উদ্বোধন করেন।
ফাউন্ডেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ঢাকা ক্রেডিটের সেক্রেটারি পংকজ গিলবার্ট কস্তা।
অনুষ্ঠান শেষে ধন্যবাদ বক্তব্য দেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট শীরেন সিলভেষ্টার গমেজ।
বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিলেন ফাদার চার্লস জে ইয়াং সিএসসি। বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নিরীহ-গরিব মানুষের জীবন-মানের উন্নয়নে সবিশেষ অবদান রাখা। তাঁর এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন সমবায়ের পথ।
তৎকালীন সময়ে দরিদ্র মানুষ মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতেন। তাদের হাত থেকে সাধারণ জনগণকে বাঁচাতে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আর্চবিশপ লরেন্স এল গ্রেনার সিএসসি ক্রেডিট ইউনিয়ন-বিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য ফাদার ইয়াংকে কানাডায় প্রেরণ করেন। তিনি ফিরে এসে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ৩ জুলাই তিনি ৫০ জন সদস্য ও মাত্র ২৫ টাকা মূলধন নিয়ে নিয়ে পুরানো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে একটি ক্রেডিট ইউনিয়ন গঠন করেন, যা ‘দি খ্রীষ্টান কো-অপারটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি:, ঢাকা’ নাম নিয়ে খ্রিষ্টানদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গৌরবের সাথে কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠাটিই পরে ঢাকা ক্রেডিট নামে সুপরিচিত হয়।
এই নিবেদিত প্রাণ ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ নভেম্বর ঢাকার প্রেস ক্লাবের নিকটে সড়ক দুর্ঘটনায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকার তেজগাঁও গির্জার সমাধিস্থলে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
ফাদার চার্লস জে ইয়াংয়ের জন্ম ৩ মে ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের রচেস্টারে। বাবা ডানিয়েল ইয়াং এবং মা মেরী জেনিংস। তিন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় ফাদার ইয়াং স্কুল জীবনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন।
উল্লেখ্য, ঢাকা ক্রেডিটের তিন কোটি টাকা প্রাথমিক মূলধন নিয়ে ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হলেও এর পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকবে। উপরন্ত মাত্র ১ লক্ষ টাকা দিয়ে এই ফাউন্ডেশনের একজন আজীবন সদস্য হওয়া যাবে। ফাদার চার্লস জে ইয়াং ফাউন্ডেশনে সমবায় আন্দোলনের সফল প্রতীক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে এমনটাই প্রত্যাশা ঢাকা ক্রেডিটের সকল সদস্য, কর্মকর্ত ও শুভানুধ্যয়ীদের।
ছবি: শমিত ক্রুজ