শিরোনাম :
আজ শহীদ ফাদার উইলিয়াম এভান্স, সিএসসি’র মহা প্রয়াণ দিবস
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় শুধুমাত্র মাতৃভমি বাংলাদেশকে হানাদার সৈন্য বাহিনীর কবল থেকে রক্ষা করার বিজয় নয়- এ বিজয় কুৎসিতের বিরুদ্ধে প্রেমের বিজয়; অন্যায় ও ভন্ডামীর বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের বিজয়; ঘৃণা ও হিংসার বিরুদ্ধে প্রেমের বিজয়। তাই আমরা দেখেছি যাঁরা সত্য, সুন্দর, ন্যায়, প্রেম ও শান্তির জয়গান গেয়েছেন, তারাই হয়েছেন লুসিফাররূপী ইয়াহিয়ার শয়তান বাহিনীর শিকার; আর সেই কারণেই ফাদার এভান্সের মত একজন মহান ব্যক্তিত্ব তাদের খপ্পর থেকে রেহাই পাননি। অন্ধাকার হয়ে আলোকে ওরা সহ্য করতে পারেনি। তাই ওরা ১৯৭১ সালের ১৩ই নভেম্বরের বিকালে পৈচাশিক হত্যাযজ্ঞের উল্লাসে মেতেছিল।
ঢাকা জেলার গোল্লা ধর্মপ্লীতে কর্মরত ফাদার এভান্স উদ্বাস্তু ও মুক্তিযোদ্ধাকে নানাভাবে সাহায্যে-সহযোগিতা ও নৈতিক সাহস দান করেছিলেন। ১৯৭১ সালে ১৩ই নভেম্বর খ্রিষ্টযাগ অর্পনের জন্য নৌকাযোগে গোল্লা থেকে বক্সনগর যাবার পথে নবাবগঞ্জ ক্যাম্পের পাক সেনারা ফাদারকে ডেকে নিয়ে রেয়োনেটের আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল তার শরীর, গুলি করে চৌচির করে দিয়েছিল বুকের পাঁজর। অবশেষে শক্রু হস্তে তাঁর সব নির্যাতন, অত্যাচার আর উৎপীড়নের অবসান ঘটেছিল ইছামতী নদীর স্নিগ্ধ শীতল জলের বুকে। সেদিন ইছামতির জনপদে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। ভীতসস্ত্রস্ত্র অসহায় অগণিত মানুষ নিরবে নিভৃতে বোবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। মুক্তিবাহিনীর ভাইয়েরা খান সেনাদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে তাঁর মরদেহ এনে গোল্লার সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্ত করেছিলেন।
১৯৪৬ সালের কোন এক শুভলগ্নে পৃথিবীর সবচাইতে ঐশ্বর্যশালী স্বীয় মাতৃভূমি আমেরিকার মোহ ত্যাগ করে ফাদার এভান্স পাড়ি জমালেন কোমলতায় ভরা বাংলার সবুজ মাটির উদ্দেশে। বাংলার রূপে মুগ্ধ হলেন তিনি, ভালবাসলেন বাংলাদেশকে- ভালবাসলেন এদেশের মানুষকে। মানুষকে অকৃত্রিমভাবে ভালবাসতে গিয়ে তাদের সুখ-দুঃখ-বেদনার সহভাগী হতে ভালবাসলেন তাদের সূক্ষতিসূক্ষ ভাব প্রকাশের ভাষা বাংলাকে। দীর্ঘ ২৬ বছরব্যাপী সমতলভূমি থেকে আরম্ভ করে গারো পাহাড়ের পল্লীতে পল্লীতে ঘুরে প্রচার করলেন সত্যের বাণী। এ পৃথিবীতে যেটা সবচাইতে কঠিন কাজ সেটা হলো নিজে আদর্শচ্যূত না হয়ে অপরের সাথে মানিয়ে চলা। ফাদার এভান্স সেই দুর্লভ যাদুকাঠি লাভ করেছিলেন। তাই ধনী-দরিদ্র-সাধু-অসাধু, হিন্দু মুসলমান ও খ্রিষ্টান নির্বিশেষে যে-ই একবার সান্নিধ্য লাভ করেছেন সেই বলবে ফাদার এভান্স আমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন।
কারো কোন ভুল শুধরাতে কিংবা কাউকে ঠিক পথে পরিচালিত করতে তাঁর কৌশল ছিল অপূর্ব। একবার তিনি এক বাড়িতে এক যুবকের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন। গিয়ে দেখেন যুবকটির বৈঠকখানায় একখানা অর্ধউলঙ্গ মেয়ের ছবি টাঙ্গানো। ফাদারের কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে কিংবা কোন ক্ষোভ প্রকাশ না করে হাসি মুখে ছ্িবর দিকে তাকিয়ে যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কি সুন্দর ছবি!’ যুবকটি লজ্জায় মাথা উঁচু করে ছবির দিকে তাঁকাতে পারেনি। ফাদার কথাবার্তা সেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাখে যুবকটি ছবিটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছিল। তারপর সে আর কোনদিন অমন ছবি ঘরে টাঙ্গায়নি।
ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ^াসী ফাদার এভান্স জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের ভেতরে খুঁজেছেন খ্রিষ্টকে। তাই কোনদিন কাউকে কোন কথা দিয়ে তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তার খেলাপ করেছেন বলে আমার জানা নেই। তার সাথে যে কোন লোক যে কোন সময় দেখা করতে পারতেন সেজন্য কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না। প্রতিটি মানুষকে ভালবাসার আনন্দ-বেদনার সাথে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ মিশিয়ে ফেলেছিলেন, প্রতিটি মানুষকে ভালবাসার মধ্যে আবদ্ধ করেছিলেন। তাই তিনি যেকোন মহৎ কাজে হাত দিয়েছেন জনগণের অকুত সমর্থনে তো সোনা হয়ে ফলে উঠেছে।
জীবনের শেষ অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে ২৫ই মার্চ থেকে আরম্ভ করে আট মাসব্যাপী তিনি দেখেছেন মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণার এক চরমতা বহি:প্রকাশ-হত্যা, লুন্ঠন, জ্বালানী ও অধর্মের এক পৈচাশিক মত্ততা। সারাজীবন ব্যাপী ন্যায়, ভালবাসা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত ফাদার এভান্সের প্রাণ কেঁদে উঠেছিল। নিজে প্রার্থনায় মনোনিবেশ করেছেন- উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁর ভক্তদের প্রার্থনায় ও প্রায়শ্চিত্তে মনোনিবেশ করতে। উৎপিড়িত- নিপিড়িত জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের আশ্বাস ও শান্ত্বনা, বিপদে ধৈর্য, সাহস, শক্তি ধারণের প্রেরণা যুগিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর বৃহস্পিতিবার তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা হয় ঢাকাতে। সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের গেটের সামনে দেখা হতেই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন পরিচিত সব বন্ধু-বান্ধবের কুশলবার্তা। তারপর বললেন, ‘এবার ব্যস্ততার দরুণ সবার সাথে দেখা করতে পারলাম না। সবাইকে বলবে আমার ছুটির দিন ঘনিয়ে আসছে। দেশে যাবার আগে সবার সাথে সাক্ষাৎ করে যাবো। সবাইকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে দিও।’ বিদায়ের পূর্ব মূহুর্তে উচ্চ হাসিতে বলে উঠলেন, ‘জয় বাংলা’। শুক্রবার তিনি আর্চবিশপ গাঙ্গুলীকে নিয়ে নৌকা যোগে ফিরে গেলেন গোল্লা ধর্মপল্লীতে। শনিবার তাঁর অনন্ত ছুটি মঞ্জুর হলো। তিনি চলে গেলেন আপন দেশে। একমাস পরেই মহান পুরুষের কণ্ঠোচ্চারিত জয় বাংলা ধ্বনির হল বাস্তব রুপায়ণ। নির্দোষের রক্তপাতে যুগে যুগে এসেছে মানুষের মুক্তি। তার তিরোধানে আমরা হারালাম এক নিষ্ঠাবন যাজক, স্নেহশীল পিতা, সুপরামর্শদাতা ও অকৃত্রিম বন্ধুকে।
১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারী সোমবার এক স্মরনীয় দিন। এক জনগণ-নন্দিত মহান পুরুষের সমাধিতে আর এক জনপ্রিয় নেতার আগমন। দীর্ঘ নয়মাসব্যাপী সিমান্তের ওপার থেকে সংগ্রাম অভিযান চালিয়ে নব নির্বাচিত এস,সি,এ, জনাব আশরাফ আলী চৌধুরী মাতৃভূমিতে ফিরে প্রিয় বন্ধুর সমাধিতে অর্পণ করেত এলেন পুষ্পাঞ্জলি গোল্লা গির্জা প্রাঙ্গণে। সমবেত নর-নারীর বিরাট জনতা। বহুদিনপর আপনজন দর্শনে প্রশমিত বিয়োগ ব্যথার জ্বালা যেন আবার নতুন করে জ্বলে উঠলো সবার প্রাণে। সবাই নির্বাক। চারিদিকে এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ বিরাজমান। শুধু শতশত জলভরা চোখ আপন ভাষায় বলে যেতে লাগলো পিছু ফেলে আসা এক মর্মান্তিক ইতিহাস।
জনাব আশরাফ আলী চৌধুরী বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে বললেন, “প্রায় এক বছর আগে গোল্লার এই পূণ্যভূমিতে এসে সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম এক মহান পুরুষের। তিনি আমাকে ও আমার এক ভাই সুবেদ আলী (টিপু) এস,সি,এ,- কে পরম আদরে জানিয়েছিলেন স্বাগতম। তারপর এই নবনির্মিত গির্জার ভেতরে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখিয়ে আর্শীবাদ করেছিলেন আমাদের দুজনকে। যেন আমরা উভয়ে দুঃস্থ মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করে সফলকাম হতে পারি, যেন বাংলার প্রতিটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম হই। আজো তার পবিত্র কর স্পর্শ আমার বুকে- মাথায় অনুভব করি। প্রতি মুহুর্তে স্মরণ করিয়ে দেয় সেই মহাত্মার আর্শীবাণী। ছাব্বিশ বছরব্যাপী তিনি আমাদের মধ্যে যে সব জনহিতকর কাজ করে গেছেন তার তুলনা নেই। অবশেষে নিঃস্বার্থভাবে তার অমূল্য জীবন উৎসর্গ করে প্রমাণ করে গেলেন মানুষে মানুষের কোন ভেদ নেই। আজ তার পবিত্র রক্ত লাখ লাখ শহীদের রক্তে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তিনি বাংলার ইতিহাসে অমর ও অক্ষয় হয়ে রইলেন। তিনি যে শিক্ষা ও আদর্শ আমাদের জন্য রেখে গেছেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা যদি তাঁর সে শিক্ষা ও আদর্শ অনুযায়ী দেশ গড়ার সংগ্রামে ব্রতী হই তাহলে অচিরেই আমরা প্রেম প্রীতি মায়ঘেরা সুখী সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবো। প্রতি বছর হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান এখানে এই পূণ্যভূমিতে যথাযথ মর্যাদার সাথে ফাদার এভান্সের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেন। আর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমি কথা দিচ্ছি, তাঁর সমাধির গড়ে দেয়া হবে স্মৃতিসৌধ।’
সমবেত জনতার চোখে মুখে ফুটে উঠলো এক অপূর্ব শান্ত¡না ও তৃপ্তির আভা। আশরাফ আলী সাহেবের ভাষণ নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল কবি গুরুর সেই বাণী- “নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।”
অনুলিখন:
বইঃ মুক্তিযুদ্ধে আমরা
খ্রীষ্টানদের অবদান
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫
সূত্র: প্রতিবেশী, ৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ২১ ফেব্রুয়ারি- ১৯৭২ পৃষ্ঠা- ৭
(মুক্তিযুদ্ধে আমরা খ্রীষ্টানদের অবদান’ বই থেকে সংগৃহীত)