শিরোনাম :
বড়দিনের আনন্দ!
রবীন ভাবুক:
আজ খুবই বাবার কথা মনে পড়ছে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম রোববার আজ। ডিসেম্বর মানেই বড়দিনের আন্দন প্রস্তুতির শুরু। এই মাসে অনেক ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বাবার কথা মনে পড়ার কারণটা হলো, সকালে ঢাকা ক্রেডিটে ডিসেম্বরের প্রথম রোববার হিসেবে সুইট ডিসেম্বর পালন করেছে। আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠানে সমিতির সেক্রেটারি একটা কথা বললেন, ‘আগে বেশি মানুষ কৃষক ছিলেন, এই মাসে নতুন ধান এবং শস্য কৃষকরা ঘরে তোলেন, তাই বড়দিনের আনন্দ বেড়ে যায়।’ তখনই আমি ছোট বেলায় ফিরে যাই। বিশেষ করে বাবা এবং মায়ের মুখটা বেশি মনে পড়েছে। এখন তো চাষীদের সংখ্যা কম। কিন্তু আগে তো গ্রামবাংলা চাষ নির্ভর ছিল। যদিও আমার বাবা নৌ-পরিবহনে (বিআইডব্লিউটিএ) চাকুরি করতেন। সেক্রেটারির কথা শুনে ছোট বেলার কথা মনে হলো সেই সাথে মনে হয়েছে আসলে বড়দিনের আনন্দটা কি এবং ভাল মানুষের তকমা কি গায়ে লেখা থাকে!
বড়দিন সবার কাছে আনন্দের! নতুন জামা পরলে, ভাল খাবার খেলেই বড়দিনের আনন্দ বাড়ে কিনা তা আগে বুঝিনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছিলো যেন সত্যিকারের বড়দিনের আনন্দ অন্যকিছুতে। বলেছিলাম বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে, কারণটা হলো: যখন আমার বাবা-মা বেঁচে ছিলেন, তখন দেখেছি, কীভাবে তারা বড়দিন পালন করতেন। চারিদিকে সাজ সাজ রব। বাড়ি-ঘর সাজানো, উঠানে কয়েকবার গোবর ছিটানোসহ নানা ধরনের ব্যস্ততা। এত এত আনন্দ, তবুও কিছু পরিবারে চিন্তার ছাপ। কারণটা ছিল বড়দিনের খরচ, কাপড়চোপড়, খাওয়া-দাওয়া এবং সবচেয়ে বেশি চিন্তার ছিল সন্তানকে নতুন ক্লাশে ভর্তি করা।
আমার বাবা-মা বড়দিনের রাতে (২৪ ডিসেম্বর) গির্জায় যেতেন। মধ্য রাতে গির্জা থেকে ফিলে বড়দিনের রান্নার আয়োজন শুরু হতো। বাবা সব সময় বড়দিনের রান্না করতেন। খুব ভাল রান্না জানতেন বাবা, যা বড়দিনের স্পেশাল ছিল (এখন মনে হয়)। অনেক অনেক বাজার আসতো বাসায়। অনেক রান্না। সাথে মা দিদিরা এবং বৌদি ব্যস্ত থাকতেন। বিকেলে সব কেটেকুটে প্রস্তুত রাখতেন। রাতে রান্না শুরু হতো, ভোর রাতে শেষ। সকালে এলাকার মানুষ শুভেচ্ছা বিনিময়ে আসতেন, তাদের আপ্যায়ন করতেন দিদিরা এবং বৌদি। আর অন্ধকার ভোর সকাল থেকে দেখতাম, মা আলাদা আলাদা পাত্রে (বোল) অনেক করে বিভিন্ন ধরনের খাবার সাজাতেন এবং বাবা সেগুলো বহন করে যারা বড়দিনের আয়োজন করতে পারেনি তাদের বাসায় পৌঁছে দিত। যেহেতু কয়েকটা বোল থাকতো, তাই আমিও গিয়েছি বাবার সাথে অনেক বাসায়। এভাবে এক বাসায় দিয়ে আবার এসে মায়ের প্রস্তুত করা কয়েকটি পাত্র আরেক বাসায় দিয়ে আসতেন। এটা নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি বা চিন্তা করিনি। তবে আজ মনে হচ্ছে, সেটাই ছিল তাদের সেরা বড়দিন।
গত বড়দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠে দরজায় দাঁড়ালাম। এলাকায় মুসলমান চাচা (নাম: ছেক চাচা) সামনে এসে বললেন, বাবাজি কেমন আছ? আমি বললাম, কাকা ভাল আছি, আপনি কেমন আছেন? চাচা শুধু বললো, কাকা-কাকী তো নেই (আমার বাবা-মা) বলেই কেঁদে ফেললো। এভাবে সারা দিনে অনেকেই এসে বাবা-মায়ের কথাই বলে গেল। প্রথম প্রথম খারাপ লাগছিল যে বাবা-মায়ের কথা বেশি মনে করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর মনে হলো, বাবা-মা আমাদের জন্যই সেরা বড়দিনগুলো রেখে গেছেন।
বড়দিনের পর দেখতাম, সন্ধ্যা আশেপাশের কেউ কেউ আসতো এবং বাবা তাদের হাতে ২ শ বা ৩ শ টাকা দিয়ে বলতেন ভাল মতো পড়তে হবে। ভাল একটা স্কুল ড্রেস কিনে দিবে। অথচ আমার পড়ার বিষয়ে বাবা কোনোদিনও একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। বাবা গত হওয়ার কিছুদিন আগে আমি একদিন বাবাকে বলেছিলাম, আপনি তো সকলের খোঁজ নিয়েছেন, কোনোদিন তো আমার পড়ার বিষয়ে কিছু বলেননি? সেদিন বাবা শুধু বলেছিল, তোমাকে দেখার জন্য তুমিই সবচেয়ে শক্তিশালী।
গতকাল রাতে ফেইসবুকে কাছের এক বড় ভাই লিখেছে, বড়দিন আসছে, আর টেনশন বাড়ছে। এরপর অনেক ধরনের চিন্তার কথা। পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন কাপড়, সাজনী, খাবার দাবার এরপর সবচেয়ে কষ্টের হলো, বড়দিনের পর দুই সন্তানকে নতুন ক্লাসে ভর্তি। শেষে লিখলো দুই মেয়ে ভর্তির জন্য ১ মাসের বেতনের চেয়েও একটু বেশি অর্থ প্রয়োজন।
তাই মনে হলো, সত্যিই বড়দিনের মাস অনেক আনন্দের। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আনন্দের। এটা ত্যাগস্বীকার এবং আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার আনন্দ। দিতে পারাটা যে কতো আনন্দের, তা যে দিয়েছে, সে জানে। আমরা অনেক টাকা উপহার দেই, অনেক কিছুই উপহার দেই। কিন্তু যারা স্বচ্ছল, তারা যদি অন্তত একটা পরিবারকে গিয়ে তাদের হাতে দশটা হাজার টাকা দিয়ে বলে, তোমার সন্তানকে ভর্তি করাবে, ও যেন মন দিয়ে পড়ে, তাহলে সেটাই সবচেয়ে বড় ‘বড়দিন’ হতো। এভাবে স্বচ্ছলরা একটা করে সহযোগিতার হাত বাড়ালে আমার মনে হয়, কোনো পরিবারে বড়দিনের আনন্দের ঘারতি পরবে না।
সব শেষে বাবার বলা একটা কথা মনে পড়ছে। বাবা বলতেন, ‘ভাল মানুষ গায়ে লেখা থাকে না, মানুষ ভালও হয় না। মানুষের মনটা ভাল হলেই সে ভাল মানুষ হয়। আর যে মানুষটা টাকার মায়া না ছাড়তে পারবে, সে কোনোদিনও ভাল মানুষ হতে পারবে না।’