শিরোনাম :
শতকরা এক ভাগেরও কম ঋণখেলাপি যে সমিতিতে
|| সুমন কোড়াইয়া ||
ব্যাংক ও সমবায় সমিতিগুলোতে যখন ঋণলেখাপি মাথা ব্যথার কারণ, তখন উদাহরণ হয়ে দাঁড়ালো দি মর্নিং স্টার কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি:। এই সমিতিতে এক ভাগেরও কম সদস্য ঋণ খেলাপি। সমিতিটিতে রয়েছে ছয় হাজার সদস্য, সবাই নারী। তাঁদের মধ্যে তিন হাজার সদস্য উৎপাদনমূখী ঋণ নিয়েছেন। তাঁদের ৯৯ ভাগের বেশি সদস্যই নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন। কীভাবে সম্ভব হলো এটি? সমিতির প্রধান নির্বাহী আলফন্স পংকজ গমেজ আজ ডিসিনিউজকে বলেন, ‘আমাদের সমিতিতে প্রতি ৪০০ জনের জন্য একজন মাঠকর্মী আছেন। তিনি প্রতিদিন অফিসে এসে যাঁরা ঋণ নিয়েছেন তাঁদের তালিকা নিয়ে ঋণ গ্রহণকারীদের বাসায় বাসায় গিয়ে বর্তমান মাসের ঋণের কিস্তি, সুদ, শেয়ার ও সঞ্চয়ের টাকা ফেরত/জমা দেয়ার জন্য তাগাদা দেন। এভাবে ঋণ গ্রহণকারীরা প্রতিমাসে ঋণ ফেরত দেন।’
তিনি আরো বলেন, আমাদের রয়েছে শক্তিশালী মনিটরিং বিভাগ। সেখান থেকে সকল কাজ সঠিকভাবে মনিটরিং করা হয়। বিশেষভাবে যাঁরা ঋণ নিয়েছেন, তাঁরা তা সময় মতো দিচ্ছেন কিনা তা সফটওয়্যারে দেখা হয় এবং কর্মীদের সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
মাঠকর্মী অনিতা কস্তা এই সমিতিতে সেবা দিচ্ছেন ২৭ বছর ধরে। তিনি ডিসিনিউজকে বলেন, ‘কোনো সদস্যকে ঋণ দেওয়ার আগে তাঁর আয় কত, সংসারের খরচ কত, সন্তান কতজন ইত্যাদি খোঁজ নিয়ে থাকে। আয় ও ব্যয় করার পর ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারবে বুঝতে পারলেই আমরা তাঁকে ঋণ দিই। মাসের যে তারিখে ঋণ দেওয়া হয়, পরের মাসের ঠিক সেই তারিখের মধ্যে ঋণের টাকা ফেরত দিতে হয় আমাদের সদস্যদের। সেই অনুসারে আমরা ঋণ গ্রহণকারী সদস্যদের ঋণ ফেরত দেওয়ার জন্য তাগাদা দেই।’
একজন মাঠ কর্মী প্রতিদিনের দায়িত্ব
সমিতির প্রধান নির্বাহী আলফন্স পংকজ গমেজ বলেন, ‘আমাদের মাঠকর্মীরাই ঋণলেখাপি রোধ করতে মূল ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা সদস্যদের বাসায় বাসায় যান, ফোন করেন। পরামর্শ দেন। মাঠকর্মীর সাথে আন্তরিক সম্পর্ক থাকে সদস্যদের। আমাদের মাঠকর্মীরা সদস্যদের সমিতির নিয়ম-কানুন বুঝান তাদের ভালোর জন্যই করা হয়েছে। আমাদের সদস্যরাও সেটা অনুধাবন করেন।’ তিনি আরো বলেন, একজন মাঠকর্মী প্রতিদিন অফিসে এসে তাঁর দলের সদস্যদের সাথে দেখা করেন। বিশেষ করে যাঁদের কিস্তি দেওয়ার কথা, তাঁদের সেটা মনে করিয়ে দেন। আগামী দিনের মাঠ পরিদর্শনের তালিকা তৈরি করেন এবং ফিল্ড কো-অডিনেটরকে তা দেখান। প্রতিজন মাঠকর্মীকে প্রতি মাসের জন্য লক্ষ্যমাত্রা দেয়া থাকে এবং সেই অনুয়ায়ী তিনি (মাঠকর্মী) কাজ করেন। মাস শেষ হলে তাঁর দলের কোন কোন সদস্য কিস্তি দেন নাই বা কিস্তির টাকা কম দিয়েছেন, এই ধরনের নানা তথ্যসহ প্রধান নির্বাহীর বরাবর প্রতিবেদন তৈরি করেন।
হাজারো নারীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন
নাজমা আক্তারের (৪৫) কাপড়ের দোকান আছে মগবাজারে। তিনি ২২ বছর আগে এই সমিতির সদস্য হন। প্রথমে ছোট ছোট ঋণ নিয়ে দোকান না নিয়েই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপড় বিক্রি করতেন। পরে বড় ঋণ নিয়ে তিনি দোকান দেন। দোকানে নারীদের কাপড় বিক্রি করেন। তিনি ডিসিনিউজকে বলেন, ‘দি মর্নিং স্টার কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি: আমার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে। এই সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে আমি সংসার চালাই। আমার ছেলেমেয়েরা কলেজে লেখাপড়া করছে।’
সালমা আক্তার বর্ষা আরেক সফল সদস্য এই সমিতির। তিনি মগবাজারে নিজে কাপড়ের দোকান দিয়েছেন। পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তিনি নিজের বাড়িও তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই সমিতি আমার জীবনের জন্য আশির্বাদস্বরূপ।’ সালমা, নাজমার মতো ছয় হাজার সদস্য রয়েছেন এই সমিতিতে। তাদের তিন হাজার সদস্যই উৎপাদনমুখী ঋণ নিয়েছেন এবং নিয়মিত কিস্তির টাকা ফেরত দিচ্ছেন।
[wp1s id=”10730″]
এই সমিতির প্রোডাক্ট বা সেবাসমূহ
শেয়ার, সঞ্চয়, ঋণ, ক্ষুদ্র বীমা, স্বেচ্ছামূলক সঞ্চয়, শিশু সঞ্চয়, দি মর্নিং স্টার গ্রামার স্কুল, সদস্যদের চক্ষু চিকিৎসা ও চশমা প্রদান, স্কলারশীপ প্রোগ্রাম।
ইতিহাস
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের আর্থিক সহযোগিতায় ‘ফ্যামিলি টু ফ্যামিলি সেন্ট ভিনসেন্ট ডি’পলস সোসাইটি’ সেবা কাজ শুরু করে। তখন রমনা থানাধীন মগবাজার এলাকায় দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ব্যয় মেটানোর জন্য আর্থিক সহয়তা দেয়া, দরিদ্র মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া ও দরিদ্র মায়েদের স্বনির্ভর করার জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম করার জন্য তৎকালীন চেয়ারম্যান আলেকজান্ডার রোজারিও বুঝতে পারেন যে, এই সকল সেবা কার্যক্রম এবং বিদেশী দাতা সংস্থার অর্থে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সত্যিকারের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে না। তাই তিনি তাঁর ক্রেডিট ইউনিয়ন আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ হতে মগবাজার এলাকায় দরিদ্র মায়েদের নিজেদের অর্থ সঞ্চয় করার মাধ্যমে এবং ওই সঞ্চিত অর্থ থেকে প্রয়োজন মতো ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা করার মাধ্যমে নিজেদের আয়ের সংস্থান করতে পারে তা অনুভব করেন।
এই উদ্দেশ্যে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ হতে ওই সকল দরিদ্র মায়েদের সঞ্চয়ের অভ্যাস করানোর জন্য একত্রিত হতে বলেন এবং সঞ্চয়ের শিক্ষা দেয়া শুরু করেন। প্রথম দিকে মগবাজার এলাকার দরিদ্র নারীরা প্রতিদিন ৫০ পয়সা করে সঞ্চয় করতেন এবং মাসে ১৫ টাকা সঞ্চয় করতেন। এরপর এক বছর পর ৩০০ টাকা নিয়ে নিজেদের সামর্থ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন ও প্রতি মাসে ঋণের কিস্তি ও স্বল্প পরিমাণ সুদসহ ফেরত দিতে থাকেন। বর্তমানে এই সমিতির সর্বনি¤œ শেয়ার ও সঞ্চয়ী জমা ১০০ টাকা করে। এক সময় ওয়ার্ল্ড ভিশনের ফান্ড বন্ধ হলেও সমিতির কার্যক্রম চলতে থাকে।
সমিতিতে ৪৩ জন কর্মীর মধ্যে ৩৩ জন কর্মীই নারী। এই সমিতির সম্পদ-পরিসম্পদের পরিমাণ ৩৩ কোটি টাকা।