ঢাকা ,
বার : মঙ্গলবার
তারিখ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা দেশ ২০১৯ সালের সার্বিক মানবাধিকার-পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক: আসক

২০১৯ সালের সার্বিক মানবাধিকার-পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক: আসক

0
659

২০১৯ সালের মানবাধিকার-পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মানবাধিকারের প্রধান দুটি সূচকের একটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় অগ্রগতি অব্যাহত থাকলেও মানবাধিকারের আরেকটি সূচক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।
দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গড় আয়সহ বিভিন্ন সূচকের আলোকে তৈরি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে এক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সম্ভাবনা, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা এই চারটি সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক জেন্ডার বৈষম্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারী-পুরুষের জেন্ডার সমতার মানদণ্ডে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে দীর্ঘ ২০ বছর পর ২০১৯ সালে জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী সনদের আওতায় প্রতিবেদন পেশ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
এসব সত্ত্বেও ২০১৯ সালের সার্বিক মানবাধিকার-পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। বিগত বছরগুলির ধারাবাহিকতায় এ বছরেও অব্যাহত ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মতো ঘটনা। ২০১৯ সালে গুমের অভিযোগের সংখ্যা কিছুটা কমে এলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধ/গুলি, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুসহ গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে বছর জুড়ে। গত বছরের (২০১৮) মে মাস থেকে শুরু হওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানকে কেন্দ্র করে ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা ২০১৯-এ অব্যাহত ছিল। অন্যদিকে দেশের সীমান্ত এলাকাগুলোতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলি ও নির্যাতনে অনেক বাংলাদেশী নাগরিকের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাসমূহ ছিল ২০১৯ সালের অন্যতম একটি উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নির্যাতন ও হত্যার মতো ঘটনার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। এছাড়া শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, বলাৎকার ও হত্যাসহ শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বছর জুড়ে।
মতপ্রকাশের অধিকারের ক্ষেত্রেও চলতি বছরের চিত্র ছিল উদ্বেগজনক। সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের ব্যাপক সমালোচনার মধ্য দিয়ে পাশ হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এ সাংবাদিকসহ অনেক সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা ও হয়রানির ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে এ বছরে। অন্যদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে বছরের বিভিন্ন সময়ে। এছাড়া সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য জাতিসত্তার ওপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনাও প্রত্যক্ষ করা গেছে ২০১৯ সালে।
এ বছর রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম ঘটলেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল বরাবরের মতোই উদ্বেগজনক। বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে ‘ছেলেধরা’ গুজবকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন অনেক নিরীহ মানুষ।
খুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত জুট মিলগুলোর বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে অনশনরত শ্রমিকদের মধ্যে দুই শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এছাড়া অনিরাপদ ও ঝুকিপূর্ণ কর্মপরিবেশের কারণে বিভিন্ন কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শ্রমিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বছরের বিভিন্ন সময়ে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এ বছরেও নারী অভিবাসী শ্রমিকসহ বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকরা সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গিয়ে শারীরিক-মানসিকসহ নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বিগত বছরের মতো এ বছরেও চিকিৎসা ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনাসহ চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, ত্রুটি এবং চিকিৎসা না পেয়ে রোগীর ভোগান্তি ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিম্নবিত্ত ও ছিন্নমূল মানুষের বাসস্থান (বস্তি) উচ্ছেদ এবং বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের অনেক ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শ্রমিক, পথচারী ও সাধারণ মানুষসহ নিহত হয় মোট ৭১ জন।
১ অক্টোবর ২০১৯ তারিখ হতে কার্যকর হওয়া সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৪১(১) ধারা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণের আগে ওই কর্মচারীকে গ্রেফতার করতে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আইনের এ ধারাটি বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, কেননা সংবিধান অনুযায়ী কোনো বিভাজন বা বৈষম্য ব্যতিরেকে প্রতিটি নাগরিককে সমান অধিকার প্রদান করা হয়েছে। সরকারি চাকরি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাটি ন্যায়বিচার প্রাপ্তি ও দুর্নীতিরোধে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার সম্ভাবনাকে প্রবল করে তুলতে পারে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতায় নিরাপরাধ জাহালম তিন বছর কারাভোগের পর গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে কারাগার থেকে মুক্তি পান। উল্লেখ্য সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। কিন্তু দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার ভুলে সালেকের বদলে টাঙ্গাইলের জাহালমকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে।
এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৩ এপ্রিল ও ৫ মে ফেনীর সাংসদ নিজাম হাজারী ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ফেনী জেলা কারাগারে প্রবেশ এবং কারাবন্দী যুবলীগের দুই নেতাকে হুমকি দেয়ার অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

২০১৯ সালের মানবাধিকার-পরিস্থিতির বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত বিবরণ

১. বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সময়ের প্রতিশ্রুতি এবং দেশের রাজনৈতিক দলসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ সত্ত্বেও অব্যাহত রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। বরাবরের মতোই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অস্বীকার করেছে সরকার। ৯ মার্চ ২০১৯ তারিখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আয়োজিত মাদক বিরোধী সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দৃঢ়ভাবে বলেন, ‘ক্রসফায়ার’ নয়, আত্মরক্ষার খাতিরেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি ছোড়ে। সরকারের দায়িত্বশীল একজন মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যে ক্রসফায়ারের মতো আইনবহির্ভূত ও অমানবিক ব্যবস্থাকে এক ধরনের স্বীকৃতি দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যা প্রকারান্তরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে মোট ৩৮৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।

১.১ ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধ/এনকাউন্টার/গুলিতে নিহত: বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আসক-এর তথ্য
সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধ/গুলিবিনিময়/এনকাউন্টারে নিহত হন ৩৫৬ জন। এর মধ্যে চলমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছেন ১৮৭ জন। এ বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত কয়েকজনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশগুলোর সঙ্গে পাওয়া যায় ‘হারকিউলিকস’ লেখা চিরকুট। তবে নিহতদের মধ্যে অন্তত দুজনের পরিবার গণমাধ্যমের কাছে দাবী করে যে, তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
আসকের তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সাতক্ষীরা সদরের মাটিডাঙ্গা গ্রামের ইব্রাহীম নামে এক দিনমজুরকে গত ৩ মে
২০১৯, বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় খুলনার ডুমুরিয়া থানা এলাকায়। ওইদিনই দিবাগত রাতে ডুমুরিয়ার থুকরা গ্রামের কামরুল ইসলাম গাজীর বাড়িতে র‌্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ মারা যান ইব্রাহীম। এ বিষয়ে ডুমুরিয়া থানায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে দায়েরকৃত মামলায় উক্ত বাড়িতে ডাকাতি করার সময় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ইব্রাহীম নিহত হওয়ার কথা বলা হলেও নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ক্রসফায়ারের নামে হত্যার অভিযোগ করা হয়েছে।
গত ২৮ জুন দিবাগত রাতে কুমিল্লা শহরের পুরাতন চৌধুরী পাড়ার মোগলটুলী এলাকার বাসিন্দা প্রশান্ত কুমার
দাস নামে এক স্থানীয় ভিডিওগ্রাফার বিজিবি’র গুলিতে নিহত হন। নিহতের পরিবার দাবি করেন, প্রশান্ত মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন না। বিজিবি তাকে আটকের পর নির্যাতন করে মেরে ফেলার পর বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়েছে। কুমিল্লা সদর থানার পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, নিহত প্রশান্তের বিরুদ্ধে মাদক কিংবা অন্য কোনো অভিযোগে থানায় মামলা ছিল না।
এছাড়া ১২ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাওয়ের সীমান্ত এলাকায় বিজিবির গুলিতে নিহত হন ৩ জন গ্রামবাসী। ১৪ অক্টোবর বান্দরবানের নাইখ্যাংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বিজিবি’র গুলিতে প্রাণ হারান দুইজন।

১.২ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু: জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কমিটির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের সুপারিশে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর বিষয়ে বললেও বাস্তবে এ ধরনের ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আসক-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে (গ্রেফতারের পর) ১৪ জন মারা যান। এছাড়া গ্রেফতারের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে মারা যান ৬ জন এবং গুলিতে নিহত হয়েছেন ১২জন। অন্যদিকে এ বছর দেশের কারাগারগুলোতে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা যান ৫৮ জন।
আসকের তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ থানা হাজতে গত ১০ আগস্ট মোঃ আল মামুন
নামে এক তরুণের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। থানা হাজতের মধ্যে গলায় ফাস দিয়ে মামুন আত্মহত্যা করেছে বলে কিশোরগঞ্জ থানা পুলিশ দাবী করলেও নিহতের পরিবার ও স্বজনেরা আল মামুনের মৃত্যুর ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলে দাবী করেছে। মামুনের মৃত্যুর ঘটনায় কিশোরগঞ্জ থানায় অপমৃত্যুসংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আসকের তথ্যানুসন্ধানকালে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, ঘটনার সময়ে থানার সিসি ক্যামেরা নষ্ট ছিল।
২৬ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে পঞ্চগড় জেলা কারাগারের কারা হাসপাতালের একটি বাথরুমে আগুনে দগ্ধ হন আইনজীবী পলাশ কুমার রায়। পরে ২৭ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ এপ্রিল মারা যান পলাশ কুমার রায়। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে মানহানিকর বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় পলাশ কুমার রায় ২৫ মার্চ ২০১৯ থেকে কারাগারে বন্দী ছিলেন। এ ঘটনায় পলাশের পরিবারের পক্ষ থেকে কারা অভ্যন্তরে শরীরে আগুন লাগিয়ে তাঁকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ করা হয়েছে।
গত ২ আগস্ট অসুস্থ মায়ের দেখাশোনা করার জন্য রহিমা (ছদ্মনাম) খুলনা যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেনাপোল থেকে ছেড়ে আসা খুলনার ট্রেনে ওঠেন। এক পর্যায়ে পুলিশ রহিমাকে মোবাইল চোর সন্দেহে ট্রেন থেকে আটক করে খুলনা রেলওয়ে থানায় নিয়ে যায়। থানা হেফাজতে নেওয়ার পর খুলনা রেলওয়ে থানার ওসি ওসমান গনিসহ ৫ পুলিশ সদস্য তাকে নির্যাতনসহ ধর্ষণ করে। পরদিন (৩ আগস্ট ২০১৯) রহিমার ব্যাগে ৫ বোতল ফেন্সিডিল দিয়ে মাদকের মামলায় তাকে কোর্টে উপস্থাপন করা হয়। এ ঘটনায় রহিমা খুলনা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওসিসহ ৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন (নিবারণ) আইনে মামলা করেছেন।

১.৩ সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন: এ বছরে ভারতীয় সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকের ওপর নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বেড়েছে। অন্যান্য বছরের ন্যায় ২০১৯ সালেও আন্তর্জাতিক নীতিমালা ভঙ্গ করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ, নির্যাতনসহ হতাহতের নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বছরে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ৩৭ জন ও শারীরিক নির্যাতনের কারণে ৬ জনসহ মোট ৪৩ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। উল্লেখ্য গত বছরে এ ক্ষেত্রে মোট নিহতের সংখ্যা ছিল ১৪।
আসকের তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গত ২৭ এপ্রিল রাত আনুমানিক ১টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত বাংলাদেশী যুবক আজিম উদ্দিনকে নওগা জেলার সীমান্তবর্তী রাঙামাটি ক্যাম্পে আটক রেখে তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। বিএসএফ সদস্যরা আজিম উদ্দিনের দুই হাতের ১০টি আঙুলের নখ উপড়ে ফেলাসহ তাঁর সারা শরীরে রাইফেলের হাতল ও লাঠি দিয়ে আঘাত করে। ২৭ এপ্রিল সকালে ৬টার দিকে বিএসএফ-এর সাথে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে বিজিবি।

২. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ-গুম ও নিখোঁজ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে অপহরণ এবং পরবর্তী সময়ে তাদের নিখোজ বা গুম করার অভিযোগসংক্রান্ত অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছেÑ ভুক্তভোগীর পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীরা র‌্যাব, ডিবি পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে কাউকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করলেও সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদেরকে গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানা এসব ঘটনায় কোনো অভিযোগ নেয় না, এমনকি স্বজনরা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলেও ঘটনার সাথে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম উল্লেখ করে জিডি করতে পারেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে গুম হওয়ার অনেকদিন পর হঠাৎ করেই তাদের কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় বা ক্রসফায়ারে তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। দেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে জানা যায়, ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন ১৩ জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৫ জনের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং এখনো পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ৮ জন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদসূত্রে আসকের তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২ মে ২০১৯ তারিখে রাজধানীর তেজগাও এলাকা
থেকে নিখোজ হন সফটওয়্যার প্রকৌশলী আতাউর রহমান শাহীন। ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে কালো কাচযুক্ত একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে আতাউর রহমান শাহীনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি দেখা গেছে বলে তাঁর স্ত্রী তানিয়া আক্তার আসক তথ্যানুসন্ধান প্রতিনিধিকে জানান। এ বিষয়ে তেজগাও শিল্পাঞ্চল থানায় জিডি ও পরবর্তী সময়ে মামলা করা হয়। এরপর ৪ আগস্ট দিবাগত রাতে আতাউর রহমান শাহীন নিজ বাসায় ফেরত আসেন।
৯ এপ্রিল মাইকেল চাকমা নামে এক যুবককে সাদা পোশাকধারী কয়েকজন জোরপূর্বক নারায়ণগঞ্জ থেকে তুলে নিয়ে যায়। এখনো পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন তিনি।
১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর শেরে-বাংলা নগরস্থ ইএনটি এন্ড হেড-নেক ক্যান্সার হাসপাতালের ড্রাইভার জাহিদুল ইসলাম রিমন ডিউটি শেষে হাসপাতালে গাড়ি জমা দিয়ে বের হওয়ার সময় হাসপাতালের মূল ফটকের সামনের রাস্তা থেকে তাঁকে সাদা পোশাকধারীর কয়েকজন আটক করে সাদা রংয়ের একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। উল্লেখ্য, পাচদিন নিখোঁজ থাকার পর ২৪ সেপ্টেম্বর জাহিদুল ইসলাম রিমনকে গাজীপুর মেট্রোপলিটনের টঙ্গী (পূর্ব) থানায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

৩. নারী অধিকার-পরিস্থিতি
১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ নারীর অধিকার মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর দীর্ঘসময় পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে নারী উন্নয়নে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগতিও অর্জন করেছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীর ওপর সহিংসতাÑ বিশেষ করে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণ ঘটনার সংখ্যা, ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ২৮ এপ্রিল ২০১৯, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুন, সন্ত্রাস ও ধর্ষণের মতো মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করাসহ উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে কন্যাশিশুর সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইনমন্ত্রী, বিচারপতি ও বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানান, যা আশাব্যঞ্জক।
অন্যদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ শ্রেণীর ও নবম-দশম শ্রেণীর গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ে কিশোরীর উপযুক্ত পোশাক, আচরণ, নিরাপত্তা রক্ষায় করণীয় এবং বিভিন্ন শারীরিক গড়নের মেয়েদের যেভাবে বর্ণনা প্রদান করা হয়েছেÑ তা অত্যন্ত আপত্তিজনক, দৃষ্টিকটু এবং এটি শিক্ষার্থীদের বর্ণবৈষম্যমূলক বার্তা প্রদান করছে।

.১ ধর্ষণ: গত বছরের তুলনায় এ বছরে প্রায় দ্বিগুন সংখ্যক ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আসক’র তথ্য সংরক্ষণ
ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১৪১৩ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন মোট ৭৩২ নারী এবং ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮১৮।
এ বছরের ৩১ মার্চ উপজেলা নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করায় নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গণধর্ষণের শিকার হন ছয় সন্তানের এক জননী। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই নারী আসক তথ্যানুসন্ধান প্রতিনিধিদেরকে জানান, নির্বাচনের দিন (৩১ মার্চ) ভোট দেওয়ার পর তিনি ও তাঁর স্বামী যখন বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থক ইউসুফ মাঝির নেতৃত্বে ১০-১২ জন পথিমধ্যে তাদের থামিয়ে মারধর করে এবং ওই নারীকে পার্শ্ববর্তী কলাবাগানে নিয়ে গণধর্ষণ করে।
২ সেপ্টেম্বর যশোরের শার্শায় পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন দু’সন্তানের জননী এক গৃহবধূ। ভুক্তভোগী ওই
গৃহবধূ গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, ২ সেপ্টেম্বর রাত আড়াইটার দিকে শার্শা থানার এসআই খায়রুল, সোর্স কামরুল এবং গ্রামের আরও তিন-চারজন বাড়িতে এসে তার স্বামীর মামলার ব্যাপারে কথা বলবেন বলে জানায়। সেসময় এসআই খায়রুল তাঁর কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে বলেন, টাকা না দিলে ৫৪ ধারায় মামলা করে দেবেন। ওই নারী তখন টাকা না দিতে চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে খায়রুলসহ দু’জন তাঁকে ঘরের ভেতর নিয়ে ধর্ষণ করে।
৩.২ উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানী: এ ক্ষেত্রেও ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে ২০১৯ সালে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌন হয়রানী ও
উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ২৫৮ নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানীর শিকার হন
৪৪ পুরুষ। এ বছর উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৮ নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে
গিয়ে ৪ নারীসহ খুন হয়েছেন ১৭ জন (নারী-পুরুষ)। উল্লেখ্য ২০১৮ সালে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন মোট
১৭০ জন।
এ ক্ষেত্রে বছরের অন্যতম বর্বরোচিত ঘটনা ছিলÑ ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান ওরফে রাফিকে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা কর্তৃক যৌন হয়রানী এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর শরীরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনা। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গত ২৪ অক্টোবর অভিযুক্ত সিরাজ উদ্দৌলাসহ ১৬ আসামির প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন ফেনী জজ কোর্ট।

৩.৩ সালিশের নামে নির্যাতন: আসক-এর তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব মতে, ২০১৯ সালে সালিশের মাধ্যমে ৪ নারী নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে সালিশে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৩ নারী এবং নির্যাতন পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যা করেন এক নারী।
৩.৪ যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন: ২০১৯ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৬৭ নারী। যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ৯৬ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৩ জন। অন্যদিকে এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৪২৩ নারী।

৩.৫ গৃহকর্মী নির্যাতন ও অ্যাসিড নিক্ষেপ: ২০১৯ সালে ৩৪ নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পরবর্তী সময়ে মারা যান ১ নারী। অন্যদিকে এ বছরে অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ১৯ নারী।

৪. শিশু নির্যাতন ও হত্যা
গত বছরের তুলনায় এ বছরে শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। কন্যাশিশু ধর্ষণের পাশাপাশি ছেলে শিশু বলাৎকারের অনেক ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে ২০১৯ সালে। আসক তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাবমতে ২০১৯ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় মোট ৪৮৮ শিশু। ২০১৮ সালে নিহত শিশুর সংখ্যা ছিল ৪১৯। এছাড়া ২০১৯ সালে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ১৬৯৬ শিশু। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ১,০১১ শিশু। এ বছরে যৌন হয়রানী ও ধর্ষণের শিকার হয় ১০৮৭ শিশু, ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪৪৪। এছাড়া ২০১৯ সালে বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৩৭ ছেলে শিশু।
গত ৩০ অক্টোবর ঢাকা মহানগরের রূপনগর আবাসিক এলাকায় গ্যাস বেলুন বিক্রির সময় সিলিন্ডারটি হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়। এতে ৮ শিশুর মৃত্যু ঘটে এবং গুরুতর আহত হয়েছে ১৫ জন।
চট্টগ্রামে মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক বলাৎকারের শিকার হয়েছে ১১ বছর বয়সী এক ছেলে শিশু। গত ১৮ মার্চ ২০১৯ তারিখে শিশুটির মা মাদ্রাসায় দেখা করতে গেলে তিনি অসুস্থ অবস্থায় তার ছেলেকে দেখতে পান। এরপর শিশুটিকে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে বলাৎকারের বিষয়টি জানান।

৫. মতপ্রকাশের অধিকার
স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হলেও এ অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করার ঘটনা ঘটছে বছরের বিভিন্ন সময়ে। বিগত বছরগুলির ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালেও ভিন্নমত প্রকাশের কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক মামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতনের ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দ্বারা বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ওপর হামলা, মারধর ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভিন্নমত পোস্ট করাকে কেন্দ্র করে গত ৬ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে শের-ই-বাংলা আবাসিক হলে বেধড়ক পেটানোসহ তাঁকে অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার কিছু নেতা-কর্মী। এ ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র নিন্দা এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বুয়েট কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ২৬ শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। এছাড়া আবরার হত্যা মামলায় ২৫ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
২২ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হকসহ বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্তত ২৮ জনকে নির্মমভাবে পেটানোর ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যমতে, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ডাকসু ভবনের ভেতরে নুরুল হকের কক্ষে ঢুকে মেইন গেট বন্ধ করে নুরুল হক ও তাঁর সহযোগীদের দুই দফায় বেধড়ক পেটায়। ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক এপিএম সুহেল ও ফারাবীকে ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেয় হামলাকারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কার্যালয়ের নিকটবর্তী ডাকসু ভবনের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এই মারপিটের ঘটনা চললেও মারপিটের শেষ পর্যায়ে প্রক্টর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আহতদেরকে হাসপাতালে প্রেরণ করেন।

১৪ মে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় কবি হেনরি স্বপনকে গ্রেফতার করা হয়। অন্যদিকে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী আল-কায়েদা’র মুখপত্র বালাকোট মিডিয়ার ‘লোন উলফ’ গাইড এর মার্চ-২০১৯ সংখ্যায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, লেখক শাহরিয়ার কবির ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুনকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।

৫.১ সভা-সমাবেশে বাধাদান: বিগত বছরগুলোর ন্যায় এ বছরেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলন কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশে বাধাদান ও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
গত ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে দেশব্যাপী আয়োজিত কর্মসূচিতে বগুড়া, নোয়াখালী, কুড়িগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনসমূহের বাধা দেওয়াসহ হামলা, মারধর ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ৮ ডিসেম্বর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ লাঠিপেটাসহ গ্রেফতার করেছে দলটির অনেক নেতাকর্মীকে।
৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছরপূর্তির দিনটিকে বাম গণতান্ত্রিক জোট কালোদিবস ঘোষণা দিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে যাওয়ার সময় পুলিশ বাধা দেয়। এ ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে বাম জোটের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হন। এছাড়া সিপিবিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে পুলিশ ও সরকার দলীয় সহযোগী সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীদের বাধা প্রদান, হামলা ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হামলা ও মারধরের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে।

৫.২ সাংবাদিক নির্যাতন: বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম নিয়ে প্যারিসভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)-এর
প্রতিবেদন (এপ্রিল ২০১৯) অনুযায়ী, মুক্ত গণমাধ্যম সূচকের ক্ষেত্রে আগের বছরের তুলনায় চার ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনভাবে খবর সংগ্রহ ও তা প্রকাশের কারণে নির্যাতন, মামলা ও গ্রেফতারসহ বিভিন্ন হয়রানির শিকার
হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতন, হামলা, মামলা, হুমকি ও হয়রানিসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৪২ সাংবাদিক। এ বছরের ২১ মে অনলাইন গণমাধ্যম প্রিয়ডটকম-এর সহকারী সম্পাদক ইহসান ইবনে রেজা ওরফে ফাগুনের লাশ উদ্ধারের (রহস্যজনক মৃত্যু) ঘটনা ঘটে জামালপুর থেকে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ভুল সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে এ বছরের ১ জানুয়ারি খুলনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং তাদের মধ্যে একজনকে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি ও সাগর সারোয়ার হত্যাকাণ্ডের পর আজ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ।

৬. ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার
২০১৯ সালের বিভিন্ন সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের অনেক ঘটনাসহ আহমদীয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, মারধর ও তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে বিগত বছরগুলির মতো ২০১৯ সালে সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য জাতিসত্তার ওপর হামলা, মারধর ও ভূমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

৬.১ ধর্মীয় সংখ্যালঘু: আসক’র তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ের ৭২টি প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে এবং ৩৯টি বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের ৫১ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের ২০টি বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর বক্তব্য শেয়ার করার অভিযোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক যুবকের বিচারের দাবিতে গত ২০ অক্টোবর ভোলার বোরহানউদ্দিনে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের সাথে বিক্ষুব্ধ জনতার ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হয়। এ ঘটনার জের ধরে বোরহানউদ্দিনের ভাওয়ালবাড়ী হিন্দুপাড়ায় হামলা চালিয়ে একটি মন্দিরসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ১০টি বসত ঘর এবং একটি দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়।
আসকের তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পঞ্চগড় জেলা শহরের আহমদনগর গ্রামে ১২ ফেব্রুয়ারি আহমদীয়া জামে মসজিদে অতর্কিত হামলা করে স্থানীয় ও পার্শ¦বর্তী গ্রামসমূহের কয়েকশত লোক। হামলাকারীরা দেশীয় ধারালো অস্ত্র, লাঠি, ইট-পাথর দিয়ে আহমদীয়া মসজিদে হামলা চালায় এবং আহমদীয়া সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর ও দোকানপাট লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং গাছপালা কেটে ধ্বংস করে। এ ঘটনায় পুলিশসহ আহমদীয়া সম্প্রদায়ের ৫০ জন আহত হয়।

.২ জাতিগত সংখ্যালঘু: বিগত বছরগুলির মতো ২০১৯ সালেও সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২২ বছর পার হলেও তার পূর্ণবাস্তবায়ন হয়নি।
আসকের তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, নওগা জেলার ধামইরহাট থানার আলমপুর ইউনিয়নের কাগজকুটা গ্রামের কুমির
পুকুরপাড়ে গড়ে ওঠা স্থানীয় জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বসতিতে ২৪ মার্চ রাত ১টার দিকে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে
হামলা চালিয়ে তাদের বাড়িঘর ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। হামলাকারীদের লাঠির আঘাতে
আহত হন চার নারী।

. রাজনৈতিক সহিংসতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
এ বছর রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বরাবরের মতোই উদ্বেগজনক ছিল। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনাসহ ভোট কারচুপির অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে জঙ্গী গোষ্ঠী কর্তৃক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে ২০১৯ সালে।
আসক তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিরোধী দল এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ মোট ২০৯টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব রাজনৈতিক সংঘাতে ৩৯ জন নিহত এবং আহত হন ২৬৮৯ জন ।

২৬ জুন ২০১৯ বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে শাহ নেওয়াজ রিফাত শরীফকে। এ সময় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি হামলাকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করলেও হামলাকারীরা তার বাধা মানেনি। গুরুতর আহত রিফাত শরীফ বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

গণপিটুনি: ২০১৯ সালের অন্যতম একটি উদ্বেগের বিষয় ছিল গণপিটুনিতে অনেক মানুষের হতাহতের ঘটনা। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ‘পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে’Ñএই গুজব ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জুলাই-আগস্ট মাসে হঠাৎ করেই ‘ছেলেধরা’ আতঙ্কে সারা দেশে গণপিটুনিতে নিরীহ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা বাড়তে থাকে। প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি হতাশা থেকে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতার কারণে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। আসক’র পরিসংখ্যান অনযায়ী ২০১৯ সালে গণপিটুনির ঘটনায় মোট ৬৫ জন নিহত হয়েছেন।
২০ জুলাই রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হন তাসলিমা বেগম রেনু নামের এক নারী। তিনি উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন তাঁর শিশুসন্তানকে ভর্তি করার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন তাঁকে ‘ছেলেধরা’ বলে গুজব ছড়িয়ে স্কুলঘরে ঢুকে তাকে গণপিটুনি দেয়। এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে।

. শ্রমিক অধিকার
অন্যান্য বছরের ন্যায় ২০১৯ সালেও বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিক হতাহতের অনেক ঘটনা ঘটেছে। বেসরকারি সংগঠন ‘সেইফটি এন্ড রাইটস সোসাইটি’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে মোট ৪০০টি দুর্ঘটনায় ৫২২ জন শ্রমিক নিহত হন। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে ৪৮৪টি দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন ৫৯২ জন।
অন্যদিকে বিগত বছরগুলোর ন্যায় ২০১৯ সালেও দেশের তৈরি পোশাকখাতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি এবং বকেয়া বেতন-বোনাসসহ অন্যান্য দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে আন্দোলন অব্যাহত ছিল। এ বছরের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া খুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিলের শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে অনশনরত শ্রমিকদের মধ্যে দুই শ্রমিক মারা যান। ১১ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার হিজলতলা এলাকার প্রাইম প্লেট এন্ড প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা যায় ২২ শ্রমিক। ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুরে লাক্সারী ফ্যান কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১০ শ্রমিকের প্রাণহানি হয়।

অভিবাসী শ্রমিক: সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালেও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গিয়ে শারীরিক-মানসিকসহ নানাবিধ নির্যাতনের সম্মুখীন হন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া নারী শ্রমিকরা। এ বছরে বহু সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক যৌন নির্যাতন ও শারীরিক, মানসিকসহ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে নারী শ্রমিকসহ অনেক অভিবাসী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে।

৯. স্বাস্থ্যের অধিকার
দেশের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ২০১৯ সালের আলোচিত বিষয় ছিল ভয়াবহ আকারে ডেঙ্গুজ্বর ছড়িয়ে পড়া এবং এর প্রকোপে অনেক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা। তবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রথমদিকে সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি এবং এডিস মশা দমনে ব্যর্থতা থাকলেও শেষ অবধি ডেঙ্গু চিকিৎসায় বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। বিশেষ করে ডেঙ্গু রোগ শনাক্তের পরীক্ষায় সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাাতলে একই ফি নির্ধারণ এবং চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও বিগত বছরগুলোর মতো ২০১৯ সালেও দেশের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, ত্রুটি এবং চিকিৎসা না পেয়ে রোগীর মৃত্যুসহ ভোগান্তির অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কেনাকাটায় অনিয়ম, দুর্নীতি, ভেজাল ওষুধ বিক্রিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
আসকের তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, প্রসব বেদনা নিয়ে গত ২০ আগস্ট রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন আফরোজা বেগম। সন্তান জন্মদানের পরবর্তীতে প্রসূতির শরীরের ভেতরে সুই রেখেই অস্ত্রোপচারের স্থান সেলাই করে রিলিজ দেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। পরবর্তী সময়ে অবস্থা সংকটাপন্ন হলে এক্সরে রিপোর্টে প্রসূতির শরীরে সুইয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায় এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সুইটি অপসারণ করা হয়।

১০. বাসস্থানের অধিকার
পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়া বস্তি উচ্ছেদ না করা সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং বস্তি উচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও বছরের বিভিন্ন সময়ে বস্তি উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে।
গত ১৪ মার্চ শ্যামলী ২নং রোডের কাজী অফিস সংলগ্ন টং বস্তিতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি মিরপুরের ভাষানটেক এলাকায় ধামালকোট, লালাসরাই, কাজলেরটেক, সৌখিন রোড এবং নীরব রোড বস্তিতে কোন প্রকার নোটিশ ছাড়াই উচ্ছেদ অভিযান চালায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। ২৭ ফেব্রুয়ারি, দিবাগত রাত ১টার দিকে ভাষানটেক ৩ নম্বর রোডের আবুলের বস্তি এবং জাহাঙ্গীরের বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুড়ে যায় বস্তিবাসীদের প্রায় ৪ শত ঘর। এ ঘটনায় আবুলের বস্তির নীচে ডোবা (জলাশয়) থেকে ৩ শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
আসক-এর তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৬ আগষ্ট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরস্থ চলন্তিকা বস্তি, ৭ নম্বর ঝিলপাড় বস্তি ও আরামবাগ বস্তিতে। আগুনে পুড়ে যায় তিনটি বস্তির প্রায় ৩০০০ ঘর। এই বস্তির বিষয়েও মহামান্য হাইকোর্টের রিট মামলার প্রেক্ষিতে বস্তির স্থিতাবস্থা বজায় রাখার বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। তথাপি অগ্নিকাণ্ডের পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীরা তাদের ঘর পুননির্মাণ করতে চাইলেও তাদেরকে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও প্রশাসন বাধা দিয়েছে বলে গণমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে।

আসক-এর সুপারিশ
মানবাধিকার রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়নও সরকারের দায়িত্ব। জাতি, ধর্ম, শ্রেণী নির্বিশেষে সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও সম-অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। এই প্র্রেক্ষিতে আসকের সুপারিশসমূহ নিম্নরূপ:

১. রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাÑ বিশেষত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত এবং সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ। এ পর্যন্ত সংঘটিত সকল গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
২. মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা; তথা কোনো ধরনের ভয়ভীতি কিংবা প্রতিহিংসার শিকার হওয়া ছাড়াই নাগরিকের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করা। গণমাধ্যম ও নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা।
৩. নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতা বন্ধে কার্যকর সচেতনতামূলক ও প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি জোরদার করা।
৪. রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য জাতিসত্তা, প্রতিবন্ধী, দলিত, তৃতীয় লিঙ্গ, অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও চা বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের সমান অধিকারের প্রয়োগ নিশ্চিত করা। সকল ধর্মের নাগরিকদের নিজস্ব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও রীতি চর্চার অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৫. জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেন স্বাধীনভাবে তাদের ম্যান্ডেট বাস্তবায়ন করতে পারেÑ সে ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা ও গুরুত্বারোপ করা।

(দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।) (বিজ্ঞপ্তি)