শিরোনাম :
জগদীশের শেষ ইচ্ছা
১৯৭৪ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে অর্থ বিভাগে যোগদান করি।
প্রথম দিন পরিচয় পর্বে অর্থ পরিচালক মহোদয় বললেন-
– বলেন তো, আমরা কিসের সেল করি?
– আমরা সবাই একসাথে বললাম, টিকেট সেল করি।
– তিনি স্মিতহাস্যে বললেন, যথার্থই বলেছেন, আমরা টিকেট সেল করি বটে। কিন্তু টিকেট সেলের মধ্যেই সব কিছু শেষ হয়ে যায়না। প্রকৃত অর্থে আমরা যা সেল করি তা হলো “সেবা”। তিনি বিস্তারিত বললেন, যাত্রী সেবার মাধ্যমে, আমরা আমদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কিভাবে পালন করে থাকি। যাত্রীদের টিকেট কাটার পর থেকে, নিরাপদে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার সেবায় আমরা সর্বদা নিয়োজিত।
আজো সে কথাগুলো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। তাই যখন ঢাকা ক্রেডিট ইউনিয়নের পরিচালক মন্ডলীর কণিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হই, তখন সর্বদা চেষ্টা করতাম কিভাবে এই সেবামূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সদস্যদের সেবা দেয়া যায়। বলাবাহুল্য, এই উপযাজক হয়ে সেবা দিতে গিয়ে অনেক সময় কড়াকথা শুনেছি, অপমানিত হয়েছি, আবার কখনো কখনো ভালবাসা ও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছি।
এমনি একদিনের ঘটনা, সে সময়ে তেজগাঁও কমিউনিটি সেন্টারের দোতলায় ঢাকা ক্রেডিটের অফিস। প্রায় প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ক্রেডিট অফিসে যেতাম। অন্যান্য দিনের মত অফিস থেকে ফিরে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলাম। বারান্দায় একটি ছোট রুমে সমবার্তা সম্পাদকের অফিস। আমি সমবার্তার সম্পাদক হিসেবে, মাঝে মাঝে ওখানে বসে সম্পাদকীয় কাজ করে থাকি। রুমের সামনে সদস্যদের বসার জন্য একটা বেঞ্চ পাতা। রুমে ঢোকার পথে একজন সদস্যর উত্তেজিত কন্ঠের কতকগুলো, বাঁকাবাকা কথা আমার কানে এলো, বই বন্ধ করে দেবো, প্রয়োজনে সময় ঋণ না পেলে কি লাভ বই রেখে? ইত্যাদি নানা কথা তিনি রাগান্বিত ভাবে বলে যাচ্ছেন। এমনকি পক্ষপাতিত্বের প্রশ্ন তুলে নেতৃবৃন্দকে অভিযুক্ত করছেন। আমি থমকে দাঁড়ালাম, কাছে এসে শান্ত কন্ঠে বললাম-
– কি হয়েছে ভাই? আমি কি আপনাকে কোন ভাবে সাহায্য করতে পারি? তখন ঢাকা ক্রেডিটে ডানিয়েল কোড়াইয়া, খ্রীষ্টফার গমেজ, সুবাস সেলেষ্টিন রোজারিওদের মতো রথি-মহারথী থাকতে আমার মতো চুনাপুঁটি সাহায্য করতে চাচ্ছে? ভদ্রলোক হয়ত ভাবলেন,
“ হাতি ঘোড়া গেল তল
মশা বলে কত জল।”
তিনি তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন,
– আপনি আর কি করবেন? আপনারা সবাই এক।
– স্মিতহাস্যে বললাম, আসেন আমার রুমে, চেষ্টা করে দেখি কোন সাহায্য করতে পারি কিনা। আসতে চায়না, বোধয় আমার কথায় বিশ্বাস হচ্ছেনা। একান্ত অনিচ্ছা সত্বে উঠে এলেন। প্রদীপকে চা দিতে বললাম। সমস্ত কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম এবং লোন ফরম ও পাশ বইগুলো দেখলাম। লোন ফরমে লালকালি দিয়ে ক্রেডিট কমিটি যে সমস্ত মন্তব্যগুলো করেছে তা যথার্থই। তখন ঢাকা ক্রেডিটে কিছুটা রক্ষণশীল নেতৃত্ব, সকল নিয়ম-নীতি কঠোর ভাবে মেনে চলা হয়। অনেকগুলো সমস্যা তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। তার মধ্যে ক্রশ সিউরিটি, শেয়ার ব্যালেন্স কম, স্থায়ী ভাবে বিদেশ যাচ্ছে, পরবর্তীতে কে ঋণ পরিশোধ করবে ইত্যাদি। ভদ্রলোকের নাম জগদীশ মন্ডল, একটি বিদেশী সাহায্য সংস্থায় চাকরি করেন। স্বপরিবারে কানাডা যাওয়ার ভিসা পেয়েছেন। ভিসার মেয়াদ থাকতে থাকতেই কানাডা পাড়ি জমাতে হবে। এ স্বল্প সময়ে লোন না পেলে টিকেট কাটবেন কিভাবে?
– বললাম, কর্মকর্তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, তাঁরা নিয়ম অনুযায়ী কাজ করেছেন, এখানে পক্ষপােিত্বর কোন অবকাশ নেই। তবে সম্ভাবনা একদম ফুরিয়ে যায়নি। বিমানে চাকরির সুবাদে বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সির সাথে আমার ভাল সম্পর্ক ছিল। তাকে বললাম-আবার নতুন করে লোন ফরমটি ঠিক করে জমা দিতে সময় লাগবে। আমি নাম মাত্র কমিশনে আপনার টিকেটের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বুকিং এর সময় কোন টাকা লাগবেনা, কাল সকালে পাসপোর্ট নিয়ে মতিঝিল ট্রাভেল এজেন্সিতে যাবেন। ওরাই সব ব্যবস্থা করে দেবে। ঋণ তুলে টিকেট কাটলেই চলবে। জগদীশের সামনেই এজেন্সিতে ফোন করে চারটি টিকেট বুকিং দিলাম। আবার নতুন লোন ফরম এনে সহকর্মীদের বলে কিছু সিউরিটি যোগাড় করে দিলাম। আমি আন্ডার টেকিং দিলাম, ভদ্রলোক নিয়মিত ভাবে ঋণ পরিশোধের হলফনামা সই করে দিলেন। এত সহজে সবকিছু সমাধান হয়ে যাওয়াতে, তার চোখ ছানাবড়া। যেন বিশ্বাসই হচ্ছেনা, ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিল।
ভুলেই গিয়েছিলাম তার কথা। একদিন সন্ধ্যা বেলা ড্রইং রুমে বসে চা খাচ্ছিলাম, কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখি এক প্যাকেট মিষ্টি হাতে, জগদীশ দা ও বৌদি দাঁড়িয়ে আছেন। সাদরে ঘরে ভেতরে নিয়ে এলাম! বিগলিত হয়ে বললেন,
– কাল বিকেলের ফ্লাইটে চলে যাচ্ছি। কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে কিভাবে যাই।
– বললাম, আমার সুযোগ ছিল তাই সাহায্য করতে পেরেছি। আমার তো দেশ বিদেশ ঘোরার নেশা, যদি সুযোগ পাই তবে অবশ্যই কানাডা ঘুরতে যাব। তিনি খুশি হলেন এবং সব সময় যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলেন।
দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। আমি বদলি হয়ে বোম্বে চলে এলাম। সেখানে চার বছর কাজ করে আবার ঢাকা এয়ারপোর্ট অফিসে ফিরে এলাম এবং ২০০১ সনে স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য কানাডা পাড়ি জমালাম। আমি ও আমার সহধর্মীনি মুক্তা টরেন্টো ভিক্টোরিয়া পার্কের একটি এপার্টমেন্টে থাকতাম। আমরা দু’জনেই সকাল-সন্ধ্যা চাকরি করি। তখন ছেলে সৈকত আমেরিকার সিয়াটলে পড়াশোনা করে আর মেয়ে মিঠু স্বামীসহ থাকে কানেটিকাটে। আমাদের নির্ভাবনার জীবন। প্রতিদিন অফিস ছুটির পর পাঁচ মিনিটের পথ হেঁটে কেনাকাটা বা বৈকালিক সময় কাটানোর জন্য ড্যানফোর্থ আসি। ড্যানফোর্থ এলে মনেই হয়না কানাডাতে আছি। মনে হবে ফার্মগেইট ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। চারিদিতে সারিবদ্ধ ভাবে বাঙ্গালী দোকান, বাংলা লেখা সাইন বোর্ডগুলো দেখলে গর্বে বুক ভরে যায়। এখানে বাঙ্গালীরা আসেন তাদের নিত্যদিনের কেনাকাটা করতে। চাল-ডাল, পান-সুপারি, মাছ-মাংস, শাক-সবজি, মশলা থেকে শুরু করে এমন কোন বাঙ্গালী পদ নেই যা এখানে পাওয়া যায়না। সত্যিই প্রাণ জুড়িয়ে যায় যখন হাজার হাজার মাইল দূরেও সহজে বাংলার মুখ দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটি কাপড়ের দোকানে থরেথরে সাজানো রঙ্গিন পোষাক-আশাকের মনোরম ডিসপ্লে। লেটেস্ট ডিজাইনের পাজামা-পাঞ্জাবি, শাড়ি-সালোয়ার কামিজ, ফতুয়া, টিপ-টুপি, রেশমি চুড়ির বাহার দেখলে ভিরমি খেতে হয়।
এদেশীয় কায়দায় কিছু কিছু জিনিসের গায়ে লেখা Buy one & get one free. আছে দেশী মুখরোচক খাবারের রেস্তোরা ও মিষ্টান্ন ভান্ডার, রসনাকে তৃপ্ত করার জন্য। সাধারণত: বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ড্যানফোর্থের বাঙ্গালী রেস্তোরাগুলো জমজমাট আড্ডায় মেতে থাকে। সবকিছু দেখেশুনে মনে হবে এরা বাংলাদেশের কোন হোটেলে বসে দিব্বি আড্ডা দিচ্ছে। আর বাঙ্গালীর আড্ডা মানেই তো স্বভাবসুলভ মেজাজের দেশ-বিদেশের নানা রাজনৈতিক আলোচনা-পর্যালোচনা ও অভিজ্ঞ মতামত। এসব আড্ডায় বসলে আর হুশ থাকেনা যে সময় কতো দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। বাঙালী মাত্রই সংগঠন প্রিয়। দু’তিন জন বাঙ্গালী একত্রিত হয়ে ঝটপট নতুন একটি সংগঠন দাঁড় করিয়ে ফেলে। ফলে প্রচুর সংগঠন গড়ে উঠেছে। তবে সংগঠনগুলো নিজেদের আঞ্চলিক নানা সাংগঠনিক কর্মকান্ড নিয়ে ব্যস্ত। আছে নানা রাজনৈতিক দল এরাও নিজ নিজ সমর্থিত দলের নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে। যেহেতু দল আছে তাই দলাদলিও আছে। প্রায়ই বাঙ্গালী সাপ্তাহিত পত্রিকায় একে অপরকে বহিস্কারের বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে। উকিলের পরামর্শের জন্য রয়েছে বেশ কিছু “ল” অফিস। তাই বাঙ্গালীদের নানা কাজকর্ম সারতে ড্যানফোর্থ আসতেই হয়।
আমরা অন্য মনস্ক হয়ে হাঁটছিলাম, হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে জাপটে ধরলো, চমকে ফিরে দেখি জগদীশ দা ও রুনু বৌদি। উভয়েরই বেশ বয়স হয়ে গেছে। জগদীশদার চেহারার তেমন কোন পরিবর্তন দেখলাম না, চুলে পাক ধরেছে, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা। কিন্তু বৌদির সে লাবণ্য নেই, বয়সের তুলনায় অনেকটা ম্রিয়মান হলো। সেই সদা হাসি মাখা মুখটি উধাও। কিছুতেই ছাড়লেন না, বললেন, অনেক কথা জমা পড়ে আছে। স্কারবোরো এভিনিউতে বাড়ি কিনেছেন। গাড়িতে দশ মিনিটের পথ। সাপ্তাহিক ছুটি ছিল, আপত্তি করলাম না। সুন্দর বাড়ি, দামী আসবাপত্র দিয়ে সাজানো গোছানো। বড় বড় চারটি বেড রুম, তিনটি ফুলবাথ এবং বড় কিচেন। Back Yeard টা চমৎকার, সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত। ঠিক মাঝখানে গোলাকার একটি গোলাপের বাগান। নানা জাতের গোলাপ ফুল ফুটে আছে। বাগানের মধ্যখানে কয়েকটি চেয়ারপাতা এবং রোদ বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে একটি বিরাট ছাতা। আমরা সবাই সেখানে বসলাম।
শুরু হলো গল্প। গল্পের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই তাদের কথা, আমরা নিরব শ্রোতা মাত্র। কানাডাতে এসে প্রতিষ্ঠা পেতে প্রথম প্রথম তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তাড়াহুড়া না করে পরিকল্পিত পথে হেঁটেছেন। হুট করে কোন সিদ্ধান্তে না ঢুকে, নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে, জগদীশদা একবছর ট্রেনিং নিয়ে স্থানীয় হসপিটালে এক্সরে ডিপার্টমেন্টে চাকরি পান। রুনু বৌদি টিচারর্স ট্রেনিং নিয়ে একটি এলিমেন্টরি স্কুলে টিচিং করেন। আজ তারা অবসর জীবন-যাপন করছেন। দুই ছেলে পিটার ও পল। দুজনেই ডাক্তারী পাশ করে, বিয়ে-সাদি করে একজন থাকে মন্ট্রিয়াল অপরজন ইতালি। বললেন, ঢাকার ঠিকানায় অনেক চিঠি দিয়েছি যোগাযোগ রক্ষার্থে কিন্তু কোন উত্তর পাইনি। বললাম সে সময়ে আমি বদলী হয়ে বোম্বে চলে গিয়েছিলাম যার জন্য চিঠিগুলো পাইনি। বৌদি হঠাৎ ধরা গলায় বললেন, জানো ভাই, অনেক স্বপ্ন নিয়ে সমস্ত আত্মীয়স্বজন ছেড়ে, দেশের মায়া ত্যাগ করে এদেশে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম, সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করবো। আমাদের স্বপ্ন যখন পুরণের পথে সে সমসয় সব কিছু ভেঙ্গে চুড়মার হয়ে গেল। প্রচুর অর্থ হয়েছে। স্বাচ্ছন্দের প্রতিটি দ্বার আজ আমাদের জন্য উপযুক্ত। কিন্তু মনে শান্তি নেই, মনে হয় সব বৃথা।
বড় ছেলে পিটার ডাক্তারী পড়তো। থাকতো মন্ট্রিয়াল। পাশ করার পর ওখানেই প্র্যাকটিস করতো। একদিন এক বৃটিশ মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে হাজির, বীরদর্পে বললো, বাবা-মা এ তোমাদের পুত্রবধু। আমরা কোর্টে রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে করেছি। মেয়েটির নাম এ্যানি, সেও একই সঙ্গে ডাক্তারী পাশ করেছে। দারুণ আঘাত পেলাম। কয়েকদিন থেকে ওরা চলে গেল। আর কোনদিন আসেনি। আমরাও মনের দু:খে যাইনি। পালা-পার্বণে মাঝে মধ্যে ফোন দেয়। অনেক কান্না-কাটি করেছি। আমাদের দু:খ দেখে ছোট ছেলে পল বলেছিল মা, আমি কোনদিন দাদার মতো করবো না। সে সব সময় আমাদের বাধ্য ছিল। কিন্তু কথায় বলেনা, “আগের হাল যেদিকে যায়, পিছনের হাল সেদিকে যায়।” পলও ডাক্তারী পড়তো।
ফাইনাল ইয়ারে হঠাৎ তার পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। আমাদের সাথে বসেনা, একসঙ্গে খায়না। কেমন যেন অন্য মনস্ক। কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাইনা, সব সময় কানে ফোন, কার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। সেও একদিন এক মেয়েকে নিয়ে এসে বললো, মা, এর নাম জুলিয়া, ইতালি বাড়ি। আমরা একই সাথে পড়ি এবং পরষ্পরকে ভালবাসি। ততোদিনে বড় ছেলের ধাক্কা কিছুটা সামলে নিয়েছি, তবুও প্রচন্ড আঘাত পেলাম। ভাবলাম যদি মত না দেই, বড় ছেলের মতো কোর্টে গিয়ে বিয়ে করবে। বড় ছেলের বিয়ের কোন অনুষ্ঠান হয়নি, মনে দু:খ ছিল, তবে ছোট ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান খুব ঘটা কওে দেয়। আমাদের সাথে ওরা মাস ছয়েক ছিল। বউমা যদিও মা বলে ডাকতো না, বাংলা শিক্ষতে চেষ্টা করতো এবং সব কাজে সাহায্য করতে চাইতো। আমাদের মশলা জাতীয় রান্না তেমন পছন্দ করতো না কিন্তু অনীহা ছিলনা। বেশ ভালই দিন কাটছিল। একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি ও তোমার দাদা বসার ঘরে টিভি দেখছি ওরা দু’জনে গুটিগুটি পায়ে এলো। বউ আমার কাধের কাছে সোফার হাতলে বসলো, ছেলে বাপের পাশে। দেখলাম কি যেন বলতে চায় কিন্তু পারছেনা। জিজ্ঞেস করলাম, কিরে খোকা কিছু বলবি? হ্যাঁ মা, বলছিলাম কি তোমরা যদি দু:খ না পাও বা কিছু মনে না করো তবে একটা কথা বলতে চাই। স্বাভাবিক ভাবে বললাম, বলনা এতে দু:খ পাবার কি আছে। পল বললো, আমি আর জুলিয়া আগামী শনিবার ইতালি ওর বাবা-মার কাছে চলে যাচ্ছি। আমরা তো আকাশ থেকে পড়লাম, ছেলে বলে কি?
বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, কবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছো ? আমাদের সাথে সামান্য আলোচনারও প্রয়োজন বোধ করলেনা? সমস্ত সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করে জানাতে এসেছো ? সে আমতা আমতা করে বললো, তোমরা দু:খ পাবে তাই বলিনী। প্রচন্ড অভিমান হলো। যে কদিন বাড়ি ছিল ভাল মতো কথা বলেনি। কেমন যেন কান্না পেত। ইতালিতে এক মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট সম্পত্তির মালিক হয়ে ওরা সুখেই আছে। আমি কথা বলিনা, তোমার দাদাই কথা বলে, সব সংবাদ আমাকে দেয়। এক নাগাড়ে কথা বলতে বলতে বৌদি হাপিয়ে উঠলেন এবং চোখে আচল দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। কিছুক্ষণ নিরবতার পর তিনি আবার শুরু করলেন, জান ভাই ওদের কথা মনে হলে বুকটা দুকরে উঠে। অনেক কাঁদি তবেই একটু শান্তি পাই। কত স্বপ্ন ছিল বউ-এর মা ডাক শুনবো। তা যখন আর কপালে জুটলনা তখন আর বেঁচে থেকে কি লাভ ?
এক অবুঝ মায়ের ব্যাকুল হৃদয়ের কথা শুনতে শুনতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো। সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে, অবশ্য আমাদের তাড়া নেই। কানাডাতে এখন সামার। সূর্য্য অস্ত যায় প্রায় ন’টায়। সূর্য্য পশ্চিম আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে হেলে পড়েছে। যে কোন মূহুর্তে টুপ করে ডুব দেবে, আবার পর মূহুর্তে উদিত হবে অন্র কোন দেশে। রুনু বৌদির বিমর্ষ মুখখানার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, চিন্তার সাগরে ডুব দিয়ে আনমনে ভাবতে লাগলাম, মা কেঁদে কেঁদে পাথর হয়েছেন, বাবা কাঁদছেন নিরবে-নিভৃতে। কিন্তু এর সমাধান কোথায়? মানুষ তার আপন বাসভূমি পরিত্যাগ করে যতদূরেই বসতি স্থাপন করুক না কেন, স্বদেশী সংস্কৃতি থেকে সে বিচ্ছিন্ন হতে পারেনা। তাই সাত সমূদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে এই মার্কিন মুল্লুকে এলেও আমরা চাই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন নিজ সমাজ-ধর্ম-সংস্কৃতির মধ্যেই বেড়ে উঠে।
আমাদের সন্তানরা ভাল পড়াশোনা করবে এবং ভবিষ্যতে তাদের বিয়ে যেন বাঙ্গালী সমাজেই হয় অর্থাৎ তাদের বিয়ে আমাদেরই খ্রীষ্টিয় সমাজে, অন্য কোন সমাজে নয়। এটা শতভাগ পিতা মাতার একান্ত কামনা। সেখানেই পিতা-মাতার সন্তানের জন্ম-লালন-পালন ও শিক্ষাদানের চরম স্বার্থকতা। সব সন্তানই বাবা-মা অন্তপ্রাণ। তাদের জন্য ভেবে ভেবে আকুল হয়। তবে কেউ কেউ একটু অবহেলা করে ফেলে, অনেক ক্ষেত্রে কাজের চাপ, নানা পারিপার্শ্বিকতার কারণে অবহেলা হয়ে যায়। আমার বিশ্বাস বাঙ্গালী ঘরের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে এখনও বাবা মাকে ভালবাসে, চিন্তা করে, তাদের কাছে পেতে চায়। কিন্তু বাবা-মায়ের স্বপ্ন স্বার্থক করার তাগিদটাও তো তারা উপেক্ষা করতে পারেনা। ফলে একটা দূরত্ব থেকেই যায়-সেই দূরত্বের কারণে কাছে না পাওয়ার বেদনাও কি দু-পক্ষের মধ্যে জাগনো? নিশ্চয় জাগে।
স্বপ্নাচ্ছন্ন ছিলাম, সহসা স্বপ্নজাল ছিন্ন হলো, জগদীশদার একটি মন্তব্যে- বললেন, জান ডেভিড, তোমার বৌদিকে আমার শেষ ইচ্ছাটা জানিয়ে দিয়ে বলেছি আমি মারা গেলে সে যেন রিটায়ম্যান্ট হোমে চলে যায়। আমার যা অর্থ সম্পদ আছে সে মহাসুখে পাঁচতারা হোটেলসম রিটায়ম্যান্ট হোমে থাকতে পারবে। দেশে আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ নেই, আর এ বয়সে সেখানে গিয়ে লাভও নেই বরং সমস্যা আরও বাড়বে। বললাম দাদা, হোমে সব ধরণের সুবন্দোবস্তো আছে ঠিকই-যেমন টিভিরুম, লাইব্রেরী, খেলাধুলা ও ব্যায়ামের নানা আধুনিক সরঞ্জাম। থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার। নিয়মিত সেবা যত্নের জন্য সার্বক্ষণিক অভিজ্ঞ ও পেশাদার লোক নিয়মিত থাকে। সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি অনেক প্রাইভেট সংস্থাও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, গৃহহীন-নি:স্ব-নির্যাতিত মানুষের জন্য বিনামূল্যে সব ধরণের ব্যবস্থা করে থাকে। একজন মানুষ হিসেবে হোমে যেমন মর্যাদা, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, সেবা-যতœ আছে তেমনি আছে অবসাদ, বিষন্নতাময় এক নি:সঙ্গ জীবন। নেই কোন প্রিয়জনের স্নেহের স্পর্শ, নিবিড় সান্নিধ্য, অকৃত্রিম ভালোবাসা, শ্রদ্ধাভক্তি। আপনজনকে ঘিরে একত্রে বসবাসের মতো “স্বর্গসুখ”।
আমার কথা শুনে বৌদি স্মিতহাস্যে বললেন, নিজের সন্তানদের উপর থেকে যখন সকল আস্থা-বিশ্বাস উঠে গেছে তখন আর কারো প্রতি বিশ্বাস নেইরে ভাই। আমি তোমার দাদার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা বলে সব সময় মেনে এসেছি। ভবিষ্যতে এর কোন ব্যতিক্রম হবেনা। পরিবেশকে স্বাভাবিক করার জন্য বললাম-বৌদি, শুনেছি দেশে আপনি স্কুলে গান শেখাতেন, আমাদের একটা গান গেয়ে শোনান না! মনটা ভাল হয়ে যাবে। কিছুতেই রাজী হলেন না। নানা অজুহাত তুলে ধরলেন-ভুলে গেছি, গলা ভাল নেই ইত্যাদি। আমরাও চেপে ধরলাম, কোন অজুহাত শুনলাম না।
সুন্দর জ্যোৎস্নায় আকাশ প্লাবিত। পৃথিবীকে অপার্থিব বলে মনে হচ্ছে। সমস্ত চিত্ত স্বপ্নলোকে মেঘের মত ভেসে বেড়াচ্ছে। আর ঠিক তখনই বৌদি মৌনতা ভেঙ্গে গান ধরলেন। তিনি একে একে বেশ কয়েকটি হারানো দিনের গান গেয়ে শুনালেন, বেশীর ভাগই প্রতিমা ও সন্ধ্যার গান কিন্তু শেষ গানটির রেশ আজও মনে বাজে। মান্নাদের সাড়া জাগানো গানটি বৌদির হৃদয় নিংড়ানো নারী কন্ঠে মূর্ত হয়ে উঠলো-
‘‘সবাই তো সুখী হতে চায়,
তবু কেউ সুখী হয় কেউ হয়না,
জানিনা বলে যা লোকে, সত্যি কিনা,
কপালে সবার নাকি সুখ সয়না। ”
লেখক : ডেভিড স্বপন রোজারিও (আমেরিকা)
আরবি/ আরপি/আরএসআর/ ১১ জানুয়ারি, ২০১৭