শিরোনাম :
শিক্ষার আলোকবর্তিকা ফাদার হোমরিকের চিরবিদায়
ডিসিনিউজ ।। ঢাকা
সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের বন্ধু ফাদার ইউজিন হোমরিক সিএসসি। মৃতকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। ২৫ জুলাই, আমেরিকায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। মৃত্যুর পর নিজ জন্মভূমি আমেরিকাতেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
ফাদারের মৃত্যুর চেয়েও বেদনার ছিল বাংলার বুকে ৫৭ বছরের মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে ২০১৬ সালের আগস্টে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া। দীর্ঘ প্রায় ছয় দশক টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলের গারো আদিবাসীদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের পাশাপাশি শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষার আলোকবর্তিকা।
মধুপুর গড়ের পীরগাছা সেন্ট পৌল ধর্মপল্লিতে বাংলাদেশ থেকে বিদায় জানাতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দীর্ঘ কর্মজীবনের স্মৃতিরোমন্থন করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন এই ফাদার। তখনই বোঝা গিয়েছিল বাংলার প্রতি তাঁর দরদবোধ কতটা গভীর ও তীব্র।
ফাদার হোমরিক বলতেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদন্ড। তাই ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক গুণাবলী অক্ষুন্ন রাখতে হবে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হতে হবে।’
স্থানীয় আদিবাসী জনগণ জানান, ফাদার ইউজিন হোমরিক ১৯৫৯ সালে মধুপুরে আসেন। প্রথমে জলছত্র মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সঙ্গে পুরো গড় এলাকার আদিবাসীদের শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করেন। ১৯৭১-এ যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁর ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি নিজেই সেবা দিতেন। এ ছাড়াও সেই সময়ে জলছত্র গ্রামের গারো আদিবাসীদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন কয়েক হাজার হিন্দু ভাইবোনদের। বিদেশি হয়েও বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান ছিল অনেক। তাই বাংলাদেশ সরকারে কাছ থেকে পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সনদও, পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা।
মানবসেবী ফাদার ইউজিন হোমরিকের জন্ম ১৯২৮ সালের ৮ ডিসেম্বর। যাজকীয় ব্রত গ্রহণ করেই ১৯৫৫ সালে বাংলাদেশে মিশনারি কাজে চলে আসেন। তৎকালীন নটর ডেম কলেজের বাংলার অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ আবদুল হামিদের কাছে বাংলা ভাষার পাঠ নেন।
১৯৫৬-১৯৫৯ সাল, এই ৩ বছর ঢাকার নবাবগঞ্জের গোল্লা ধর্মপল্লিতে কাজ করেন এবং পরে ময়মনসিংহ শহর ও হালুয়াঘাটে বদলি হন।
কিন্তু ৯ মাস পরই হালুয়াঘাটে বিড়ইডাকুনি থেকে ১৯৬০ সালে চলে আসেন টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলে।
১৯৮০ সালের দিকে ডিসিনিউজের নির্বাহী সম্পাদক রাফায়েল পালমা সেমিনারীতে পড়াশোনার জন্য জলছত্র ছিলেন। সেখানেই ফাদার হোমরিকের সাথে পরিচয়। খুব কাছ থেকে দেখা ফাদার হোমরিকের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফাদার হোমরিক অত্যন্ত ভাল মনের মানুষ ছিলেন। যাজকীয় ব্রত নিয়েই তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। মধুপুরের গারো আদিবাসীদের জন্য দরদ ছিল গভীর। জঙ্গলকে ভালবেসে, তার বুকে সকল মান্দিকে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তিনি কাজ শুরু করেন। মান্দি জনগোষ্ঠীর সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন, দরিদ্র্যতাই গারো আদিবাসীদের নিত্যসঙ্গী। তাই তিনি তাদের জীবনমান পরিবর্তনের কাজে ব্রতী হন।’
তিনি পিছিয়ে থাকা এই মান্দি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য গড়ে তোলেন ৩৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জলছত্র এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন কর্পোস খ্রিস্টি উচ্চ বিদ্যালয় এবং পীরগাছায় প্রতিষ্ঠা করেন সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয়।