ঢাকা ,
বার : সোমবার
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা : ৯ পৌষ ১৪৩১
Dcnewsbd Facebook
Dcnewsbd Twitter

শিরোনাম :

প্রথম পাতা ঢাকা ক্রেডিট বাবা-মায়ের যুগলমৃত্যু, অরণ্যের চাপাকান্না

বাবা-মায়ের যুগলমৃত্যু, অরণ্যের চাপাকান্না

0
5703

।। রাফায়েল পালমা।।

শুক্রবার। সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখ। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সময়টা বিকেল বেলা।
অন্যান্য কয়েকবারের মতো এবারও তারা একমাত্র ছেলে অরণ্যকে সঙ্গে নিলেন নাা। এই করোনাকালে বৃদ্ধ নানার সাথে বাসায়ই রেখে গেলেন তাকে। খাবার সকল ব্যবস্থা করে গেলেন তন্দ্রা। একদিন পরেই তো ফিরে আসাবেন।
স্মার্টফোনের সাথেই এই ৭ম শ্রেণির ছাত্র অরণ্যের সখ্যতা। তাই গ্রামে যাওয়ার চেয়ে ঢাকার বাসায় থাকাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে।
করোনার কারণে স্কুল বন্ধ । অক্টোবর ১৫ পর্যন্ত। কিছু পড়াশোনা ছাড়া বাকি সময় তার ফোনে-ফেসবুকেই কাটে।
ঢাকার ফার্মগেট এলাকা থেকে একটি সিএনজি ভাড়া করেন ওই দম্পতি – বিপুল ও তন্দ্রা। স্বামীর পদবী গমেজ। সহধর্মিনীর পুরো নাম তন্দ্রা ফ্লোরেন্স কস্তা। তন্দ্রার নিজের গ্রামের বাড়ি সাভার ধরেন্ডা মিশনে কমলাপুর গ্রামে। বিয়ের পর ঢাকাতেই ভাড়াবাসায় থাকেন। তন্দ্রা কাজ করেন ঢাকা ক্রেডিটের প্রধান কার্যালয়ে, এ্যসিস্ট্যান্ট অফিসার হিসেবে। ক্রেডিট অপারেশন ডিপার্টমেন্টে সবেমাত্র প্রমোশন হয়েছে তার।
স্বামী বিপুল গমেজ এক-দেড় বছর আগেই বিদেশ সফর ইস্তফা দিয়ে গ্রামেই থাকতে শুরু করেছেন। কৃষিভিত্তিক পুকুর ও মুরগির খামার যেমন তার সখ তেমন তার আয়ের উৎস।
মাকে হারিয়েছেন তন্দ্রা অনেক আগেই। বাবার বর্ধক্যজনিত রোগশোকের যত্ন আর একমাত্র ছেলে অরণ্যের ভালো লেখাপড়া করার জন্যই মা তন্দ্রার ঢাকায় থাকা। আর সপ্তাহান্তে স্বামী-স্ত্রীর শহরে-গ্রামে আসা-যাওয়া যেন ছিল তাদের দীর্ঘদিনের স্বাভাবিক নিয়ম।
তাদের এই স্বাভাবিক নিয়মের ছন্দপতন হলো গত শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ঠিক সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে। গ্রামের খোলা বাতাসে সিএনজিতে চলা। সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে ঢাকা শহরের বিষাক্ত পরিবেশ পেরিয়ে গ্রামের মুক্ত-ঠান্ডা বাতাস তাদের পুলকিত করে। অল্প কিছুক্ষণ পরে তাদের গন্তব্য আঠারোগ্রাম তুইতাল পৌঁছবেন অনুভব করছিলেন।
গ্রামের পিচঢালা পথে দ্রুত চলতে থাকে সিএনজি। ঢাকা থেকে মাঝিরকান্দা যাওয়ার পরপরই দ্রুতগামী এম মল্লিক পরিবহনের (ঢাকাগামী) একটি বাসের সাথে সিএনজিটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সিএনজির চালকসহ এই দম্পতি এমন আঘাতপ্রাপ্ত হন যে, চালক ও বিপুল ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। তন্দ্রার ক্ষতবিক্ষত দেহ স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁদের সকলের দেহ ও মুখোয়বয়ব সংঘর্ষের আঘাতে বিকৃত হয়ে যায়। চেনাই যেন কঠিন।
কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ঢাকা ক্রেডিটের এম্বুলেন্স পাঠিয়ে দেওয়া হলো দুর্ঘটনার স্পটে। স্থানীয় থানার আইনগত বিষয় শেষ করা হলে এম্বুলেন্সের চালক টিটু তাদের ধরাধরি করে নিহতদের আত্মীয়-স্বজনসহ ঢাকায় নিয়ে আসেন। ওই রাতেই বারডেম হাসপাতালে। তখন বাজে রাত দুটো-আড়াইটা। ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের হিমাগারে রাখতে নারাজ। নিয়ে যাওয়া হলো পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে।
সেখানেই হিমাগারে রাখা আছে এই অনেক সম্ভবনাময় ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাওয়া এই দম্পতির নিথর শবদেহ।
সেপ্টেম্বর ৫, শনিবার সকালে ঢাকা ক্রেডিটের উর্ধ্বতম কর্মীদের একটি দলকে পাঠানো হয় তাঁদের পূর্ব রাজাবাজারের বাসায়। বাসার নিচে উন্মুক্ত স্থানে বসে থাকতে দেখা যায় তাঁদের নিকটাত্মীয়দের কয়েকজনকে। তাঁদের সাথেই আলাপে জানা গেল, বিদেশ থেকে বিপুল গমেজের মেজোভাই অপু আসলেই তাঁদের তেজগাঁও চার্চের চত্বরে কবরস্থানে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে। সম্ভাব্য অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হতে পারে সেপ্টেম্বর ৮ তারিখ, মঙ্গলবার।
ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট পংকজ গিলবার্ট কস্তাসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সকল সদস্য ও কর্মী এই অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ও তাঁদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। ঢাকা ক্রেডিটের ৭০০ কর্মী কালো ব্যাচ ধারণ করেছেন।
পূর্ব তেজতুরীবাজারে ঢাকা ক্রেডিটের প্রধান কার্যালয়ের প্রধান ফটকে এবং ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের ১৩টি সেবাকেন্দ্রের প্রধান সামনের প্রবেশপথে কালো কাপড়ে সাদা হরফে লেখা শোকবার্তা প্রকাশ করা হয়েছে।
অফিসের পক্ষ থেকে যথাসম্ভব সকল প্রকার সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন প্রেসিডেন্ট পংকজ গিলবার্ট কস্তা ও সেক্রেটারি ইগ্নাসিওস হেমন্ত কোড়াইয়া।
এতকিছুর আয়োজন সম্বন্ধে ১২-১৩ বছরের অরণ্যকে কিছুই জানানো হয়নি। শুধু তাকে বলা হয়েছে মা-বাবার একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, হাসপাতালে আছে। অরণ্য নাকি শুধু বলছে, কেন তার মা-বাবা তাকে ফোন করছেন না! আগেও তো গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন অনেকবার, এমনটিতো তারা কোনোদিনও করেননি। তার এই প্রশ্ন ধীরে ধীরে কান্নার রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে।
অনেক আত্মীয়ের আনাগোণা হচ্ছে তাদের পূর্ব রাজাবাজারের বাসায়, কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কাউকে মিলছে না। অরণ্যের হৃদয়ে যেন বার বার ছুঁয়ে যাচ্ছে মা-বাবা হারানোর বেদনার অনুভূতি। এ যেন অরণ্যের শুধুই অরণ্যে রোদন। সে কি কোনোদিন পাবে তার প্রিয় মা-বাবাকে! তার এই চাপাকান্নার শেষ কোথায়!
-০-