শিরোনাম :
বাংলাদেশের পরম বন্ধু ফাদার টিমের মৃত্যু
ডিসিনিউজ ।। ঢাকা
মারা গেছেন বাংলাদেশের পরম বন্ধু বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ফাদার উইলিয়াম রিচার্ড টিম সিএসসি।
১১ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশ সময় রাত ২টায় বার্ধক্যজনিত কারণে প্রাণত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। তিনি নিজ দেশ আমেরিকার হলিক্রস ফাদার হাউজ, ইন্ডিয়ানায় অবস্থান করছিলেন।
ফাদার টিমের মৃত্যুতে শোকাভূত বাংলাদেশ। শোক জানিয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ও চার্চ।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সমবায় প্রতিষ্ঠান ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট পংকজ গিলবার্ট কস্তা ও সেক্রেটারি হেমন্ত আই. কোড়াইয়া এক যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে এই মহান মানুষটির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
তারা বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, ফাদার টিম ছিলেন বাংলাদেশের পরম বন্ধু। বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। সেই সাথে তিনি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) সাথে কাজ করেছেন। একজন মিশনারী হয়ে নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশের মানুষের জন্য যেভাবে জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করেছেন, তা খুবই বিরল।
‘বাংলাদেশ ও মন্ডলী আজ একজন সত্যিকারের বন্ধু হারিয়েছে। ভিনদেশি হয়েও তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন বাংলাদেশি দেশপ্রেমিক। দয়াময় সৃষ্টিকর্তা তাঁকে অনন্ত বিশ্রাম দান করুন’ যোগ করেন ঢাকা ক্রেডিটের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি।
ফাদার টিম বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের রূপকার ফাদার চালর্স জে. ইয়াং সিএসসি’র জীবনী গ্রন্থ ‘`Father of the Credit Unions in Bangladesh’ এর রচয়িতা।
ফাদার টিম চিকিৎসার জন্য নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে বলেছিলেন তিনি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু বার্ধক্যজনিত অসুস্থায় ফিরে আসতে পারছিলেন না। অবশেষে বাংলাদেশে ফিরে এলো তার মৃত্যুর খবর।
ফাদার টিম ছিলেন বাংলাদেশের পরম বন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের মহাশক্তি ও সম্মাননা পুরস্কারপ্রাপ্ত, বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, ও এশিয়ার নোবেলখ্যাত ‘রেমন ম্যাগসেসাই’ পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন গুণী মানুষ। তিনি দেশসেরা নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দক্ষতার সাথে কলেজটিকে পরিচালনা করেছেন।
ফাদার টিমের সংক্ষিপ্ত জীবনী:
ফাদার রিচার্ড টিমের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যের মিশিগান শহরে ২ মার্চ, ১৯২৩ সালে । তারা দুই ভাই, দুই বোন। বড় ভাই দেড় বছরের বড়। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারা যান। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি মিশনারি জীবনের আহ্বান পান। তখন তার ভাই ববের সঙ্গে সেন্ট মেরিজ হাইস্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়তে যান।
ফাদার টিম ছিলেন বাংলাদেশের পরম বন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের মহাশক্তি ও সম্মাননা পুরস্কারপ্রাপ্ত, বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, ও এশিয়ার নোবেলখ্যাত ‘রেমন ম্যাগসেসাই’ পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন গুণী মানুষ। তিনি দেশসেরা নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দক্ষতার সাথে কলেজটিকে পরিচালনা করেছেন।
তিনি নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীববিজ্ঞানে মাস্টার্স ও ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর সেমিনারিতে প্রবেশ করেন। ১৯৪২ সালের ১৬ আগস্ট প্রথম ধর্মীয় ব্রত গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালের জুন মাসের ৮ তারিখে যাজকীয় অভিষেক লাভ করেন।
যাজক হয়ে তিনি ঢাকার নটর ডেম কলেজের আমন্ত্রণে ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে আসেন এবং নটর ডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ শুরু করেন। এরপর ১৯৫২-২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। নটর ডেম কলেজের তিনি ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান, ডিন অব স্টাডিজ, বায়োলজির প্রফেসর এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতার ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও সঞ্চালক।
সেই সময় তিনি একটি বই লেখেন ‘টেক্সট বুক অব কলেজ বায়োলজি’ যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সব কলেজেই পড়ানো হতো। তিনি নটর ডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করেই ক্ষান্ত হননি, বার্ষিক বিজ্ঞান মেলা, ডিবেটিং ক্লাব এবং আরও নানা সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের মনোবৃত্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবত নটর ডেম কলেজে অধ্যাপনা করেছেন এবং অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নটর ডেম কলেজে এবং গোটা বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ডিবেটিং ক্লাবের মাধ্যমে তর্কবিতর্ক শুরু করেন এবং বিজ্ঞান ক্লাবের মাধ্যমে বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করেন। এখন তারই ধারাবাহিকতায় অনেক স্কুল-কলেজেই তর্কবিতর্ক ও বিজ্ঞান মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তিনি বনানীতে অবস্থিত পবিত্র আত্মার উচ্চ সেমিনারিতেও Moral Theology, Justice and Peace, Social Analysis এই বিষয়গুলোও পড়িয়েছেন। তিনি স্বাধীনতার পর পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও সম্পাদনায় কাজ করেছেন।
তিনি নিভৃতে থেকে দীর্ঘদিন ধরে পোকামাকড় আর কৃমি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি প্রায় ২৫০ নতুন ধরনের নেমাটোড আবিষ্কার করেছেন, যাকে রাউন্ড ওয়ার্ম বা গোল কৃমি বলা হয়।
তিনি নিজ চোখে দেখেছেন তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ঘূর্ণিঝড় আর মুক্তিযুদ্ধে মানুষের চরম দুর্যোগ আর কষ্ট। তা দেখে তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি। তাই পোকামাকড়ের গবেষণা বাদ দিয়ে তিনি মানুষের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করার উদ্দেশ্যে ছুটে গেলেন মনপুরা দ্বীপে। সেখানে তিনি তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতনের হাত থেকে নিরীহ দ্বীপবাসীদের রক্ষা করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি শিক্ষা, সমাজ উন্নয়ন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছেন।
১৯৭০ সালে ১২ নবেম্বর এক ভয়ঙ্কর ও সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়, যার ঢেউ ২০ ফুট পর্যন্ত উঁচু ছিল। এই ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনে শুধু সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতেই প্রায় আড়াই লাখ লোক মারা যায়। তিনি প্রথমে ভোলার মনপুরা দ্বীপে রিলিফ কাজ পরিচালনা করেন। কারণ মনপুরা ছিল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। তার সঙ্গে অন্য ফাদারগণ এবং দাতা সংস্থার লোকজনও ছিলেন।
১৯৭১ খিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি ঢাকায় ফিরে কারিতাসের (তৎকালীন নাম ছিল কোর) পরিকল্পনা অফিসার হিসেবে যোগ দেন এবং যুদ্ধকালীন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেন। যুদ্ধ শেষে ক্যাথলিক সংস্থা হিসেবে সবচেয়ে বড় পুনর্বাসন কাজ চালান। এই প্রকল্প ছিল ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণের অর্থ ও কর্ম সাহায্য প্রকল্প। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপদের অধীনে ন্যায় ও শান্তি কমিশনের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি এর নির্বাহী সচিব হিসেবে কাজ পরিচালনা করেছেন এবং দীর্ঘ ২৩ বছর এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ পর্যন্ত তিনি পুনর্বাসনের কাজ করেছেন। ইতোমধ্যে ১৯৭১ খিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আর তিনি সেখানকার হিন্দুদের রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মনপুরা দ্বীপে বসবাসকারীদের মধ্যে ৩০ শতাংশই ছিল হিন্দু, যারা পাক বাহিনীর দৃষ্টিতে ‘রাষ্ট্রীয় শত্রু’ বলে গণ্য ছিল। ফাদার উইলিয়াম রিচার্ড টিম ছিলেন সেই দ্বীপের অতন্দ্র প্রহরী। তার কারণে সেই দ্বীপে কখনও মিলিটারি বাহিনী প্রবেশ করতে পারেনি। তবে সেখানে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা লোকদের অত্যাচার করত। ফাদার তাদের হাত থেকে হিন্দুদের রক্ষা করেছেন। ১৯৭১ সালে আগস্টে তিনি ঢাকায় এসে জানতে পারলেন যে, সব সাংবাদিককে বের করে দেয়া হয়েছে। ফাদার টিম তাই গোপনে পাকবাহিনীর নৃশংসতার খবর সংগ্রহ করে ওয়াশিংটনে ড. জন রুডিসহ বিভিন্ন লবি গ্রুপের কাছে পাঠান, যেন তারা এর বিরুদ্ধে বিশ্ব মতামত তৈরি করতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি মাদার তেরেসার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে যুদ্ধের সময় যে সব নারী নির্যাতিত হয়েছিল বা যুদ্ধের ফলে যে সব সন্তানের জন্ম হয়েছিল তাদের পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু মাদার তেরেসাকে এ ব্যাপারে কাজ করার অনুমতি দেন এবং তখন থেকে মাদার তেরেসার সিস্টাররা ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে জনসেবার কাজ শুরু করেন। ফাদার টিম এ কাজে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। ১৯৭১ খিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি ঢাকায় ফিরে কারিতাসের (তৎকালীন নাম ছিল কোর) পরিকল্পনা অফিসার হিসেবে যোগ দেন এবং যুদ্ধকালীন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেন। যুদ্ধ শেষে ক্যাথলিক সংস্থা হিসেবে সবচেয়ে বড় পুনর্বাসন কাজ চালান। এই প্রকল্প ছিল ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণের অর্থ ও কর্ম সাহায্য প্রকল্প। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপদের অধীনে ন্যায় ও শান্তি কমিশনের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি এর নির্বাহী সচিব হিসেবে কাজ পরিচালনা করেছেন এবং দীর্ঘ ২৩ বছর এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
তিনি ১৯৮৭ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ডারস্টান্ডিং এ্যান্ড পিস’-এর জন্য ফিলিপিন্স থেকে ‘রেমন ম্যাগসেসাস’ পুস্কার লাভ করেন, যা এশিয়ার শান্তি নোবেল পুরস্কার বলে পরিচিত। তিনি সমাজসেবক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ কারিতাস সংস্থার পরিচালনায় ‘ন্যায় ও শান্তি’ কমিশনে এবং মানবাধিকারকর্মী হিসেবে সেবা দিয়েছেন। তিনি ন্যায় ও শান্তি কমিশনের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। তার উদ্যোগে ন্যায্যতা ও শান্তি কমিশনের ত্রৈমাসিক প্রকাশনা বাংলায় ‘ন্যায্যতা’ ও ইংরেজীতে ‘হট লাইন’ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে, যেখানে অন্যায্যতার চিত্র পাওয়া যায়। তিনি ন্যায্যতা ও বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে বইও লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো: বাংলাদেশের আদিবাসী, উপজেলা নির্বাচন ১৯৯০, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সেবা কাজের পাশাপাশি তিনি আধ্যাত্মিক সেবা কাজের মধ্যেও নিয়োজিত ছিলেন। ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ সিস্টার ও ‘হলিক্রস’ সিস্টারদের চ্যাপলেইন হিসেবে সেবা দিয়েছেন।
ফাদার টিম দীর্ঘ ৪৯ বছর বাংলাদেশে থেকে বাংলাদেশের মানুষকে ভালবেসে সেবা দিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের পরম বন্ধু।