শিরোনাম :
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইন বাতিলে বাংলাদেশে খ্রিষ্টানদের মানববন্ধন
ডিসিনিউজ।। ঢাকা
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ এবং ব্লাসফেমি আইন বাতিলের দাবিতে মানবন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। সেই সাথে ঢাকাস্থ পাকিস্তানি হাইকমিশনের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ খান নিয়াজি বরাবর লিখিত স্মারকলিপি প্রদান করেন বিক্ষোভ সমাবেশের নেতৃবৃন্দ। একই সাথে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভী ও স্পীকার আসাদ কাওসার বরাবর অনুলিপি প্রদান করা হয়।
২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিওর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মানবন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণ অংশগ্রহণ করেন ও সংহতি প্রকাশ করেন।
বেলা ১১টায় ঢাকা গুলশান-২ গোল চত্বরে এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিওর সভাপতিত্বে ও যুগ্ম-মহাসচিব জেমস্ সুব্রত হাজরার সঞ্চালনায় এই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও পাকিস্তানে খ্রিষ্টানসহ সংখ্যালঘু অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর চলমান নির্যাতনের কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা জানান। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের মাধ্যমে খ্রিষ্টানসহ সংখ্যালঘুদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। কোনো ধর্মই সামান্য কারণে মানুষ হত্যা করতে উৎসাহিত করে না। কিন্তু পাকিস্তানে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে এই আইনের মাধ্যমে নির্যাতন-নিপীড়ন করা হচ্ছে।’
‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সব সময়ই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পাকিস্তান ঐতিহাসিকভাবে সব সময়ই নির্যাতনমূলক আচারণ করে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে। এখনো নিজের দেশের মধ্যে নির্বিচারে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চালাচ্ছে। ২০১৩ সালে কথিত ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করার জন্য আসিফ পারভেজ নামে একজন খ্রিষ্টান যুবকের নামে ব্লাসফেমি আইনে মামলা করে তার সহকর্মী। কিন্তু তার দাবি, তাকে ধর্মান্তরিত করার জন্য অসিফের সহকর্মী চাপ দেয়, আসিফ তা করতে অস্বীকৃতি জানালেই তার নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। তখন থেকে আটক রয়েছেন আসিফ পারভেজ। কিছুদিন পূর্বে লাহোরের আদালত এই আইনে আসিফ পারভেজকে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ব্লাসফেমি আইন মূলত মিথ্যে মামলার মাধ্যমে হয়রানি ও নিপীড়নের সুযোগ করে দিচ্ছে উগ্রবাদীদের’ বলেন এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও।
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের মাধ্যমে বহু খ্রিষ্টান ও সংখ্যালঘু ইতিমধ্যে হত্যা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ২০১০ সালে আসিয়া বিবি নামে এক খ্রিষ্টান নারীর নামে এই আইনের মাধ্যমে মিথ্যে মামলা দেওয়া হয়। তখন আমরাও আন্দোলন করেছিলাম, পাকিস্তান হাইকমিশনের মাধ্যমে তখনকার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত চিঠিও দিয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনের পর দীর্ঘ আট বছর কারাগারে রেখে অবশেষে উচ্চআদালত আসিয়া বিবিকে মুক্তি দেয়। এ ছাড়াও বিভিন্নভাবে পাকিস্তানে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানো হচ্ছে যুগযুগ ধরে। পাকিস্তান সরকারকে অনতিবিলম্বে এসব বন্ধ করার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
সমাবেশে বাংলাদেশ সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি প্রাক্তন রাষ্টদূত অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের উপর চলমান নির্যাতনের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবেই পাকিস্তান নানান অপরাধ সংগঠিত করে আসছে। বাংলাদেশের উপর ওদের নির্যাতনের চিত্র গোটা বিশ্ব জানে। ওরা সেচ্ছাচারী হয়ে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার করে আসছে। পাকিস্তানিদের মধ্যে কোনো ন্যায়-নীতিবোধ নেই। পাকিস্তান সারা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। যত বড় বড় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা সন্ত্রাসী রয়েছে, পাকিস্তানে তাদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।’
‘ব্লাসফেমি আইন প্রচলন করে সংখ্যালঘু নির্যাতনই যেন ওদের উদ্দেশ্য। যেদিন ওরা মূল্যবোধসম্পন্ন হবে, সেদিন শান্তি ফিরে আসবে,’ বলেন নিমচন্দ্র ভৌমিক।
এ ছাড়াও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জী, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভদন্ত সুনন্দপ্রিয় ভিক্ষু, বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সম্পাদক থিওফিল রোজারিও, মহিলা-বিষয়ক সম্পাদক কল্পনা ফলিয়াসহ দেশের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
বক্তারা এ সময় পাকিস্তানে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ ও যাদের ব্লাসফেমি আইনের মাধ্যমে শাস্তির রায় দেওয়া হয়েছে, তাদের নিঃশর্ত মুক্তি এবং অনতিবিলম্বে ব্লাসফেমি আইন বাতিলের জোর দাবি জানান।
স্মারকলিপিতে পাকিস্তানের খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর তথাকতিথ ব্লাসফেমি আইনের অপব্যবহার ও তার আবরণে হয়রানি, নির্যাতন-নিষ্পেষণ এবং মৃত্যুদন্ড বন্ধসহ মানবাধিকার পরিপন্থী ব্লাসফেমি আইন অনতিবিলম্বে বাতিলের জোর দাবি জানানো হয়। যাদের ব্লাসফেমি আইনে মৃত্যুদন্ড প্রদানের রায় দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে মার্জনাপূর্বক জীবন রক্ষার দাবিও জানানো হয়।
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনে নির্যাতনের চিত্র:
২০১৩ সালে কথিত ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করার জন্য আসিফ পারভেজ নামে একজন খ্রিষ্টান যুবকের নামে ব্লাসফেমি আইনে মামলা করে তার এক সহকর্মী। কিন্তু তার দাবি, তাকে ধর্মান্তরিত করার জন্য অসিফের সহকর্মী চাপ দেয়, আসিফ তা করতে অস্বীকৃতি জানালেই তার নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। তখন থেকে আটক রয়েছেন আসিফ পারভেজ। কিছুদিন পূর্বে লাহোরের আদালত এই আইনে আসিফ পারভেজকে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়। ২০১০ সালে আসিয়া বিবিকেও এই আইনের মাধ্যমে মিথ্যে মামলা দেওয়া হয়। নিম্ন আদালত তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে। দীর্ঘ আট বছর কারাগারে রেখে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনের ফলে অবশেষে উচ্চআদালত আসিয়া বিবিকে মুক্তি দেয়।
এ বছর (২০২০) জুলাইয়ের শেষের দিকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে তাহির নামিস নামে একজন খ্রিষ্টান ব্যক্তিকে ব্লাসফেমি আইনে বিচার চলাকালে আদালতকক্ষের ভেতরেই গুলি করে হত্যা করা হয়।
২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর, ব্যক্তিগত আক্রশে কথিত কোরআন শরীফ অবমাননার দায়ে এক খ্রিষ্টান দম্পতি- শামা মেসিহ এবং শেহজাদ মেসিহকে ইটের ভাটার আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে স্থানীয় লোকজন।
এ ছাড়াও পাকিস্তানে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সোনিয়া ও অনিলার মতো কিশোরী বা নারীদের ওপর চরম যৌন নির্যাতন হয়েছে। সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে এই করোনাকালেও খ্রিষ্টানদের জোর করে বাড়িঘর ভেঙেচুড়ে দিচ্ছে ইমরান খানের সরকার।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পাঞ্জাব প্রদেশে ফাইরা নামে এক খ্রিষ্টান তরুনীকে জোর করে তার স্কুলের প্রিন্সিপাল সালিমা বিবির সহায়তায় ধর্মান্তরিত করা হয়। এ ছাড়াও সিন্ধু প্রদেশে রেণুকা কুমারী নামে আরেক তরুণীকে ধর্মান্তরিত করা হয়।
গত বছর পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে সামরা বিবি নামে ১৫ বছরের এক খ্রিষ্টান কিশোরীকে মুহম্মদ রমিজ নামে এক মুসলিম যুবক জোরপূর্বক ধরে নিয়ে ধর্ষণ ও ধর্মান্তরিত করে। পরে তাকে জোরপূর্বক বিয়ে করে নির্যাতন করে।
২০১৮ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একই পরিবারের চার সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেছে বন্দুকধারীরা। সুন্নি মুসলিম-গরিষ্ঠ পাকিস্তানি সমাজ এই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হিংসা, গণহত্যা, বিচারবহির্ভুত হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ কিংবা জোর করে ইসলামে ধর্মান্তর করে চলেছে নির্বিচারে। পাকিস্তান সরকার অনেকাংশেই এই সব অপরাধে নিরব ভূমিকা পালন করছে। সেই সাথে ব্লাসফেমি আইনকে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই আইনের দোহাই দিয়ে তারা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন কি?
পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের অধীনে যারা ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে তাদেরকে মৃত্যুদন্ডসহ কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।
ধর্মসম্পর্কিত অপরাধের আইন ভারতের বৃটিশ শাসকদের দ্বারা প্রথমবার ১৮৬০ সালে বর্ণিত হয়। পরে ১৯২৭ সালে এটিকে আরো বিস্তৃত করা হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত থেকে আলাদা হয়ে পাকিস্তান এই আইনগুলোকে গ্রহণ করে।
প্রাচীন আইন অনুযায়ী, কোনো ধর্মীয় সমাবেশে গন্ডগোল করা, অন্য ধর্মের সমাধিস্থানে প্রবেশ করা, ধর্মীয় বিশ্বাস অপমান করা বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ধর্মীয় স্থান বা বস্তু ধ্বংস বা তার ক্ষতি করায় সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হত।
কিন্তু ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে পাকিস্তানের সেনাশাসক জিয়াউল হকের সময় এই আইনে আরো বেশ কয়েকটি ধারা সংযুক্ত করা হয়।
জেনারেল জিয়াউল হক পুরানো আইনটিকে ‘ইসলামিকরণ’ করে পাকিস্তানের সুন্নি মুসলিম ও আহমাদিয়া সম্প্রদায়কে আইনিভাবে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে আহমাদিয়াদের অমুসলিম হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
আইনে সংযুক্ত নতুন ধারায় ইসলামের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করাকে অবৈধ করা হয়, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ কোরান অপবিত্র করলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড শাস্তির বিধান আনা হয় এবং পরে, নবী মুহম্মদকে অবমাননা করলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা মৃত্যুদন্ডের বিধানের বিষয়গুলো সংযুক্ত করা হয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানে উগ্রবাদি মুসলমান এই আইনকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করছে। নির্বিচারে যেকোনো সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে তারা মিথ্যে মামলা দিয়ে হয়রানি ও নির্যাতন করছে।