শিরোনাম :
হারানো কষ্ট ভুলে নতুন উদ্যোমে এগিয়ে যেতে চাই: গুলশান অগ্নিকান্ড
উদ্ধারকৃত মালামালগুলোর অবশিষ্টাংশ দেখাচ্ছেন ক্লেমেন্ট গমেজ।
২ জানুয়ারি, সোমবার। রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টা। ঢাকা শহর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ মুঠোফোনটি বেজে উঠলো। অপর প্রান্ত থেকে জানানো হল গুলশান-১ এর ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লেগেছে। কোনো কিছু না ভেবেই তড়িঘড়ি করে সেখানে ছুটে গেলেন। পৌঁছে দেখেন আগুনের লেলিহান শিখা এরমধ্যে মার্কেটের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের হট্টগোল, ছুটাছুটি আর আর্তচিৎকারে গুলশান মার্কেট যেন রীতিমত রণক্ষেত্র। সবাই দিকবিদিক ছুটাছুটি করছে। ছয়জন কর্মচারীকে নিয়ে সেখানে গেলেন। মুহুর্তেই নির্বাক, স্তবদ্ধ হয়ে যান তিনি। বাকি রাত ওখানেই কাটালেন।
বলছিলাম স্টারলিন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ক্লেমেন্ট গমেজের কথা। সম্প্রতি গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটের অগ্নিকান্ডে দোকানের পজিশন মূল্যসহ তার পৌনে তিন কোটি টাকা সমমূল্যের মালামাল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্লেমেন্ট গমেজ বিদেশি পারফিউম, কসমেটিকস্, কাপড় ও ঘড়ির পাইকারি এবং খুচরা বিক্রেতা। ব্যবসা করছেন ১৯৮৭ সাল থেকে। ইনফিনিটি, আলমাস, প্রিয় ছাড়াও দেশীয় বাজারে তার পণ্যের ব্যাপক চাহিদা।
ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে দোকানটি নতুন রূপে সাজিয়েছিলেন। থরেথরে সাজানো ছিল প্রিয়জনকে উপহারের রকমারি সব পণ্য। কিন্তু মুহুর্তেই সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তা কোনদিনও ভাবেননি। শুধু গমেজ নন, তার মতো আরো তিন জন খ্রিস্টান ব্যবসায়ির দোকান ওই অগ্নিকান্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
৫ জানুয়ারি, বৃহষ্পতিবার, সন্ধ্যায় ক্লেমেন্ট গমেজ ও লিটন গমেজের বর্তমান অবস্থা জানতে সরেজমিনে তাদের মনিপুরিপাড়ার বাসায় যায়। কলিং বেল টিপতেই ব্যবসায়ী ক্লেমেন্ট দরজা খুলে দিলেন। সোফায় বসতে দিলেন। তার সদাহাস্যের মুখখানা ভীষণ গম্ভীর, স্ত্রীরও। দু’জনেই ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নির্বাক ক্লেমেন্ট গমেজ ও তার সহধর্মিনী
তারপর ভয়াল রাতের সেই ঘটনা একে একে বলে গেলেন। বর্ননার সময় তার চোখ ছলছল করে ওঠে, কখনো গলা রুদ্ধ হয়ে এসেছে। ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে। কীভাবে যে কী হলো ভাবতেই পারছেন না তিনি। বড় ছেলে বলে, ‘তুমি কেন ভেঙে পড়ছো বাবা। আমরা আছি না?’ ছেলের কথায় সম্বিৎ ফিরে পান। খুঁজে পান নতুন করে পথচলার অনুপ্রেরণা। ডিএনসিসি মার্কেটে তার পণ্য মজুতের তিনটা স্টোর ছিল। স্টোর বাদে দোকানের মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার অর্থমূল্য প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকা। পরে বাসার এককোণে রাখা উদ্ধারকৃত মালামালগুলো আমাদের দেখালেন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ব্যবসায়ি হিসেবে ক্লেমেন্ট গমেজের সুনাম রয়েছে। দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা থেকে কন্টেইনারে পণ্য নিয়ে আসতেন। ভাতিজা লিটন ছাড়াও শ্যালক ফ্রান্সিসসহ অনেককেই ব্যবসার কৌশল শিখিয়েছেন ক্লেমেন্ট। সাহায্য করেছেন তাদের নিজ পায়ে দাঁড়াতে। তাদের মধ্যে অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে ইউরোপ, আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন নানা কারণে।
ঘটনার পর থেকে বিদেশি ব্যবসায়িক পার্টনাররা তাকে ফোনে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘আপনি দুঃচিন্তা করবেন না, আমরা আপনার পাশে আছি।’ ক্লেমেন্ট গমেজ বলেন, ‘জীবনে যা কিছু পেয়েছি তার জন্য ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কখনো ভাবিনি গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠবে। গুলশান এলাকার ব্যবসায়ি হিসেবে যথেষ্ট সম্মান পেয়েছি। নিজের সন্তানের মতো আদর-ভালবাসা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করেছিলাম।’ ক্লেমেন্ট গমেজ দি খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি: ঢাকা-এর নিয়মিত সদস্য। বিভিন্ন ব্যাংক ও ঢাকা ক্রেডিটসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি ব্যাংকসহ ঢাকা ক্রেডিটের কাছে সুদ মওকুফের অনুরোধ জানান এবং ব্যবসার সুনাম, লোনের ঐতিহ্য ও ঢাকা ক্রেডিটের নিয়মিত সদস্যদের কাছে ইন্টারেস্ট ব্যাংকের আদলে নামিয়ে আনার আহ্বান জানান। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘এতে যারা ব্যবসা করতে চান তারা অনায়াসে ব্যবসা করতে পারবেন এবং ব্যাংকের পরিবর্তে ঢাকা ক্রেডিট থেকেই বেশি ঋণ নিবে সদস্যরা।
অগ্নিকান্ড থেকে যেটুকু রক্ষা করতে পেরেছেন, তা দিয়ে আবারো ব্যবসা শুরু করতে চান। তিনি মনে করেন, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর এটি দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এতো বড় ক্ষতি আর দেখা যায়নি। গুলশান অগ্নিকান্ডে দুই শত একানব্বইটি দোকান সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়। ক্লেমেন্ট গমেজ বলেন, পূণর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিলে ডিএনসিসি মার্কেট ছাড়তে চাই। আর সরকার যদি পূণনির্মাণের উদ্যোগ না নেয়, সে ক্ষেত্রে নিজেরা দু-চালা ভবন নির্মাণ করতে চাই। ফিরে পেতে চাই দোকানের আগের অবস্থান।
মনিপুরীপাড়াতেই থাকেন ওই মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আরেকজন, নাম লিটন গমেজ। সম্পর্কের দিক থেকে লিটন গমেজ ক্লেমেন্ট গমেজের ভাতিজা। কাকা ক্লেমেন্ট তাকে এ ব্যবসায় এনেছিলেন। মুঠোফোনে যোগাযোগ করে অনেকক্ষণ তার বাসায় বসে আছি শুনে বিজয় সরণি থেকে পায়ে হেঁটে বাসায় আসেন লিটন। দেরি হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। ভীষণ ভারাক্রান্ত মন। বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। তারপর বলতে শুরু করলেন সেদিনের ঘটনা। গভীর রাতে সহকর্মী দোকানীদের ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। লিটন বলেন, ‘গিয়ে দেখি সব পুড়ে ছাই।’ এত বছরের তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন মুহুর্তেই শেষ হয়ে গেল। ‘চোখের সামনে সারা জীবনের অর্জনকে পুড়তে দেখেছি। গায়ের রক্ত হিম করে অর্জিত সম্পদ চোখের সামনে এভাবে পুড়ে যাবে, ভাবিনি। আগুন-পানির কাছে মানুষ অসহায়।’ কন্ঠরুদ্ধ হয়ে আসে লিটনের। ভেতরের কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। বড় মেয়ে বাবার পাশে এসে বসে। সেও বাবার কষ্ট বোঝে। বাবা-মেয়ের চোখাচোখি হয়। মেয়ের কথায় কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন।
লিটন বলছিলেন, ওখানে গিয়ে আগুনের লেলিহান শিখায় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। দুই ভাই লিওন ও লিমেনসহ নয়জনকে নিয়ে লিটনের ‘আন্না প্লাজা’ পরিবার। পজিশনমূল্যসহ অগ্নিকান্ডে তার প্রায় দুই কোটি টাকার মালামাল ক্ষতি হয়েছে। লিটনের আন্না প্লাজায় বডিসোপ, বেবিফুড ছাড়াও কসমেটিকস্, টয়লেট্রিজ পণ্য পাওয়া যেত। সবগুলোই বিদেশি ব্র্যান্ডের। কাকা ক্লেমেন্টের কাছে ব্যবসার হাতেখড়ি সেই ১৯৯৫ সাল থেকে।উদ্ধারকৃত মালামালের সামনে এভাবেই ক্যামেরায় ধরা দিলেন লিটন গমেজ।
লিটনও ঢাকা ক্রেডিটের নিয়মিত সদস্য। ব্যবসার জন্য ব্যাংকসহ ঢাকা ক্রেডিটের ঋণ রয়েছে। বড় দূর্ভাবনায় পড়েছেন লিটন। পজিশনের ওপর ব্যবসার অগ্রগতি নির্ভর করে। অনেক সময় ব্যবসার দোকানের পজিশন ধরে রাখার জন্য বড় অংকের টাকা গুনতে হয়। পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়া এখন তার জন্যে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দুই মেয়ের জন্য, পরিবারের জন্য তিনি আবার শুরু করতে চান তার থমকে যাওয়া জীবন। কারণ, তারাই যে তার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। লিটন পারবেন, তাকে পারতে হবে। কারণ তার কথায় যে দৃঢ়তা দেখেছি, তা অবিশ্বাস্য।
মুঠোফোনে কথা হয় আরেক ব্যবসায়ি, ব্রাদার্স ভ্যারাইটিস স্টোরের কর্ণধার টোটন ফ্রান্সিস ছেড়াওর সাথে। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘দাদা সবই তো শেষ। বাসার মালিককে কী করে বলি এই মাসের ভাড়া দিতে পারব না। সংসার কীভাবে চালাব, মা-ভাইয়ের চিকিৎসা কীভাবে করাব ভেবে পাচ্ছিনা। গুলশান অগ্নিকান্ডে ফ্রান্সিসের সাড়ে ৪৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কসমেটিকস, বেবিফুডসহ টয়লেট্টিজের দোকান ছিল তার। ঘটনার দিন রাত আড়াইটার দিকে কর্মচারী, ভাতিজা, ভাগিনারা জানালো, ঘুমাইতাছো, এদিকে সবই তো শেষ! গিয়ে দেখেন আগুনের কুন্ডলী চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু মানুষের হাহাকার আর কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সকাল ৯টার মধ্যে পুরো ভবনটি খন্ডখন্ড হয়ে ধসে পড়েছে।
ব্রাদার্স ভ্যারাইটি স্টোরের কোনো চিহ্নমাত্র আর সেখানে নেই। দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্যাশ রেখে এসেছিলেন, সেটিও পুড়ে ছাই। সব হারিয়ে এখন পাগলপ্রায়। বাড়ি গিয়ে অন্য কাজ করবেন সেই শক্তি-সামর্থ্যও আর নেই, বয়স হয়েছে। গত ডিসেম্বরে বিশ লাখ টাকা ঋণ করেছিলেন। সেটার কী হবে, সংসারের কী হবে, কীভাবে মায়ের চিকিৎসা চালিয়ে যাবেন, কোনোটিরই সদোত্তর জানা নেই ফ্রান্সিসের। মনে পড়লেই ভীষণ কান্না আসে। কী করে, কার কাছে প্রকাশ করবেন তার মনের এই যন্ত্রণা, লুকোনো কষ্ট?
ফ্রান্সিস বলেন, ‘মানুষের সহমর্মিতা পেলে আবার শুরু করতে চাই। দি খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি: ঢাকা এবং দি মেট্রোপলিটান খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি: যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, তবে নতুন করে শুরু করতে চাই। একেবারে জিরো থেকে আবার শুরু করতে চাই।
ক্লেমেন্ট, লিটন, ফ্রান্সিসরা সত্যিকার অর্থেই একেকজন সফল উদ্যোক্তা। তাদের অনেক যুদ্ধ জয়ের গল্প আছে। তারা হেরে যাওয়ার পাত্র নন, তারা কখনো থামতে জানেননা। কোন কিছুই তাদের দমিয়ে রাখতেও পারবেনা। তারা পারবেন, তারা জানেন কিভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়, যুদ্ধ জয় করতে হয়। কারণ, তারা যে জীবন যুদ্ধের ও অনুপ্রেরণার একেকজন সাচ্চা সৈনিক!
আরপি/আরবি/এসএন/ ২২ জানুয়ারি, ২০১৭